বিশেষ নিবন্ধ

মোদি সরকারের গলাবাজির অর্থনীতি
পি চিদম্বরম

ভালো অর্থনীতি হল শান্তশিষ্ট, আর ভালো অর্থনীতিবিদদের অবস্থান তাঁদের নীতি রূপায়ণের ফলাফলের পশ্চাতে। আর্থিক সমীক্ষা, নতুন বছরে সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ এবং অর্থমন্ত্রীর বাজেট (বা অন্তর্বর্তী বাজেট) ভাষণ সরকারি নীতি প্রকাশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলি একত্রে সরকারের উদ্দেশ্যটি সবিস্তারে খোলসা করে দিয়েছে।  
এনডিএ সরকার প্রচণ্ড গলা ফাটিয়ে জানান দিতে পছন্দ করে। এবছর, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ করার সময় মাননীয়া অর্থমন্ত্রী একটি ‘বুলহর্ন’ বেছে নিয়েছিলেন। মিডিয়া আনুগত্যের সঙ্গেই সেই গলাবাজিটাকে করে দিয়েছে আরও চড়া। অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় হতাশার কারণ এই যে, এমন একটি বাজেট আর আলোচনার পরিসর তৈরি করতে পারল না, পরবর্তী দিনটা পেরনোর আগেই তা হাওয়া হয়ে গেল!
ক্লান্ত ও বিরক্ত
আমার তো মনে হয়, দশ বছর যাবৎ এই সরকার একই দাবি এতবার করেছে যে সেসব শুনে শুনে দেশবাসী রীতিমতো ক্লান্ত এবং যারপরনাই বিরক্তও হচ্ছে। তাদের মনে আছে, বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বদলে কী পেলাম আমরা? নতুন কোনও চাকরি এই সরকার দেয়নি। সরকারি দপ্তরগুলিতে পুরনো শূন্যপদে কয়েক হাজার নিয়োগপত্র কিছু যুবক-যুবতীকে দেওয়া হয়েছে মাত্র। এই প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ২০২৩ সালে টেক কোম্পানিগুলিতে কাজ করতেন এমন ২ লক্ষ ৬০ হাজার জন উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতী চাকরি খুইয়েছেন। জনগণ এই প্রতিশ্রুতিও মনে রেখেছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরকার মুফতে ১৫ লক্ষ টাকা জমা দেবে বলেছিল। ভারতে এবং বিদেশে লুকিয়ে রাখা হিসাববহির্ভূত অর্থ বা সোজা কথায় ‘কালো টাকা’ উদ্ধার করার পরই দেশবাসীর হাতে তাদেরই হকের পাওনা ফেরানো হবে। দেশবাসী আরও জানে যে, প্রতারণায় অভিযুক্ত যেসব লোককে দেশ ছেড়ে পালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তারা নতুন দেশের আশ্রয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে। গত দশবছরে তাদের কাউকেই ভারতে ফেরানো হয়নি। মানুষ এটাও ভোলেনি, তাদের এই বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে—২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং প্রতিটি পরিবার পাবে নিজের ঘর। এছাড়া ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে ভারত হয়ে উঠবে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি। দেশের মানুষ সেদিন অর্থমন্ত্রীর দাবি শুনে একেবারে বিমোহিতই হয়ে গিয়েছিল।
কিছু উদাহরণ—
অর্থমন্ত্রী: এগুলো এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রকৃত আয় বাড়িয়েছে।
বাস্তবে: পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের (পিএলএফএস) তথ্য এবং আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির তরফে তৈরি স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া রিপোর্ট অনুসারে—নিয়মিত শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক বা দিনমজুর ও স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকৃত মজুরি ২০১৭-১৮ এবং ২০২২-২৩ সালের মধ্যে বস্তুত একটা জায়গাতেই আটকে রয়েছে। 
অর্থমন্ত্রী: ... ২৫ কোটি মানুষকে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করেছে সরকার।
বাস্তবে: রাষ্ট্রসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) অনুসারে, দারিদ্র্যমুক্ত মানুষের সংখ্যা ইউপিএ আমলে সাড়ে ২৭ কোটি এবং বর্তমান এনডিএ জমানায় ১৪ কোটি।
অর্থমন্ত্রী: পিএম-কিষান সম্মান যোজনায় প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকসহ ১১ কোটি ৮০ লক্ষ কৃষককে প্রতিবছর প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
বাস্তবে: গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সুবিধাভোগী কৃষকের সংখ্যা ৮ কোটি ১২ লক্ষে নেমে এসেছে। জমির মালিকদের টাকা দেওয়া হয় কিন্তু ভাগচাষিরা অর্থাৎ যাঁরা অন্যের জমিতে চাষ করেন তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
অর্থমন্ত্রী: ৭টি আইআইটি, ১৬টি ট্রিপল-আইটি, ১৫টি এইমস এবং ৩৯০টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে।
বাস্তবে: গত ২২ মার্চের হিসেবে ‘শূন্যপদ’ ছিল—আইআইটিগুলিতে ৯,৬২৫, ট্রিপল-আইটিগুলিতে ১,২১২ এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ২২,১০৬। অন্যদিকে ২০২২ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত—দিল্লির এইমসে ফ্যাকাল্টি এবং রেসিডেন্ট পদ শূন্য ছিল ১,২৫৬টি। অন্য ১৯টি এইমসে শূন্যপদের সংখ্যা ছিল ৩,৮৭১টি।
অর্থমন্ত্রী: পিএম মুদ্রা যোজনা আমাদের যুবকদের বাণিজ্যিক উদ্যোগ আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ২২ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে। তাতে উপকৃত হয়েছেন মোট ৪৩ কোটি যুবক-যুবতী। 
বাস্তবে: এসব ঋণের এক-একটির গড় পরিমাণ ৫২,৩২৫ টাকা। এই ঋণগুলিকে শিশু (৮৩ 
শতাংশ), কিশোর (১৫ শতাংশ) ও তরুণ (২ শতাংশ) এমন তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হলে, এটাই স্পষ্ট হয় যে প্রদত্ত ঋণের বেশিরভাগই ‘শিশু’! প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে সহজ যে অঙ্কটা সামনে আসে তা হল—৩৫ কোটি ৬৯ লক্ষ ‘শিশু’ ঋণগ্রহীতা সর্বমোট ৯ লক্ষ কোটি টাকা পেয়েছেন। তার মানে গড় ঋণের আকার মাত্র ২৫,২১৭ টাকা। মাত্র ২৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে কী ধরনের ব্যবসা শুরু করা এবং চালানো সম্ভব?
অর্থমন্ত্রী: পণ্য ও পরিষেবা করই ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান মার্কেট, ওয়ান ট্যাক্স’ বা ‘এক জাতি, এক বাজার, এক কর’ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সফল হয়েছে।
বাস্তবে: যদি এমন একটি কর থাকে, যার বিরোধিতায় সমস্ত ব্যবসায়ী-কারবারি একজোট হয়েছেন সেটা হল জিএসটি। জিএসটি আইনটি ভয়ানকরকমে ভুলে ভরা। এটি ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও শোষণের একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
অর্থমন্ত্রী: দেশে মুদ্রাস্ফীতিকে ‘পলিসি ব্যান্ড’-এর মধ্যে বেঁধে রাখতে সাহায্য করেছে ‘প্রোঅ্যাকটিভ ইনফ্লেশন ম্যানেজমেন্ট’ বা সক্রিয় মুদ্রাস্ফীতি ব্যবস্থাপনা।
বাস্তবে: পলিসি ব্যান্ড বলতে সরকার যেটা বোঝে আর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যেটা বোঝায় তা এক নয়। মুদ্রাস্ফীতিকে ২ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ করছে আরবিআই। তখন সরকার মুদ্রাস্ফীতির ৪ থেকে ৬ শতাংশের উচ্চ সহনশীলতার সীমা ‘টেস্ট’ করছে। ২০১৯-২৪ সাল—এই পাঁচবছরে গড় সিপিআই (কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স) মুদ্রস্ফীতি হয়েছে ৫.৬ শতাংশ। উল্লেখ্য, তার মধ্যে ঘটেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮.৭ শতাংশ, দুধ ৫.০৭ শতাংশ, ফল ১১.৪ শতাংশ এবং শাকসব্জি ২৭.৬৪ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী: আমাদের সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক একটি নীতি হল—মাইক্রো, ছোট ও মাঝারি শিল্প-ব্যবসার (এমএসএমই) জন্য সময়মতো পর্যাপ্ত অর্থ, প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তি ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যই হল—এমএসএমই সেক্টরের দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি এবং তাদেরকে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলা। 
বাস্তবে: সরকারি সাহায্য-সহানুভূতি না পেয়ে, মহামারীর বছরগুলিতে কয়েক হাজার এমএসএমই সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকার ব্যাঙ্কঋণে ৩ লক্ষ কোটি টাকার ‘লোকসানের গ্যারান্টি’-কে কৌশলে পাল্টে দিয়েছিল ৩ লক্ষ কোটি টাকার ‘ব্যাঙ্কঋণ’-এ। যতটুকু তথ্য হাতে এসেছে তার ভিত্তিতে, বলা যায় যে—সেই ব্যাঙ্কঋণও বাস্তবে দেওয়া হয়েছিল মাত্র ২ লক্ষ কোটি টাকার মতো।  
অর্থমন্ত্রী: ২০১৩-১৪ সাল থেকে হিসেব নিলে সি-ফুড বা সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বাস্তবে: অঙ্কটি ৩০,৬২৬ কোটি থেকে ৬৪,৯০২ কোটি টাকা হয়েছে—অর্থাৎ ৯ বছরে হয়েছে দ্বিগুণ, তাও বর্তমান ভারতীয় মুদ্রামানে। মার্কিন ডলারের হিসেবে এই বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ৬০ শতাংশ। ৫০১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভদ্রস্থ ৫.৪ শতাংশ কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট বা বার্ষিক চক্রবৃদ্ধি হারে (সিএজিআর) হিসেব করলেও অঙ্কটা এরকম দাঁড়ায়। 
অসংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: কানের কাছে এমন তারস্বরে লাগাতার চেঁচালে কিন্তু মানুষ বধিরও হয়ে যেতে পারে।
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মতামত ব্যক্তিগত
5Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা