কেউ হয়তো বলতে পারেন, “যদি ধরে নেওয়া যায় যে, এই রকম উচ্চ অবস্থার মহাপুরুষেরা এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবার পূর্বেও ছিলেন তাতে আমাদের মতো সাধারণ লোকের কি এসে যায়?” এ বিষয়ে বেদান্তের উত্তর এই, আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে যে আত্মা রয়েছেন তিনি জন্ম ও মৃত্যুর অতীত, কিন্তু অজ্ঞানবশতঃ আত্মা ভোগ বাসনায় দেহের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। অজ্ঞানীর পক্ষে জীবন শেষ হয়ে গেলেই শরীরের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু আত্মা বার বার নতুন নতুন দেহে ফিরে আসে যতদিন না তার নির্বাসনা বোধ হয়—এইটিই জ্ঞানোন্মেষের পূর্বাবস্থা। আর এই জ্ঞানই জীবকে জন্ম-মৃত্যু-চক্রের পারে নিয়ে যায়। আমাদের আচার্যগণ বলেছেন যে, মনুষ্য-জন্ম অতি দুর্লভ। এই জীবনেই আমাদের পূর্ণতা ও সত্য উপলব্ধির সুযোগ দেওয়া আছে। কারণ শুধু অবতার ও সিদ্ধ মহাপুরুষগণ নয়, আমাদের ন্যায় সাধারণ মানুষও সেই একই ঈশ্বরের বিভিন্ন প্রকাশ। প্রকাশে তারতম্য আছে, তাতে সন্দেহ নেই, তবে ঈশ্বর সত্তা সর্বত্র একই। সমুদ্রের তুলনা দেওয়া হয়েছে, ঢেউ ও বুদ্বুদ্—বস্তু হিসাবে এক, কেবল প্রকাশে ভিন্ন। স্বামী বিবেকানন্দ বার বার বলেছেন: প্রতিটি আত্মাতেই ঐশ্বরিক সম্ভাবনা রয়েছে, অন্তরের এই ঈশ্বরীয় ভাবকে প্রকাশ করাই জীবনের লক্ষ্য।
অন্তরের এই ঈশ্বরভাব সম্বন্ধে স্বামীজী অন্যত্র বলেছেন: “...আমাদের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা মুক্ত ও নিত্য। কিন্তু তা শরীর নয়, মনও নয়। শরীর প্রতিমুহূর্তে মরছে, মন নিয়ত পরিবর্তনশীল। শরীর একটি সংহত পদার্থ, মনও তাই; অতএব তারা কখনো পরিবর্তনশীলতার পারের অবস্থায় পৌঁছুতে পারে না। কিন্তু এই স্থূল বস্তুর ক্ষণিক আবরণের পারে, এমনকি মনের সূক্ষ্মতর আবরণেরও পারে সেই আত্মা রয়েছেন, যা মানুষের প্রকৃত সত্তা, শাশ্বত ও চিরমুক্ত। তাঁরই মুক্ত-স্বভাব চিন্তা ও বস্তু স্তরগুলির মধ্যে দিয়ে অনুস্যূত হচ্ছে এবং নানারূপে রঞ্জিত হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় বন্ধনহীন অস্তিত্বটি অনন্তকাল ধরে ঘোষণা করে চলেছে। অজ্ঞানের ঘনতম স্তরের আবরণ সত্ত্বেও, তাঁরই অমরত্ব, তাঁরই আনন্দ, তাঁরই শান্তি, তাঁরই ঈশ্বরত্ব উদ্ভাসিত হয়ে স্বীয় অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। এই ভয়শূন্য, মৃত্যুহীন, মুক্ত আত্মাই প্রকৃত মানুষ...। বন্ধনহীন—এই অস্তিত্ব, এই আত্মা মানুষের এই প্রকৃত স্বরূপ সদা মুক্ত, অবিকারী, সব অবস্থার অতীত, কাজেই এর জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। ‘এই মানবাত্মা অজ, অমর, শাশ্বত ও সনাতন’।”
বিশ্বাস, ভক্তি ও ধ্যানের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। একই আত্মা আমাদের জীবাত্মাকে যেমন উদ্ভাসিত করছে, তেমনি করছে অন্যান্য সকলের জীবাত্মাকে। একই জ্ঞানালোক আমরা সকলে প্রতিফলিত করছি। এক অনন্ত আত্মাই সকল জীবাত্মার মধ্যে প্রকাশিত হন।
স্বামী যতীশ্বরানন্দের ‘ধ্যান ও আনন্দময় জীবন’ থেকে