বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
শরীর ও স্বাস্থ্য
 

বিশ্বাসে ভাসলেই বিপদ, 
আগে বিজ্ঞান মেনে চিকিৎসা

মতামত দিচ্ছেন বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ অপূর্ব মুখোপাধ্যায়।

চিকিৎসকের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা কি রোগ সারাতে সাহায্য করে?
চিকিৎসাশাস্ত্রে এই অনুভব এক অদ্ভুত বিশ্বাসের খেলা। রোগী বা তাঁর পরিজন অনেক সময় ভাবেন, নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেই তাঁদের শারীরিক যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হয় বা কোনও অসুখ কোনও কারণে কেউ ধরতে না পারলে মনে মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, অমুক ডাক্তার দেখলে ঠিকই সুস্থ হয়ে যেতাম। কিংবদন্তি বা অন্যতম সেরা চিকিৎসকদের নিয়ে রোগীর পরিজনদের মধ্যে একটি কথাটা প্রচলিত যে ‘ওঁকে দেখলেই অসুখ অর্ধেক সেরে যায়।’ একে প্লাসিবো বলে। এই বিশ্বাস অনেক সময় শরীরকে সুস্থ করতে অনুঘটকের কাজও করে ঠিকই। কিন্তু এটি বিজ্ঞানের পরিপন্থী। একথা চিকিৎসক হিসেবে শুনতেও হয়তো ভালো লাগে। কিন্তু এই অনুভব খুব কার্যকরী বলে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না। এই কথায় কোনও বিজ্ঞান নেই। 

কেন করেন না? আপনার সম্পর্কেও তো এমন আপ্তবাক্য শোনা যায়।
আমার মনে হয়, একজন চিকিৎসকের প্রধান ও সর্বাপেক্ষা জরুরি কাজ হল মন দিয়ে চিকিৎসা করা ও রোগীর দ্রুত আরোগ্যের ব্যবস্থা করা। রোগী ব্যক্তিগতভাবে সেই চিকিৎসককেই ভালোবাসেন বা দেখাতে চান, যিনি তাঁর সঙ্গে ভালো করে কথা বলবেন, তাঁর সব সমস্যা মন দিয়ে শুনবেন ও চিকিৎসকের ব্যবহারে এমন কোনও এক্স ফ্যাক্টর থাকবে, যেখানে রোগীর কাছে তিনি ‘প্রিয়’ হয়ে উঠবেন। এই গোটা বিষয়টি খুব ইতিবাচক। তবে এখানে একটি বিষয় না বললেই নয়—  কোনও চিকিৎসকের হয়তো সেই বিশেষ এক্স ফ্যাক্টরটি নেই, তিনি হয়তো একটা মেজাজি বা অল্প কথার মানুষ। অথচ রোগ সারাতে খুব দক্ষ। তাঁর জন্য রোগীর মনে হয়তো আলাদা করে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা হল না, কিন্তু অসুখ সারিয়ে দিলেন। চিকিৎসাক্ষেত্রে এমন চিকিৎসকেরই বেশি প্রয়োজন। আমার সম্পর্কে এই বিশ্বাস কেউ অর্জন করলে তা আমার শুনতে ভালো লাগবে ঠিকই, কিন্তু আমি যদি কয়েকজন রোগীর রোগ নির্ণয়ে ভুল করি, তাহলে এই বিশ্বাস ভাঙিয়ে সুখী হওয়া যাবে না।

এমন বিশ্বাস রোগীর মনে তৈরি হয় কি কোনও অসহায়তা থেকে?
এ সম্পর্কে আমার সঠিক ধারণা নেই।  তবে মনে হয় যে চিকিৎসক শুধু তাঁর কাজের পাশাপাশি চাহনি, ব্যবহার ও আলাপচারিতা দিয়েও রোগীকে কিছুটা আরাম দিতে পারেন। তাঁর প্রতিই এমন বিশ্বাস গড়ে ওঠে। সেখানে অসহায়তার থেকেও যা বড়, তা হল রোগীর সমব্যথী হতে পারার ক্ষমতা। এখানেই একজন চিকিৎসকের সঙ্গে অপর আর এক জন চিকিৎসকের ফারাক। গ্রামাঞ্চলে এই ভরসা আরও বেশি করে জন্মায়। সেখানে চিকিৎসককে ‘ঈশ্বর’-এর মতো শ্রদ্ধা করা হয়, এমনও দেখেছি। তবে সবটাই লুকিয়ে সঠিক চিকিৎসায় রোগীর আরোগ্য ও সমব্যথী হওয়ার মধ্যে।

এই ‘সমব্যথী হয়ে ওঠার পাঠ’ কি এখন কমে যাচ্ছে?
তা খানিক যাচ্ছে তো বটেই। তবে চিকিৎসকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এখনকার প্রজন্মকে অনেক ভয় ও দ্বিধা নিয়ে ডাক্তারি করতে হয়। রোগী ও পরিজনদের ধৈর্য কমেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের হাতে চিকিৎসকরা নিগৃহীত হন। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর সমব্যথী হয়ে ওঠার জন্য যে মন প্রয়োজন, তা একজন তরুণ চিকিৎসক তৈরি করতে পারেন না। তার উপর তাঁর অভিজ্ঞতা কম থাকে। কোন রোগ কোনদিকে বাঁক নিতে পারে, কোন রোগী দারুণ ভালো থেকে হঠাৎ খারাপ হয়ে যেতে পারেন, এই অভিজ্ঞতা না থাকলে পরিস্থিতি সবসময় আয়ত্তে থাকে না। তরুণ বয়সে সে ক্ষমতাও থাকে না। ‘সেরা’ হওয়ার কিছু শর্ত থাকে। অনেক বেশি পড়াশোনা, সারাক্ষণ নিজেকে নতুন অসুখ ও ওষুধ নিয়ে আপ-টু-ডেট রাখা, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় টেস্টটুকু করে চিকিৎসা করার মতো অনুশীলন থাকতে হয়। এইসব সকলের থাকে না। ইদানীং যে হারে চিকিৎসক নিগ্রহ শুরু হয়েছে, তাতে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কটাই তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোন দিক থেকে আক্রমণ আসবে বুঝতে না পেরে তরুণ চিকিৎসকদের কেউ কেউ আগেই সবরকম টেস্ট করিয়ে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আছেন প্রথম থেকেই খুব ধৈর্যশীল। পড়াশোনা করেন নিয়মিত। বয়স বাড়লে ধীরে ধীরে তাঁদের অভিজ্ঞতা বাড়ে। তখন তাঁদের নিয়েও এমন ভালো ভালো কথা শোনা যায়। তবে এ কথা কারও নামে প্রচলিত হলে তবেই সে বড় ডাক্তার, নইলে নয় এমন কোনও কথা নেই। বরং এই প্রশংসায় ভেসে গেলে বিপদ আছে।

কীরকম বিপদ?
দিনের শেষে কিন্তু চিকিৎসকরাও মানুষ। তাই ‘আপনাকে দেখলেই রোগ ভালো হয়ে যায়’ জাতীয় কথাবার্তা কোথাও আত্মবিশ্বাসে বাড়তি অক্সিজেন জোগায়। অনেক সময় তা থেকে ভুলভ্রান্তি ঘটতে পারে। কখনও রোগীর মন বুঝতে গিয়ে ও সমব্যথী হয়ে উঠতে গিয়ে চিকিৎসক প্রগলভ হয়ে উঠতে পারেন।

কিন্তু এই বিশ্বাস তো কাজেরই স্বীকৃতি। ভালো চিকিৎসকের পুরস্কার। 
কেউ হয়তো দেখা হওয়ার পর বললেন, ‘আপনি ২০ বছর আগে আমার তিন মাসের জ্বর আর পেটে ব্যথা একবার দেখেই ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তুলেছিলেন। আপনি ছিলেন বলে বেঁচে গেলাম। আপনাকে দেখলেই অর্ধেক রোগ কমে যায়!’— এইসব চিকিৎসকের পুরস্কার। এইসব প্রশংসা শুনলে ভালো লাগলেও, এতে ভেসে গেলে বিপদ। দিনের শেষে এই বিশ্বাস ও সম্পর্কের আগে কিন্তু রোগীর আরোগ্য ও বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে থাকে। রোগীর বিশ্বাস যা-ই থাক, রোগ নিজের আয়ত্তে না এলে তা নিয়ে অকারণ ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এররে’ না গিয়ে কোথাও রেফার করতে হবে। কোনও অসুখ নিজে সহজে আঁচ করছি বুঝলে অকারণ টেস্ট দেওয়া যাবে না। অল্প ওষুধে আরোগ্য আনতে হবে— এগুলোই আসল গুণ। 
সাক্ষাৎকার: মনীষা মুখোপাধ্যায়

12th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ