যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ—এই সূত্রে সর্ব শব্দের ব্যবহার করা হয়নি—অর্থাৎ, সমস্ত বৃত্তির নিরোধের কথা বলা হয়নি। যোগের দুটি প্রকার ভেদ আছে: এক—সম্প্রজ্ঞাত, দুই—অসম্প্রজ্ঞাত। সম্প্রজ্ঞাত যোগের চারটি ভূমি—১। বির্তক, ২। বিচার, ৩। আনন্দ, ৪। অস্মিতা। সম্প্রজ্ঞাত যোগের এই চারটি স্তর একাগ্রভূমিতে সিদ্ধ হয়; কোনও এক বিষয়ে চিত্তকে একাগ্র করলে ধ্যান হয় আর ধ্যান গম্ভীর হলে সমাধি হয়। কিন্তু যে সমাধি অবস্থায় আত্মপ্রত্যয়ের অনুভূতির অভাব থাকে, তাকে যোগ বলা হয় না। সত্ত্ব ও পুরুষের অন্যথ্যাখ্যাতি, অর্থাৎ বুদ্ধিসত্ত্ব ও পুরুষ পৃথক্—এই জ্ঞান হওয়া জরুরি। পুরুষের প্রতি লক্ষ্য রাখা সম্প্রজ্ঞাত যোগে আবশ্যক। যেখানে আত্মজ্ঞান নেই, সেখানে যোগও নেই। বুদ্ধিসত্ত্ব আর পুরুষকে কি প্রকার পৃথক্রূপে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে? চিত্ত শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ—দর্পণের মত, তার নিজস্ব কোন সংস্কার থাকে না—প্রকৃতির ছায়া তাতে পড়ে। যোগের ভাষায় তাকে ‘উপরাগ’ বলে। তখন বোধ উপরক্ত (coloured) হয়ে যায়। এই উপরাগ তিনপ্রকার—১। সত্ত্ব—যাতে সুখবোধ আছে, যখন সবকিছু ভালো লাগে, ২। ভাবনার ব্যমিশ্রতা, ব্যামোহ (confusion) হয়—তখন চিত্ত রজোগুণের দ্বারা সংকুচিত হয়, ৩। তম—বোধের অভাব, জড়তা, নিদ্রাভাব থাকে—এই তিনটি গুণ ওতপ্রোতভাবে থাকে। প্রাকৃত অবস্থায় দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত সত্ত্বগুণের ধারণা করা যায় না, কিন্তু অভ্যাসের দ্বারা সাত্ত্বিক ভাবকে বাড়ানো যেতে পারে। চিত্তে যখন “প্রশান্তবাহিতা” “শান্ত প্রত্যয়” সবসময় থাকে, যাকে গীতাকার বলেছেন “যস্মিন্ স্থিতো নন দুঃখন গুরুণাপি বিচাল্যতে।” –বাইরের সুখ-দুঃখ যখন স্পর্শ করে না, আর যখন এদের কেবল এক বাস্তব সত্য রূপে দেখা যেতে পারে, তখনই মনের শুদ্ধসত্ত্বের অবস্থার প্রাপ্তি হয়। শারীরিক দুঃখের পরিহার করবার চেষ্টাও দরকার হয় না—কেবল বোধরূপে তাকে গ্রহণ করা যেতে পারে। সংবেদনশীলতার অধিকতর তীব্রতার কারণে দুঃখবোধ সুখবোধ হতে বেশী সাধনমার্গে সহায়ক হয়—চৈতন্য মহাপ্রভুর বিপ্রলম্ভের সাধনা এই প্রকারই ছিল। শুদ্ধসত্ত্বের অর্থ হল সুখদুঃখের অতীত এক প্রশান্তবাহিতাকে চিত্তে প্রবাহিত করা, কেবল সূর্য্যবৎ আপনাকেই দেখা, নির্মল চিত্তকে দেখা—এই হল সম্প্রজ্ঞাত অবস্থা। এইরকম করতে করতে চিত্তসত্ত্বের ভিতর এক প্রকারের শক্তি তৈরী হয়, যা হল বিবিধ বিভূতির কারণভূত; এরপর চিত্তসত্ত্ব লোপ হয়ে যায়—কেবল আত্মাকেই দেখে, চিত্ত আর আত্মা একাকার হয়ে যায়—এই হল অসম্প্রজ্ঞাত যোগ। তখন চিত্তের নিরোধ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। যখন বিভূতি প্রকট হয়, তখন চিত্ত নিম্নমুখী হয়ে যায়; তখন চিত্তকে অন্তর্মুখী করবার জন্য শূন্যতার বোধ আবশ্যক হয়—বিরাম প্রত্যয়ের অভ্যাস দ্বারা তার সাধনা করা যেতে পারে। সম্প্রজ্ঞাত যোগের উজ্জ্বলতা স্থায়ী হয় না; আত্মানুভবের সময়ে এক অহং-এর আগ্রহ রয়ে যায়। চিত্ত যখন নিম্নগামী হয় তখন বিরামপ্রত্যয়ের অভ্যাস করা দরকার। এর দ্বারা অহং-এর লয় হয়ে যায়। অগ্নি হতে যেমন কাঠ টেনে নিলে আগুন শান্ত হয়ে যায়, এটি সেই প্রকার। সম্প্রজ্ঞাত যোগের বিভূতি পূর্ণপ্রাপ্তির পথে বাধাস্বরূপ না হয়ে যায়, এইজন্যও অসম্প্রজ্ঞাত যোগের আবশ্যকতা আছে: মৃত্যুর সাথে এর বহু সাদৃশ্য আছে। এই ভাবের আগমনে অপূর্ব বোধের সঞ্চার হয়—মৃত্যুর সময়ে সিদ্ধপুরুষ নিজ জাতিকে (self) সংকুচিত করে আনেন—সেই সময় ব্রহ্মের সাথে লীন হবার এক তীব্র সংকল্প হতে পারে, কিন্তু এটি যোগের বাইরের কথা—উপনিষদে এই ভাব প্রবলরূপে পাওয়া যায়।
শ্রীমৎ অনির্বাণ রচিত ‘অনির্বাণ আলোয় পাতঞ্জল যোগ-প্রসঙ্গ’ থেকে