ফি বছর মর্তে আসেন মা দুর্গা সপরিবারে। ভক্তরা কতকিছু নৈবেদ্য দেন, উৎসর্গ করেন তাঁর কাছে। সাধারণত তিনি সেসব ছুঁয়েও দেখেন না। কিন্তু একবার হল কী, কৌতূহলবশে এক ভক্তের নিবেদন করা এক গ্লাস মশলা চায়ে তিনি চুমুক দিয়ে বসলেন। দারুণ টেস্টি লাগল। নন্দী-ভৃঙ্গিকে আদেশ করলেন, মর্ত থেকে কয়েক পেটি দার্জিলিং টি সরাসরি কৈলাসে নিয়ে যেতে। শুরু হল মায়ের নিয়মিত চায়ে পে চর্চা। বাবা মহেশ্বরও গাঁজা ভাং ছেড়ে জর্দা পানের নেশা ধরলেন। এসব নিয়েই প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে আশাপূর্ণা দেবী লিখেছিলেন এক মজার গল্প, কৈলাসে চা পান।
চায়ের নেশাও কিন্তু জব্বর নেশা। সকালে বা সন্ধ্যায় যাদের চা পানের অভ্যসে আছে, নির্দিষ্ট সময় চা না পেলে তাদের মাথা ধরে, মেজাজ গরম হয়, কাজে মন বসে না, পটি পরিষ্কার হয় না— ইত্যাদি ইত্যাদি। চা পান করা শরীরের পক্ষে ভালো না খারাপ, সেই প্রশ্নটার আগে মীমাংসা করে নিই।
পরিমিত মাত্রায় চা পান শরীরের পক্ষে ভালো। প্রতি কাপ চায়ে থাকে ক্যাফিন ৩০ থেকে ৬০ মিলিগ্রাম, ট্যানিক অ্যাসিড ৬০ থেকে ১২০ মিলিগ্রাম, প্রোটিন মাত্র ০.৯ গ্রাম, ফ্যাট ১.১ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১৬.৪ গ্রাম। এছাড়া থাকে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যারা দেহের ক্ষয় রোধ করে এবং অন্যান্য উপকার করে। থাকে বিভিন্ন ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং অ্যালকালয়েড, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ। যেমন ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি। কিছু ভিটামিনও থাকে। যেমন ভিটামিন এ, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বি, সি, ই। কাজেই চায়ে অবশ্যই নানা পুষ্টিকর উপাদান থাকে এবং সেগুলো উপকারও করে।
কিন্তু পরিমিত পরিমাণে চা পান করলে তবেই এই উপকার পাওয়া যায়। এই পরিমাণটা হল বড় কাপের তিন থেকে চার কাপ অর্থাৎ সারাদিনে প্রায় ৫০০ মিলিলিটারের মতো। অতিরিক্ত চা পান মানেই শরীরে অতিরিক্ত ক্যাফিনের প্রবেশ। যার ফলে রক্তে কোলেস্টেরল ও সুগার বাড়তে পারে, প্রেশার বাড়তে পারে, অতিরিক্ত অ্যাসিড ক্ষরণের জন্য পাকস্থলীতে ঘা দেখা দিতে পারে, খিদে ও ঘুম কমতে পারে, মেজাজ খিটখিটে হতে পারে। ক্যাফিন জনিত এসব উপসর্গের নাম ক্যাফিনিজম। অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা বারে বারে চা এবং ব্ল্যাক কফি পান করলে এই অতিরিক্ত ক্যাফিন ভ্রুণের ক্রোমোজোমগত পরিবর্তন ঘটিয়ে অপরিণত শিশুর জন্ম দিতে পারে।
খুব গরম চা বারে বারে খেলে খাদ্যনালী এবং পাকস্থলীর ভিতরের আবরক পর্দা বা মিউকাস মেমব্রেনে ঘা দেখা দেয়, যার থেকে ভবিষ্যতে বড় বিপত্তিও হতে পারে। শুধু গরম চা কেন, যে কোনও গরম পানীয় থেকেই এই বিপত্তি ঘটতে পারে। অনেকক্ষণ ধরে চা ভিজিয়ে বা ফুটিয়ে যে নির্যাস পাওয়া যায় সেই চা শরীরের পক্ষে বেশি ক্ষতিকারক। কারণ এতে ক্যাফিন এবং ট্যানিন খুব বেশি পরিমাণে এসে মেশে। যে জন্য লিকার চা খুব বেশি খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো নয়।
লেবু চা লিকার চা থেকে কিছুটা ভালো। কারণ লেবুর সাইট্রিক অ্যাসিডের সঙ্গে চায়ের ট্যানিন বিক্রিয়া করে কাপের তলায় থিতিয়ে পড়ে। এছাড়া লেবুর অ্যাসিডও দেহের উপকারে লাগে।
সাধারণ চা অর্থাৎ দুধ-চিনি সহযোগে তৈরি চা তুলনামূলকভাবে ভালো। কারণ এর ফলে নানা ক্ষতিকর পদার্থ যেমন কাপের তলায় থিতিয়ে পড়ে, তেমনই চায়ে কিছুটা পুষ্টিমূল্যও যোগ হয়। তবে দুধের ফ্যাট এবং চিনির উপাদান সবার উপকারে লাগে না, বিশেষত হাই কোলেস্টেরল এবং হাই সুগারের রোগীদের। চিনি ছাড়া অল্প দুধের চা মন্দ নয়। মাঠা তোলা দুধ বা স্কিমড মিল্ক দিয়ে তৈরি সামান্য চিনি যুক্ত অল্প গরম চা শরীরের পক্ষে ভালো, তবে দিনে ৩-৪ কাপের বেশি নয়।
যাঁরা দিনে দু-তিন কাপ চা খান এবং যাদের ব্লাড সুগার নেই, তাঁরা এতসব চিন্তা করবেন না। চা যে রকম ভাবে খেতে আপনি ভালোবাসেন, সেভাবেই খাবেন। তবে খালি পেটে চা খাওয়া নিয়ে দু’রকম মতামত রয়েছে।
খালি পেটে খুব গরম চা দেহের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে আমাদের মুখের ভেতর এবং পাকস্থলীর মিউকাস মেমব্রেনের পক্ষে। সেজন্য চায়ের সঙ্গে একটি বা দু’টি বিস্কুট খেতে বলা হয়। আবার পুষ্টিবিজ্ঞানীরা একথাও বলেছেন যে, চায়ের সঙ্গে কিছু খেলে সেটা দেহে আয়রন বা লোহা শোষণে বাধা দেয়, কাজেই চা এমনি এমনি খাওয়াই ভালো।
তবে এক কাপ চায়ের পরিমাণ তো এক থেকে দেড়শো মিলির মধ্যে, কাজেই এতসব ভাবনা না করে, যেমন পছন্দ তেমন চা খান।
গ্রিন টি-র কথা আমরা ইদানীং খুব শুনছি। চা পাতা স্টিমিং বা শুকিয়ে গ্রিন টি তৈরি হয়। অন্য চায়ের মতো এখানে অক্সিডেশন এবং ফার্মেন্টেশন প্রসেসিং করা হয় না বলে, এর রং সবুজ থাকে। অনেকরকম গ্রিন টি আছে। তার মধ্যে মাচা টি সবথেকে বেশি পুষ্টিকর। আমাদের শরীরে সব সময় কিছু ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি হয়, যারা বিভিন্ন কোষের ক্ষতি করে, কোষের অকাল মৃত্যু ঘটায়। বিভিন্ন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বা বিজারক পদার্থ এই কাজে বাধা দেয়। গ্রিন টি-তে প্রচুর পরিমাণে এই ধরনের পদার্থ থাকে। যেমন ফ্ল্যাভোনয়েডস, পলিফেনল, এছাড়া বিভিন্ন অ্যামাইনো অ্যাসিড, অ্যালকালয়েড, মিনারেলস ও ভিটামিন গ্রিন টিতে থাকে। আমাদের দেহের বিভিন্ন রক্তনালীকে প্রসারিত করে রক্ত সংবহন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে গ্রিন টি, ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। কোলেস্টেরল কমাতে, স্ট্রোক আটকাতে, ডায়াবেটিস কমাতে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে, স্থূলতায় শরীরের ওজন কমাতে, দাঁতের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গ্রিন টির কোনও বিকল্প নেই।
কাজেই দিনে তিন থেকে চার কাপ চা নিশ্চিন্তেই খেতে পারেন। শুধু যে চায়ের মৌতাত পাবেন তা নয়, অনেক উপকারও পাবেন। তবে খালি পেটে চা খাবেন, নাকি একগাল মুড়ি কিংবা একটা বিস্কুট দিয়ে খাবেন, সেই সিদ্ধান্ত কিন্তু আপনাকেই নিতে হবে। শেষ কথা হল, লিকার চা ভালো লাগলে খেতেই পারেন, কিন্তু বারে বারে নয়।