হুমকির মুখে পড়লে কীভাবে নিজেকে বাঁচাবেন? তার আইনি পথ নিয়ে আলোচনা করলেন কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট মীনাল সিনহা।
ব্ল্যাকমেল! হুমকি! শব্দগুলো শুনলেই ভয় জাগে সাধারণ মানুষের মনে। ব্ল্যাকমেল বলতে ঠিক কী বোঝায় প্রথমেই তা স্পষ্ট করলেন হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট মীনাল সিনহা। তাঁর মতে, ব্ল্যাকমেল-এর মধ্যে তিনটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। প্রথমত, অযৌক্তিক দাবি জানানো। দ্বিতীয়ত, ভয় দেখানো। তৃতীয়ত, ভয় দেখিয়ে বা অযৌক্তিক দাবি করে কোনও লাভের রাস্তা তৈরি করা বা কারও ক্ষতি করা।
ব্ল্যাকমেল অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পূর্বতন আইপিসি-র ৩৮৪ নম্বর ধারা এবং এখনকার ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৩০৮ নম্বর ধারায় ব্ল্যাকমেলের সংজ্ঞা ও শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।
কীভাবে ব্ল্যাকমেল ঘটানো হয়? কোনও ব্যক্তি যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আর একজনকে আঘাত করার ভয় দেখায় এবং অসদুপায়ে তার কাছ থেকে সম্পত্তি এবং মূল্যবান কিছু জোর করে আদায় করতে চায়, তখন সেটা ব্ল্যাকমেলিং-এর পর্যায়ে পড়ে। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অবমাননাকর কোনও বিষয় ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখানো, বাচ্চার ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে অথবা সইসাবুদ করা কোনও কাগজের জন্য টাকা আদায় করাও।
এই ধরনের হুমকি দিয়ে কাজ হাসিল করা বা ব্ল্যাকমেল করার ক্ষেত্রে শাস্তির নানা স্তর রয়েছে। ব্ল্যাকমেল করার জন্য কারও সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে অথবা জরিমানা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দুটোই। ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা বা ভয় দেখানোর জন্য দু’বছরের জেল হতে পারে অথবা জরিমানা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দুটোই। আর ব্ল্যাকমেলের মাধ্যমে প্রাণনাশের হুমকি বা আঘাত দেওয়া হলে তার শাস্তি দশ বছর পর্যন্ত সাজা এবং জরিমানা। যদি কোনও ক্ষেত্রে বড়সড় অপরাধ নিয়ে মিথ্যে অভিযোগের হুমকি দেওয়া হয়, তাহলেও সাজা হতে পারে দশ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা। এই ধরনের শাস্তির মাধ্যমে মানুষকে নিগ্রহ থেকে সুরক্ষা দেওয়া এবং সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
ব্ল্যাকমেল কত ধরনের হয়? মীনাল জানালেন, ব্ল্যাকমেল সবসময়েই বেআইনি কারণ এটি সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী। আমাদের সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের সুস্থ ও সম্মানজনক জীবনধারণের অধিকার সুনিশ্চিত করে, ব্ল্যাকমেল সেই নাগরিকের সামাজিক সুস্থতারও বিঘ্ন ঘটায়। শারীরিক ক্ষতি করার হুমকি, ক্ষতিকর কোনও তথ্য প্রকাশের হুমকি, সম্পত্তি নষ্টের হুমকি কিংবা মিথ্যে অপরাধমূলক অভিযোগ — এসবই পড়ে ব্ল্যাকমেলের মধ্যে। আধুনিক যুগে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং ভার্চুয়াল জগতের মারাত্মক প্রভাবের ফলে এখন ব্ল্যাকমেল অনলাইনেও আকছার হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ওয়েবক্যাম ব্ল্যাকমেলিং এবং ‘সেক্সটরশন’।
শেষ দু’টি বিষয় নিয়ে একটু বিশদে বললেন মীনাল। ওয়েবক্যাম ব্ল্যাকমেল-এ ক্যামেরা অন রেখে আপত্তিকর কাজকর্ম করতে বাধ্য করা হয়, সেটির রেকর্ডিং করে সেই ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় যতক্ষণ না দাবি মেটানো হচ্ছে। এর ফলে সব বয়সের এবং সব লিঙ্গের মানুষের মারাত্মক মানসিক বিপর্যয় হতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে তা আত্মহননের দিকে পর্যন্ত চলে যায়।
সেক্সটরশনও একধরনের ব্ল্যাকমেল। আক্রান্তের কাছ থেকে জবরদস্তি করে কোনওরকম অবাঞ্ছিত সুবিধা বা আপত্তিকর ছবি নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারও ঘটতে পারে। ব্যক্তিগত মেসেজে ব্যবহৃত যৌন ছবি ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কোনও উচ্চপদাসীন আধিকারিক এমনটা করতে পারেন।
এখন কী ধরনের ব্ল্যাকমেলিং বেশি হচ্ছে? আইনজীবী জানালেন, স্প্যামাররা আজকাল সিবিআই, ইডি বা পুলিসের নাম করে ব্যবসায়ীদের ফোন করে বা মেল করে একটা বিশেষ পরিমাণ টাকা চায় মামলা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য। এধরনের মেল আইডি বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরের ইমেলে-র সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়। এতে যাকে ভয় দেখানো হচ্ছে, সে মনে করে সত্যি সত্যিই প্রশাসন তরফে মেল বা কল এসেছে। তাদের নির্দেশ মেনে টাকা খোয়ায়।
আর কী পথে ব্ল্যাকমেলিং হয়? ইদানীং ফোনকল আসছে যে ক্যুরিয়ারে আপনার পাঠানো কোনও পার্সেলে মাদক রয়েছে। সেটি আটক করা হয়েছে। ‘অভিযুক্ত’ যদি বিশেষ পরিমাণ টাকা দ্রুত জমা না দেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেনে নেওয়া যাক ব্ল্যাকমেল করা হলে কী করবে কেউ? মীনাল বলেন, প্রথম যেটা মনে রাখতে হবে কোনও অবস্থাতেই ব্ল্যাকমেল করছে যে, তার দাবি মেটানো যাবে না। দ্রুত পুলিস কিংবা আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ব্ল্যাকমেলার যদি টাকা চায়, তাকে থামাতে কেউ যদি টাকা দিয়ে বসে? মনে রাখবেন, টাকা দিলেও ব্ল্যাকমেলার সব দাবি মানবে না। উল্টে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তাই টাকা দেওয়া কোনও অবস্থাতেই উচিত নয়। ব্ল্যাকমেলার ভুয়ো তথ্যের উপরে ভিত্তি করে ব্ল্যাকমেল করতে পারে। তা সত্ত্বেও সেটা অপরাধই। এক্ষেত্রে ডিলিট হওয়া মেসেজ কি প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয়? অবশ্যই হয়। ডিজিটাল ফরেন্সিক ওই মেসেজ পুনরুদ্ধার করে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে কি আপস করা উচিত? আইনজীবীর মতে, এটাও করা উচিত নয়। তাছাড়া ওই সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনও মানুষের মানসিক পরিস্থিতিও থাকে না।
ব্ল্যাকমেলার যদি বেনামে হুমকি দেয়? তা হলেও অভিযোগ জানাতে হবে। তদন্তকারী সংস্থা বেনামি যা কিছু ঠিক খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া জানে। আর ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে আইনজীবীর মাধ্যমেই কথা বলুন। এমন সম্ভাবনা যদি তৈরি হয় যে ব্ল্যাকমেলার ইতিমধ্যেই কোনও গোপন তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে বা ছড়িয়ে দিয়েছে? এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে যে, একটা ঘটনায় আপনার জীবন শেষ হয়ে যায় না। অন্যের জীবন নিয়ে মানুষ আর কতদিনই বা কিছু মনে রাখে? নিজে থেকে বিষয় উত্থাপন না করলে কেউ মনে রাখে না। অসুবিধে হলে থেরাপিস্টের সাহায্য নিন। বন্ধুবান্ধব পরিবারের সঙ্গে কথা বলে মানসিক সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করুন। একটু চুপচাপ থাকুন কিন্তু যেটা সঠিক, সেটাই করুন অর্থাৎ আইনি পথে চলুন। এধরনের অপরাধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের নানা ধারায় শাস্তি ও জরিমানার পরিসর রয়েছে।
নাবালকরাও কি ব্ল্যাকমেলের শিকার হতে পারে? মীনাল জানালেন, হতেই পারে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে এবং সেরকম কিছু হলে দ্রুত প্রয়োজনমতো পদক্ষেপ করতে হবে। কখনও কখনও কমবয়েসি কেউ এর দ্বারা ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার চারপাশের পরিবেশ বা স্কুল বদলাতে হবে যাতে সে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
ব্ল্যাকমেল এড়ানোর যথাসম্ভব চেষ্টা কীভাবে করা যায়? মীনালের মতে, হুমকি দিয়ে কেউ কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে কি না, তা আগে থেকেই বোঝার চেষ্টা করুন। ভবিষ্যতে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ডিজিটাল শিক্ষা খুবই দরকারি। অনলাইনে কাজকর্ম করার আগে বিশেষজ্ঞর মতামত নিয়ে তবেই এগন। কার সঙ্গে কী ধরনের তথ্য শেয়ার করছেন, সেদিকে অত্যন্ত সজাগ থাকুন। এসব ক্ষেত্রে কখনও অন্যমনস্ক হবেন না। আর্থিক অথবা যৌন সম্পর্ক সংক্রান্ত কোনও ফাঁদে পা না দেবেন না। এধরনের প্রলোভন এড়িয়ে চলুন। মনে রাখবেন, পৃথিবীতে বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না।
অন্বেষা দত্ত