জপের প্রাথমিক পুরস্কার হল জপে রসবোধে, নামে রুচি, নামের নেশায় পাওয়া। আর জপের অন্তিম পুরস্কার হ’ল, নাম করতে করতে তন্ময় বা আত্মবিস্মৃত হয়ে যাওয়া, নামের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলা, নাম ছাড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কোনকিছু খুঁজে না পাওয়া। নামই ইষ্ট, নামই গুরু, নামই ঈশ্বর, নামই পরব্রহ্ম, নামই সবকিছু— এটি নিরন্তর প্রত্যক্ষ করা, বোধে বোধ হওয়া।
জপ পরিশ্রমের ব্যাপার নয়। বরঞ্চ জপ হ’ল পরিশ্রম অপনোদনের প্রকৃষ্ঠ পন্থা—তা সেই পরিশ্রম শারীরিক বা মানসিক যা-ই হ’ক না কেন। জপের মাধ্যমে আমাদের স্নায়ুগুলি স্নিগ্ধ সতেজ হয়, দেহ বিশ্রাম লাভ করে, মন শীতল ও শান্ত হয়। বহুক্ষণ যাবৎ অন্যবিধ দৈহিক বিশ্রাম নিয়ে এমন কি ঘুমিয়ে যে কাজ হয় না, আধঘণ্টা নিবিষ্ট নামজপ তার থেকে বহুগুণ কাজ দেয়—এটি সহজেই পরীক্ষা করে দেখা যায়। জপের মধ্য দিয়ে একটি মহাসমন্বয়ী অনুভূতি আমার চাই। আমার জপ শুধু আমার জন্য নয় জগতের মঙ্গলের জন্য নিখিল বিশ্বভুবনের কুশলের জন্য। আমার দেহ, আমার প্রাণ, আমার প্রচেষ্টা খণ্ড কিন্তু সেটিকে বিশ্বদেহ, বিশ্বপ্রাণ, বিশ্বপ্রয়াসের সঙ্গে সমন্বিত করার জন্য জপ। জপের সময় এই বিরাট লক্ষ্যটি ভুললে চলবে না।
জপ আমাদের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ করে না; বরঞ্চ নিঃসঙ্গ জপের মধ্য দিয়ে আমি, বিশ্বের সঙ্গে সবচেয়ে সার্থকভাবে মিলিত এবং একীভূত হতে পারি। জপ আমাদের সমন্বয় ও মিলনের প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করে। স্থূলভাবে মানুষের যতটা উপকার মঙ্গল আমরা করতে পারি, নিঃস্বার্থ নিবিষ্ট জপসাধনার দ্বারা সূক্ষ্মভাবে মানুষের অধিকতর মঙ্গল আমরা করতে পারি। প্রার্থনা তো হল চাওয়ার বড়ই স্থূল মূর্ত্তি। জপ হ’ল সমস্যা সমাধানের অতি সূক্ষ্ম অথচ অতি সুনিশ্চিত বিজ্ঞানসম্মত উপায়।
জপ নিরর্থক আবৃত্তি নয়। জপ হ’ল তার দিকে চলা, উজিয়ে মূলের দিকে অভিসার। প্রতিটি আবৃত্তি হ’ল একটি স্পন্দন যে স্পন্দন আমাকে তাঁর স্মরণ-মননে ভরিয়ে তোলে। সেই স্পন্দন সেই স্মরণমনন সেই ইতিবাচক আবৃত্তি সেই ব্যাকুলতা এবং সেই একাগ্রতা না থাকলে জপ কখনই সার্থক হয়ে উঠে না। জপ এভাবে তিলে তিলে আমাকে আমার প্রারব্ধ, সঞ্চিত এবং ক্রিয়মান কর্ম্মের কবল হতে মুক্তি দেয়। এক কথায়, জপ সূক্ষ্মভাবে অথচ দ্রুত গতিতে আমার সকল কর্ম্মক্ষয় করে। আমার সকল খণ্ডত্ব বিদুরিত হয়। আমি ক্রমশ অখণ্ড পরমেশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করি, আমিও ক্রমশ অখণ্ড হয়ে যাই। জপ অলক্ষ্যে সহস্র সহস্র কামনাবাসনার বীজ সমূলে বিধ্বস্ত এবং ধ্বংস করে—যা ভোগ করে শেষ করতে কয়েকশত জন্ম লেগে যেত, তা আমার দু’এক জন্মে বা এমন কি (তপস্যা উদগ্র হলে) এই জন্মেই সম্পন্ন হয়। জপযজ্ঞের হোমাগ্নিতে কত যে রক্তবীজ মহাসুর অলক্ষ্যে বধ হয় তা আমরা টের পাই না। খণ্ডের পুনরাবৃত্তি করতে করতে একদিন খণ্ডত্বের মৃত্যু ঘটে। আমার সকল খণ্ডতা ঘুচে গেলে পর নিমেষে অখণ্ড আমাকে আবিষ্ট করে ফেলে—ঘটের নামরূপসীমা বিনষ্ট হ’লে মহাকাশই আমিরূপী ঘটাকাশকে অঙ্গীভূত করে নেন। চলতে চলতেই একদিন চলার শেষ হয়। স্পন্দিত হতে হতেই একদিন আমাদের হৃৎক্রিয়া শ্বাসক্রিয়া ইত্যাদি বিবিধ প্রাণক্রিয়া নিষ্পন্দ হয়।
অযাচকের ‘জপ’ (২য় খণ্ড) থেকে