কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নির্মল হওয়ার ফলে, তাঁকে তাঁর চিন্তা বা কার্যকলাপ পবিত্রীকরণের জন্য কোন রকম প্রচেষ্টা করতে হয় না। কৃষ্ণভাবনার অতি উত্তম স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে, তাঁর মধ্যে সমস্ত দিব্য গুণাবলী প্রকাশিত হয় এবং সব রকম যোগসিদ্ধিগুলি তাঁর লব্ধ হয়। তার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হচ্ছে অহিংসা, যা হচ্ছে একটি অতি মহৎ গুণ। ভক্ত স্বাভাবিকভাবেই অহিংস এবং তাই তাঁকে আর আলাদাভাবে অহিংসার অভ্যাস করতে হয় না। কিছু মানুষ শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিরামিষাশী আন্দোলনে যোগদান করেন, কিন্তু ভক্ত স্বাভাবিকভাবেই নিরামিষাশী। তাঁকে আর আলাদাভাবে নিরামিষাশী হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হয় না। এই রকম বহু দৃষ্টান্ত আছে যার ফলে বোঝা যায় যে, ভক্তকে কৃষ্ণভক্তির অনুশীলন ছাড়া আর কোন কিছু অনুশীলন করতে হয় না, এবং তার ফলে সমস্ত দিব্য গুণাবলী তাঁর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়। অভ্যাস করার মাধ্যমে নিরামিষাশী হওয়া অথবা অহিংস হওয়া জড়-জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে সদ্গুণ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই গুণগুলি তাদের ভগবদ্ভক্তে পরিণত করে না। নিরামিষাশী হলেই অথবা অহিংস হলেই ভগবদ্ভক্ত হওয়া যায় না। কিন্তু ভগবদ্ভক্ত স্বাভাবিকভাবেই নিরামিষাশী ও অহিংস। তাই আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, নিরামিষ ভোজন অথবা অহিংসাই ভগবদ্ভক্তির কারণ নয়।
এই সম্পর্কে স্কন্দ-পুরাণে একটি ব্যাধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, যিনি নারদ মুনির সংস্পর্শে আসার ফলে মহাভাগবতে পরিণত হয়েছিলেন। সেই ব্যাধ যখন শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হলেন, তখন তিনি একটি পিপীলিকাকে পর্যন্ত মারতে চাইতেন না। নারদ মুনির সখা পর্বত মুনি ভগবদ্ভক্তির প্রভাবে সেই ব্যাধের এই আশ্চর্যজনক পরিবর্তন দেখে মন্তব্য করেছিলেন, “হে ব্যাধ! একটি পিপীলিকাকে পর্যন্ত হত্যা করতে তোমার এই অনিচ্ছা আশ্চর্যের বিষয় নয়, কেন না, যে মানুষের হৃদয়ে ভগবদ্ভক্তির উদয় হয়েছে, তাঁর মধ্যে সমস্ত সদ্গুণাবলী আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়। ভক্ত কখনও কাউকে কোন রকম কষ্ট দেন না।”
শ্রীল রূপ গোস্বামী এখানে বলেছেন যে, অন্তঃকরণ ও কার্যকলাপের পবিত্রতা, শম, দম, আদি সমস্ত সদ্গুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভক্তিপরায়ণ পুরুষে প্রকাশিত হয়। শ্রীল রূপ গোস্বামী ভক্তির নয়টি কৃত্য বা অঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হচ্ছে শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদন। ভক্তির এই নয়টি সাধন-অঙ্গের প্রতিটি এতই শক্তিশালী যে, যদি কেউ এর একটিরও অনুশীলন করেন, তবে তিনি অবশ্যই সিদ্ধিলাভ করবেন। যেমন, কেউ যদি ভগবানের কথা শ্রবণের প্রতি অনুরক্ত হন অথবা কেউ যদি ভগবানের নাম কীর্তনের প্রতি অনুরক্ত হন, তা হলে উভয়েই ভগবদ্ভক্তির চরম সিদ্ধি লাভ করবেন। সেই কথা শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কেউ ভক্তি সাধনের একটি, দুটি, তিনটি অথবা সব কয়টি অঙ্গেরই অনুশীলন করতে পারেন এবং পরিণামে ভগবদ্ভক্তির চরম লক্ষ্য শুদ্ধ ভগবৎ-প্রেম লাভ করতে পারেন।
শ্রীল রূপ গোস্বামী বিরচিত ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ থেকে