সংস্কার দোষে মায়া যায় না। অনেক জন্ম এই মায়ার সংসারে থেকে থেকে মায়াকে সত্য বলে বোধ হয়। এক রাজার ছেলে পূর্ব্বজন্মে ধোপার ঘরে জন্মেছিল। একদিন খেলা করবার সময় সমবয়সীদের বলছে, “এখন অন্য খেলা থাক। আমি উপুড় হয়ে শুই, তোরা আমার পিঠে হুস্ হুস্ করে কাপড় কাচ।” সংস্কারের কত ক্ষমতা। এ সংসার তাঁর মায়া। মায়াতে সৎ বা নিত্য অসৎ বা অনিত্য বলে মনে হয়, আবার অনিত্য নিত্য বলে মনে হয়। মায়ার কাজের ভিতর অনেক গোলমাল, কিছু বোঝা যায় না।
কামিনীকাঞ্চনই মায়া। মায়াকে যদি চিনতে পার আপনি লজ্জায় পালাবে। হরিদাস বাঘের ছাল পরে একটা ছেলেকে ভয় দেখাচ্ছিল। যাকে ভয় দেখাচ্ছে সে বল্লে ‘আমি চিনেছি, তুই আমাদের হরে।’ তখন সে হাসতে হাসতে চলে গেল। তিনিই সত্য, আর যা কিছু সব মায়ার কার্য্য।
ঈশ্বর লাভ না করলে ত্রিগুণাতীত হওয়া বড় কঠিন। জীব মায়ার রাজ্যে বাস করে। এই মায়া মানুষকে অজ্ঞান করে রেখেছে। ঈশ্বরকে জান্তে দেয় না। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। মায়াতে নানারূপ দেখাচ্ছে। ঝাড়ের কলম দিয়ে দেখলে নানা রঙ দেখা যায়; বস্তুতঃ কোন রং নাই। তেমনি প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম বই আর কিছু নাই, কিন্তু মায়াতে, অহঙ্কারেতে, নানা বস্তু দেখাচ্ছে। জ্ঞানীরা জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থা উড়িয়ে দেয়। ভক্তেরা এ সব অবস্থারই লয়। যতক্ষণ ‘আমি’ আছে ততক্ষণ সবই আছে। যতক্ষণ ‘আমি’ আছে ততক্ষণ দেখে যে, তিনিই মায়া, জীবজগৎ, চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্ব সব হয়েছেন। মায়াবাদ শুকনো। জ্ঞানীর মুখ চেহারা শুকনো হয়। বেদান্ত বিচারে সংসার মায়াময়—স্বপ্নের মত। যিনি পরমাত্মা, তিনি জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি তিন অবস্থারই সাক্ষী স্বরূপ। স্বপ্নও যত সত্য, জাগরণও সেইরূপ সত্য। স্বপ্ন অবস্থাও যেমন মিথ্যা, জাগরণ অবস্থাও তেমন মিথ্যা। আত্মাই একমাত্র নিত্য বস্তু।
কেশব সেনকে বল্লাম যে, ‘আমি’ ত্যাগ না করলে হবে না। ‘আমি’ ঢিপিকে ভক্তির জলে ভিজিয়ে সমভূমি করে ফ্যালো। সে বল্লে, ‘তাহলে মশায় দলটল থাকবে না।” তখন আমি বল্লাম, ‘কাঁচা আমি’, ত্যাগ করতে হয়। ‘পাকা আমি’তে দোষ নাই। ‘কাঁচা আমি’,—বামুন আমি, কায়েৎ আমি, অমুকের ছেলে আমি, অমুকের বাপ আমি, এ সব অবিদ্যার আমি—যাতে বোধ হয় আমি কর্ত্তা, আমি বিদ্বান, আমি ধনবান এই সব। ওতে বন্ধন নিয়ে আসে। আর ‘পাকা আমি’—বালকের আমি, বিদ্যার আমি, ঈশ্বরের দাস আমি, ভক্তের আমি—এইটা খেতে শুতে বসতে সব সময় স্মরণ রাখা। ‘পাকা-আমি’ সমাধির পর লোকশিক্ষার জন্য, রসাস্বাদনের জন্য কাহারও কাহারও থাকে। যেমন বড় আগুন আর তার একটী ফিন্কি। বাহ্যজ্ঞান চলে যায় কিন্তু একটু অহং রেখে দেন। কখন কখন সে ‘আমি’—টুকুও তিনি পুঁছে ফেলেন। এর নাম ‘জড়সমাধি’—নির্ব্বিকল্প সমাধি। ‘কাঁচা আমি’ একটা মোটা লাঠির ন্যায়। সচ্চিদানন্দ সাগরের জল ও লাঠি যেন দুভাগ করছে। কিন্তু ‘পাকা আমি’ জলের উপর রেখার ন্যায়।
কুমারকৃষ্ণ নন্দী সংকলিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ’ থেকে