পক্ষে
সলিল কুমার দে , অবসরপ্রাপ্ত কর্মী
প্রতিদিনের বাজার করতেই সাধারণ মানুষের নাজেহাল অবস্থা। তবুও পুজো এলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে, আবার ভারাক্রান্তও হয় মন। এই অগ্নিমূল্যের বাজারে সবাইকে খুশি করতে পারব তো? আগে আমাদের সময় পাড়ার পুজো বা আশপাশের পুজোয় এত জাঁকজমকপূর্ণ বা থিমের ব্যাপার ছিল না কিন্তু আন্তরিকতা আনন্দ অনেক বেশি ছিল। এখনকার পুজোগুলো প্রাণহীন, আনন্দবিহীন, কাঠকাঠ এবং প্রতিযোগিতা সর্বস্ব। পুরোটাই যেন বহুজাতিক সংস্থার ইভেন্ট। বাড়াবাড়ি রকমের নিজেদের জাহির করার প্রচেষ্টায় বিপুল পরিমাণ খরচ হয়। যার চাপ পাড়ার লোক হিসেবে আমাদের উপরেও কিছুটা এসে পড়ে বইকি। তাই আমার কাছে সাধারণভাবে মায়ের আরাধনাই শ্রেয়।
চন্দ্রা শীল, শিক্ষিকা
জাঁকজমকপূর্ণ থিমপুজোর প্রয়োজনীয়তা নেই। মহালয়ার আগে থেকেই উদ্বোধন হয়ে যায়, তারপর যে পুজোয় যত প্রচার, সেখানে লম্বা লাইন। লাইনের চাপে রাস্তা আটকে যায়। অসুস্থ মানুষ গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন না। থিমপুজোয় কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণের পুজো। সেই সাবেকিয়ানা বা পাড়ার মানুষদের হাতে হাত মিলিয়ে করা বারোয়ারি পুজো। থিমপুজোয় পাল্লা দেওয়ার প্রতিযোগী মনোভাব কাজ করে। কার দর্শক সংখ্যা বেশি, প্রচার হয়। যে টাকায় থিমপুজো হয় তার অর্ধেক অর্থে পুজো করে বাকিটা আর্থিকভাবে দুর্বল ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়ার মতো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
পার্থপ্রতিম অধিকারী, ছাত্র
থিমপুজোর প্রবণতা গত কয়েক বছরে জনপ্রিয়তা পেলেও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পুজো একান্ত ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উৎসব, যার মূল উদ্দেশ্য হল দেব-দেবীর আরাধনা এবং সমাজের মধ্যে মিলন ও আনন্দ উদযাপন। থিমপুজো অনেক সময় এই মূল উদ্দেশ্য থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে দেয়। পুজো মূলত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। থিমপুজো প্রায়ই একটি বাণিজ্যিক বা বিনোদনমূলক ইভেন্টে পরিণত হয়, যেখানে ধর্মীয় ভাব ও আধ্যাত্মিকতা নষ্ট হতে পারে। পুজোর আসল উদ্দেশ্যটি থিমের কারণে প্রায়শই হারিয়ে যায়। থিমপুজো প্রায়শই একটি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের সৃষ্টি করে, যা সমাজের ভিতরে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। পুজো মূলত একটি সামাজিক ঐক্যের উৎসব, যা থিমের প্রতিযোগিতার কারণে দুর্বল হতে পারে। তাই এই থিমপুজো সর্বসাকুল্যে গ্রহণযোগ্য নয়।
দেবাশীষ চিন্যা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী
থিমপুজোর ঠাকুর দেখতে ভালো লাগে না, কারণ থিমপুজোয় পুজোটাই যেন থাকে না, মনে হয় সব পুতুল। থিমের ঠাকুর দেখে হাত দুটো জোড় করে প্রণাম করার ভক্তি মনে আসে না। এ যেন পুতুল। কোথাও মা দু্র্গা যদিও একটু বড় হয়, কিন্তু তার ছেলেমেয়েরা খুব ছোট, সিংহের তেজ নেই, অসুরের মনোভাব শান্ত, যুদ্ধের ইচছা নেই! মা দুর্গা যেন সন্ধি করার আহ্বান জানাচ্ছেন অসুরকে। থিমের ঠাকুর দেখার আকর্ষণও তাই নেই। এখন সবাই জাঁকজমকপূর্ণ থিমের পুজো করছে ঠিকই, তবে সাবেকি দুর্গাপ্রতিমা দেখলে যে আনন্দ হতো সেটা উধাও। থিমপুজোর ঠাকুর দেখলে মন ভরে না।
বিপক্ষে
কৌস্তভ দত্ত, কলেজ ছাত্র
দুর্গাপুজোয় ‘জাঁকজমকপূর্ণ থিম’ সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয়, তা বলা যায় না। প্রথমত, অভিনব থিমযুক্ত মণ্ডপ শৈল্পিক সৃজনশীলতা প্রদর্শন করে যা দেশ দেশান্তর থেকে দর্শকদের আকর্ষণ করে। যা স্থানীয় অর্থনীতি এবং পর্যটনকে বাড়িয়ে তোলে। এর ফলস্বরূপ স্থানীয় মানুষের অর্থসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, থিমপুজোয় সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা এবং প্রবণতাও প্রতিফলিত হয়, যা উৎসবটিকে আধুনিক দর্শকদের জন্য প্রাসঙ্গিক করে তোলে। তৃতীয়ত, থিমপুজো ছাড়া দুর্গাপুজো তার অভিনব সৃজনশীলতাকে হারিয়ে ফেলতে পারে, যা এটিকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে।
অমানীশ বন্দ্যোপাধ্যায়, গৃহশিক্ষক
থিমপুজোয় কোনও একটি বিষয় প্রতিফলিত হয়। বিখ্যাত ঘটনা, মন্দির, শহর ইত্যাদি শিল্পীর সৃজনশীলতায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। এটি মানুষকে দর্শন ও মননগত দিক থেকে কিছুটা পরিতৃপ্তি দেয়। অনেক সময় থিমপুজোয় হস্তশিল্প ও সূচিসিল্পের সূক্ষ্ম কারুকার্য পরিলক্ষিত হয় যা এই সমস্ত শিল্পকে টিকিয়ে রাখা এবং শিল্পীদের সম্মান জানানোর একটি প্রয়াস। যে সমস্ত শিল্পী থিমপুজোর রূপ দেন, তাঁদেরও রুজি-রোজগারের পথ প্রশস্ত হয়। সর্বোপরি, বর্তমানে অভিনব চিন্তাধারার মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশের অন্যতম উপায় হল থিমপুজো। এক্ষেত্রে থিমের প্রয়োজন অবশ্যস্বীকার্য।
সুকন্যা দাস, কলেজ ছাত্রী
জাঁকজমকপূর্ণভাবে করার প্রয়োজন আছে কি না বলতে পারি না, কিন্তু থিমপুজোর প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। পুজোর সময় খুব কমই ফাঁকা মণ্ডপ দেখা যায়; যা থেকে বোঝাই যায় কত মানুষজন ঠাকুর দেখতে বেরন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার খুব ভালো সুযোগ আসে পুজোর সময়। তা সদ্ব্যবহার করতে পুজো উদ্যোক্তারা বিভিন্ন থিম বেছে নেন। যার মধ্যে অন্যতম শিশুশ্রম রদ, নারী শিক্ষা, নারী সুরক্ষা, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, পরিবেশ সচেতনতা প্রভৃতি। এছাড়াও থাকে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থানের ইতিহাস তুলে ধরা, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারার প্রকাশ। তাই সাবেকি পুজোর সঙ্গে থিমপুজোর প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে।
বিকাশ রায়, প্রাক্তন শিক্ষক
থিমপুজো যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনই বর্তমান সময়ে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। শিল্পীর নান্দনিক চিন্তার ফসল এই সব পুজোয় দেখা যায়। নানা রূপে নানা বৈচিত্র্যে। বিভিন্ন বিষয়কে উপস্থাপন করতে বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োজন। হাজার হাজার মানুষ নিয়োজিত হয় শৈল্পিক উৎকর্ষতার বৃদ্ধির জন্য। ফেলে দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবহারে আর্থিকভাবে অনেকেই উপকৃত হন। দর্শনার্থীরা চিরাচরিত ছবির পরিবর্তে নিত্যনতুন আঙ্গিকের তৃপ্তিতে সমৃদ্ধ হন। ঘরের মেয়ে উমাকে নানা রূপে নানা পরিবেশে খুঁজে পেতে চান। শিল্পীর ভাবনার সঙ্গে আমজনতার মানসিক মেলবন্ধনে থিমের ভূমিকা অপরিসীম।