বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
হ য ব র ল
 

ম্যাগেলানের 
পৃথিবী প্রদক্ষিণ
সায়নদীপ ঘোষ

আজকের একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা খুবই সহজ। বিমানে চেপে দেড় দিনের মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু আজ থেকে ৬০০ বছর আগে কাজটা তেমন সোজা ছিল‌ না। স্থল ছাড়া যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল জলপথ। সেটাও যে খুব নিরাপদ ছিল, তাও নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে ছিল জলদস্যুদের ভয়। তবুও সেই সময় অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এক পর্তুগিজ অভিযাত্রিক। নাম ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান। জাহাজে করে ঘুরেছিলেন গোটা পৃথিবী। আবিষ্কার করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিজে বাণিজ্যের জন্য এক নতুন সমুদ্রপথ। প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন যে, পৃথিবী আসলে গোলাকার। অভিযানের শেষটা দেখে যেতে না পারলেও এর কৃতিত্ব যে তাঁরই সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কে ছিলেন এই ম্যাগেলান? জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে ৭০০ বছর আগে। ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্তুগালে জন্মগ্ৰহণ করেন ম্যাগেলান। মাত্র ১০ বছর বয়সেই মা-বাবাকে হারান তিনি।
ছোটবেলা থেকেই ম্যাগেলান বেশ চালাক-চতুর ছিলেন।
তাই সবার অচিরেই একজন দক্ষ নাবিক হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম জীবনে পর্তুগালের রাজার অধীনে নৌ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। চাকরির সুবাদে পর্তুগালের প্রধান বাণিজ্য দ্রব্য যেমন মশলা, সুগন্ধি, রেশম ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন। কিন্তু ভাগ্য তো আর চিরকাল সহায় থাকে না। এসবের মাঝেই ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েলের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। এমনকী ম্যাগেলানের অভিযানের প্রস্তাব পর্যন্ত নাকচ করেন রাজা। উল্টে তাঁর এই রাজকর্মচারীর বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। এই অবস্থায় কালবিলম্ব না করে বিরক্ত ম্যাগেলান দেশের সীমানা অতিক্রম করে চলে আসেন স্পেনে। 
সেখানে তখন রাজার আসনে পঞ্চম চার্লস (পরবর্তীতে নাম বদলে প্রথম চার্লস)। রাজা সাদরে তাঁকে গ্রহণ করলেন। পর্তুগালে তখন ম্যাগেলানের পরিচয় একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। তাই আর দেশে ফিরলেন না। থেকে গেলেন স্পেনের সেভিয়ায়। হিস্পানিক রাজপরিবারের প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি হিসেবে ১৫১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লিটের অ্যাডমিরাল নিযুক্ত হন ম্যাগেলান। এছাড়া স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের অন্যতম সর্বোচ্চ সামরিক পদবি কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব সান্তিয়াগো নিযুক্ত হন তিনি।‌ এরই মধ্যে চার্লসের কাছে  বিশ্ব পরিক্রমার প্রস্তাব দেন তাঁর শ্রেষ্ঠ নাবিক। ম্যাগেলানের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন রাজা। ব্যস। এরপর থেকেই বিশ্বের অন্যতম অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন ম্যাগেলান। শুরু হল ইতিহাস রচনার এক নতুন অধ্যায়।‌
ম্যাগেলান বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীর আকার কোনওভাবেই চ্যাপ্টা নয়। আসলে পৃথিবীর আকার যে গোল তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু হাতে কোনও পাকাপোক্ত প্রমাণ ছিল‌ না। তাই তিনি মনে করলেন কেউ যদি কোনও এক স্থান থেকে ক্রমাগত একই দিকে যাত্রা করে তাহলে সে আগের অবস্থানে ঠিক একদিন ফিরে আসবে ।
এই ধারণা থেকেই তিনি রাজার কাছে প্রস্তাব দিলেন যে, পশ্চিমের মহাসাগরীয় জলপথ অতিক্রম করে ক্রমশ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে প্রাচ্যের দেশে যাওয়া সম্ভব। রাজা সহজেই এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। এর পিছনে অবশ্য একটি বড় কারণ ছিল। স্পেন তখন আতলান্তিকের পশ্চিম তীরের দেশসমূহে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ। সেইসঙ্গে ছিল সোনা ও ধনরত্নের লোভ ।
সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর ম্যাগেলান ও রাজার মধ্যে এক চুক্তি হল। চুক্তি অনুসারে ম্যাগেলান পেলেন প্রায় ১০০ টনের বড় পাঁচটি জাহাজ, পর্যাপ্ত রসদ, কামানসহ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও দুই বছরের খাবার। এছাড়াও অভিযান শেষে লাভের এক-তৃতীয়াংশ পাবেন তিনি। সেই সঙ্গে মিলবে অধিকৃত যেকোনও দু’টি দ্বীপের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব।
দেখতে দেখতে এগিয়ে এল অভিযান শুরুর দিন। ম্যাগেলান রওনা হলেন ১৫১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। সেভিল বন্দর থেকে দক্ষিণ আমেরিকার শেষ প্রান্তের খোঁজে এগিয়ে চলল পাঁচটি জাহাজ। জাহাজগুলির নাম যথাক্রমে দি ত্রিনিদাদ, দি কনসেপশন, সান্তিয়াগো, ভিক্টোরিয়া ও সান আন্তনিও। জাহাজ ও ২৭০ জন সাহসী সৈনিককে নিয়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিলেন ম্যাগেলান। প্রথমে ব্রাজিল। তারপর রিয়োদেলাপ্লাতার মোহনা, মোহনা পেরিয়ে আর্জেন্তিনার সেন্ট জুলিয়ান বন্দর। তখনও শেষ সীমায় না পৌঁছনোয় নাবিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিন্তু ম্যাগেলান বিদ্রোহ দমন করে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে চললেন। শাস্তি স্বরূপ জুয়ান ডি কার্তাজেনা, গ্যাংস্টার ডি কুয়েসাদা ও দুই ডি মেন্দোজা নামে তিন আন্দোলনকারীর মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিলেন। বিদ্রোহ মিটিয়ে আবার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল ম্যাগেলান বাহিনী। কিছুদিনের মধ্যে ঘটল বিশাল বিপদ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে একটি জাহাজ ডুবে গেল। দুর্ঘটনায় অবশ্য কোনও প্রাণহানি হয়নি। নাবিকরা সবাই সাঁতার কেটে অন্য জাহাজে উঠে পড়েন। 
১৫২০ সালের অক্টোবরে চারটি জাহাজ পৌঁছল এক সরু সামুদ্রিক প্রণালীর মুখে। সবাই ভাবল, এটাই বুঝি শেষ সীমা। কিন্তু না। প্রায় ১৫০ মাইল অতিক্রম করার পরও সেটি যেন আর শেষ হয় না। ম্যাগেলান নিজের নামেই প্রণালীর নাম রাখেন ম্যাগেলান প্রণালী। পরবর্তীতে আরও প্রায় ১৭০ মাইল অতিক্রম করতেই প্রণালী শেষ হল। কিন্তু তার আগেই বহু নাবিককে নিয়ে সান আন্তনিও ফিরে গেলেন স্পেনে। হাতে রইল মাত্র তিনটি জাহাজ। 
কিন্তু ম্যাগেলান নিজের লক্ষ্যে অবিচল।‌ অতএব অভিযান জারি থাকল। এরই মধ্যে নভেম্বর মাসে ম্যাগেলান এক বিশাল জলরাশির হদিশ পেলেন। সাহস পেলেন পর্তুগিজ অভিযাত্রিক। তিনি বুঝতে পারলেন, এই বিশাল জলরাশি অতিক্রম করলেই গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে‌। এখান থেকে ম্যাগেলান চললেন উত্তর-পশ্চিমে প্রায় হাজার মাইল। সময় লাগল প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি। কিন্তু জাহাজ কোনও ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে পড়ল না। তাই ম্যাগেলান বিশাল এই শান্ত জলরাশির নাম রাখলেন প্রশান্ত মহাসাগর। বিপদ এল অন্য জায়গায়। অতিরিক্ত সময় লাগার কারণে রসদ ও খাবার ফুরিয়ে এল। বাধ্য হয়ে নাবিকরা জাহাজের খোলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর, আরশোলাকে নিজেদের খাদ্য বানাতে শুরু করলেন। এর জেরে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন‌ প্রায় ৩০ জন। কিন্তু নিজের রসদ থাকায় এই যাত্রায় রক্ষা পেলেন ম্যাগেলান।
অবশেষে গুয়াম দ্বীপ হয়ে ১৫২১ সালের মার্চে বসতিপূর্ণ ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছলেন ম্যাগেলান। এতদিন পরে ভালো খাবার পেয়ে সকলে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। অন্যদিকে ম্যাগেলান দ্বীপের একদিক থেকে অন্যদিকে মূলত খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও স্পেনের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেতে থাকলেন। ফিলিপিন্সের প্রভুদের কথায় এরপর তিনি গেলেন কেবু দ্বীপের রাজা হুমাবনের কাছে। ম্যাগেলানের চেষ্টায় রাজা ও রানি দু’জনেই সাদরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন। এসবের মাঝেই ম্যাগেলানের সঙ্গে একটি চুক্তি করলেন রাজা। চুক্তি অনুযায়ী, ম্যাগেলানকে ম্যাক্তান দ্বীপের রাজা লাপুলাপুকে হত্যা করতে হবে‌। হুমাবনের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন তিনি। রওনা দিলেন ম্যাক্তানের উদ্দেশে। 
কিন্তু সেখানে যাওয়ামাত্র বিপদ বাধল। রাজাকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা গেল বিফলে। উল্টে দ্বীপের বাসিন্দারা গেলেন খেপে। বিপদ বুঝে ম্যাগেলান যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হল না। রাজার সঙ্গে যুদ্ধে ১৫২১ সালের ২৭ এপ্রিল নিহত হলেন ম্যাগেলান। উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার শাস্তি হিসেবে মে মাসের একটি উৎসবে অনেককে বিষ খাইয়ে মারলেন হুমাবন। 
ম্যাগেলানের মৃত্যুর পর প্রাথমিকভাবে অভিযানের হাল ধরলেন জুয়ান সেরারা ও দুয়ার্তে বার্বোসা। কিন্তু দেখা গেল সেভিল থেকে রওনা দেওয়া ২৭০ জনের মধ্যে মাত্র ১১৫ জন জীবিত রয়েছেন। তাই তিনটি অবশিষ্ট জাহাজের মধ্যে কনসেপশনকে খালি করে জ্বালিয়ে দেওয়া হল।‌ ১৫২১ সালের নভেম্বরে শেষমেশ মলুকাসে (ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি) পৌঁছলেন তাঁরা। গন্তব্যে আসামাত্র জাহাজে মশলা ও অন্যান্য বহুমূল্য দ্রব্য তোলা হল। একমাস পর স্পেনে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। তখন দেখা গেল, ভিক্টোরিয়া ছাড়া আর কোনও জাহাজ অতটা পথ অতিক্রম করতে পারবে না। তাই ত্রিনিদাদকে পিছনে রেখে দেশে ফেরার যাত্রা শুরু হল। ঠিক ছিল জাহাজটিকে সারিয়ে একটি দল পরবর্তীতে দেশে ফিরবে। কিন্তু সেটা আর হল না। পর্তুগিজরা সেটির দখল নিল। জাহাজে থাকা ব্যক্তিদের বন্দি করা হল।  ১৫২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর গোটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে স্পেনের সেভিল বন্দরে পৌঁছল ভিক্টোরিয়া। শেষ হল তিন বছরের এক বর্ণময় যাত্রা। ইতিহাস বলছে, ২৭০ জনের মধ্যে মাত্র ১৮ জন শেষ পর্যন্ত স্পেনে ফিরতে পেরেছিলেন। মশলা ও অন্যান্য বহুমূল্য সামগ্ৰী পেয়ে স্পেনের রাজা খুশি হলেন বটে কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশের এক-তৃতীয়াংশ নেওয়ার জন্য ম্যাগেলানের পরিবারের আর কেউই জীবিত ছিলেন‌ না। 
এভাবেই বিশ্বের অন্যতম নৌ অভিযানের সমাপ্তি ঘটল। শেষটা ম্যাগেলান দেখতে পারলেন না ঠিকই। কিন্তু সমগ্র পৃথিবীকে গোলাকার পথে পরিভ্রমণ করে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করলেন এই সাহসী নাবিক।

5th     February,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ