হ য ব র ল

ভূতুড়ে শহর
ধনুষ্কোড়ি
সায়নদীপ ঘোষ

আয়লা, যশ, ফণী, উম-পুন বা সাম্প্রতিক কালের মোখা। ঘূর্ণিঝড়ের কথা মাথায় এলেই চোখের সামনে ভাসতে থাকে একটাই দৃশ্য— ধ্বংস। প্রকৃতির কয়েক মিনিটের তাণ্ডবের জেরে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে গোটা এলাকা। নিমেষের মধ্যে ঘরছাড়া বহু মানুষ। অনেকেই হারিয়েছেন প্রিয়জনদের। আবার শূন্য থেকে জীবন শুরুর পালা। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বোধহয় এমন সুযোগ মেলে না। ১৯৬৪ সালে ঠিক যেমনটা হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমের ধনুষ্কোড়িতে। বড়দিনের আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ রামেশ্বরম সাইক্লোনের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১ হাজার ৮০০ মানুষ। এরপর আর সেখানে নতুন করে কোনও জনবসতি গড়ে ওঠেনি। ভারতের দক্ষিণ প্রান্তের এই দ্বীপ শহরটি ছেড়ে চলে যান স্থানীয়রা। তারপর থেকে আজও ধ্বংসের স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে— এই ভূতুড়ে শহরটি প্রায় খালি পড়ে রয়েছে। আজও কান পাতলে শোনা যায় মানুষের আর্ত চিৎকার। 
ধনুষ্কোডি সত্যিই এক অদ্ভুত জায়গা। যেখানে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিস্ময়ের মেলবন্ধন ঘটেছে। ‘রামায়ণে’র সঙ্গেও এই জায়গাটির একটি বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। কথিত আছে, বানর সেনার সাহায্যে এখান থেকেই নাকি লঙ্কা যাওয়ার সেতু তৈরি করেছিলেন রাম। যা রামসেতু নামে পরিচিত। ধনুষ্কোড়ি থেকে অবশ্য বালির একটা সরু পথ শ্রীলঙ্কার দিক বরাবর ক্রমশ জলের তলায় চলে গিয়েছে। এটিই ‘রামসেতু’ নামে পরিচিত। রামায়ণে কথিত আছে, লঙ্কা থেকে সীতাকে উদ্ধার করার পর এই সেতু নাকি ভেঙে দিয়েছিলেন রাম। তাই আজ এটা জলের তলায়। অবশ্য, এই সেতুটি আদম ব্রিজ নামেও পরিচিত। আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসার উপগ্ৰহ চিত্রে এর ছবি ধরা পড়েছে। যা দেখে বিশেষজ্ঞদের মত, ধনুষ্কোড়ি ও শ্রীলঙ্কার মূল ভূখণ্ডের মাঝের এই সেতুটি মানুষ নয়, প্রকৃতির এক অভিনব সৃষ্টি। ধনুষ্কোড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ। ১৯৬৬ সালে পক প্রণালী সাঁতরে এখানে এসেছিলেন বিখ্যাত সাঁতারু মিহির সেন।
 এই দ্বীপ শহরটি থেকে শ্রীলঙ্কার দূরত্ব মাত্র ৩১ কিলোমিটার। একটা সময় পর্যন্ত এই শহর দিয়েই ভারত আর শ্রীলঙ্কার মধ্যে নিত্য যাতায়াত করতেন বহু মানুষ। ধনুষ্কোড়ির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই শহর ছিল উত্তর শ্রীলঙ্কায় বসবাসকারী তামিল সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে ভারতীয় তামিলদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অন্যতম মাধ্যম। পাম্বান থেকে ধনুষ্কোড়ি পর্যন্ত ট্রেন চলত। এই ট্রেনে করেই যাতায়াত করতেন তামিলনাড়ুর মানুষ। এছাড়াও ধনুষ্কোড়ি বন্দর থেকে ছিল স্টিমারের ব্যবস্থা। এর জেরেই এখানে গড়ে উঠেছিল ডাকঘর, হাসপাতাল, মন্দির, গির্জা।  ১৯৭৪ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে জলসীমান্ত সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী, এরপর থেকেই এই শহর দিয়ে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু তার ১০ বছর আগেই চিরকালের জন্য সবকিছু থেমে যায়। 
কী হয়েছিল ১৯৬৪ সালের সেই অভিশপ্ত দিনটিতে? এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। ফলে বড়দিন ছিল বড় উৎসবের দিন। ২২ ডিসেম্বর। শহরজুড়ে প্রাক বড়দিনের আমেজ। তখন আবহাওয়া বিজ্ঞান আজকের মতো উন্নত ছিল না। তাই তিনদিন আগে থেকেই যে সাগরে এক গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছিল সেটার আঁচ পর্যন্ত পায়নি মানুষ। ফলে আবহাওয়া খারাপ হতে দেখেও বিশেষ আমল দেয়নি কেউই। ধীরে ধীরে সেই নিম্নচাপটি এক দানবরূপী ঘূর্ণিঝড়ের আকার ধারণ করে। হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৮০ কিমি। ২৩ ফুট উঁচু ঢেউ সেদিন গ্ৰাস করেছিল শহরটাকে। চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল জীবনের স্পন্দন।
দুর্ঘটনার সেই দিনটাও শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই। মাঝেমধ্যে অবশ্য সমুদ্র থেকে ঝোড়ো হাওয়া আসছিল। সঙ্গে হালকা বৃষ্টি। কিন্তু এ তো আর নতুন কিছু নয়। এখানে ডিসেম্বরের শেষ মানে ফিরতি বর্ষার সময়। ফি বছর এই দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত মানুষ। তাই আবহাওয়াকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে সকলেই ব্যস্ত ছিলেন উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে। আর তিনদিন পরেই যে বড়দিন! এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান উৎসব। কিন্তু রাত হতেই পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল হাওয়ার বেগ। বৃদ্ধি পেল বৃষ্টিও। এসবের সঙ্গী সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ। এক একটা ঢেউ সৈকত ছাড়িয়ে ক্রমশ জনবসতির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। পালাবার কোনও পথ নেই। প্রবল হাওয়া আর সমুদ্রের পাহাড়প্রমাণ ঢেউয়ের তাণ্ডবে নিমেষের মধ্যে সব শেষ। সুন্দর সাজানো শহরটা রাতারাতি পরিণত হল মৃত্যুপুরীতে। সারারাত ধরে চলল প্রকৃতির তাণ্ডব। সেদিন ঝড়ের মধ্যেই পাম্বান থেকে ধনুষ্কোড়ি আসছিল একটি যাত্রীবাহী ট্রেন। ভিতরে ১১০ জন যাত্রী ও পাঁচজন রেলকর্মী। প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তির গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি কেউই। গোটা ট্রেনটা তলিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রে। ধ্বংস হয়ে যায় রেল সেতুটি। ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ে সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১ হাজার ৮০০ মানুষ। গোটা শহর লণ্ডভণ্ড। একটা বাড়িও আস্ত ছিল না। সবকিছুই প্রায় জলের তলায়। চারদিকে সারি সারি মৃতদেহ। চারদিকে প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ। প্রায় তিনদিন কোনওরকমে বেঁচে ছিলেন জীবিতরা। যাতায়াতের মাধ্যম নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ব্যাহত হয়েছিল উদ্ধারকাজও। 
এই দুর্যোগের মধ্যেও মানুষকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেছিলেন চারজন রেডিও অপারেটর। ঝড়ের মধ্যে শহরে থেকেই খবর দিচ্ছিলেন তাঁরা। শেষমেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত পাম্বান সেতুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন প্রায় ১২ ঘণ্টা। এই কাজের জন্য পরবর্তীকালে তাঁদের পুরস্কৃত করেছিল প্রশাসন। 
দুর্যোগের দু’মাসের মধ্যেই তৈরি হল নতুন পাম্বান সেতু। কিন্তু শহরটা আর নতুন রূপ পেল না। ঝড়ের সেই ভয়াবহ স্মৃতিকে আঁকড়ে আর সেখানে থাকতে চাননি মানুষ। তাই সকলেই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল অন্যত্র। আজ কিছু মৎস্যজীবী পরিবার ছাড়া গোটা শহরটাই শুনশান। চারদিকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। সত্যিই ভূতুড়ে শহর। কাছে গেলে আজও হয়তো চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই ভয়াবহ ঘূর্ণি ঝড়ের ছবি। হবে নাই বা কেন! প্রকৃতির রোষের কাছে মানুষ আজও যে ততটাই অসহায়। তাকে বাগে আনার সাধ্য কারওর নেই!
14Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা