হে বিদেহরাজ! যিনি কর্ত্তব্য কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্বান্তঃকরণে আশ্রয়পদ ভগবান্ মুকুন্দের শরণাপন্ন হয়েন, তিনি দেবগণ, ঋষিগণ, প্রাণিগণ, কুটুম্বগণ, মনুষ্যগণ ও পিতৃগণের নিকটে ঋণী হয়েন না এবং তিনি তাহাদের কিঙ্করও হয়েন না। যাহারা কৃষ্ণে রত হইয়া কৃষ্ণকেই স্মরণ করে, রাত্রে উত্থান করিয়াও কৃষ্ণকেই ভাবনা করে, তাহারা হুতাশনে মন্ত্রহুত হবির ন্যায় কৃষ্ণেতেই প্রবিষ্ট হইয়া থাকে।
এই প্রপঞ্চময় নিখিল মায়া জগৎ যাঁহা হইতে জন্মিয়াছে, যাঁহাতে অবস্থান করিতেছে এবং প্রলয়ে যাঁহাতেই আবার বিলয় পাইতেছে, এবং যে প্রপঞ্চ-বিরহিত পরমতত্ত্বকে ধ্যান করিয়া মুনিগণ মোক্ষপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, সেই পুরুষোত্তম নামক নিত্য-নির্ম্মল বিভুকে আমি নমস্কার করি। সর্ব্বত্র অবস্থিত অথচ নির্লিপ্ত, আত্মস্বরূপ, পরাৎপর, নিরীহ, তর্কের অতীত, তেজোরূপ সেই ভগবানকে আমি প্রণাম করি। সম্যক্, জ্ঞানমাত্র, সৎ ও অসতের অতীত, মহান্, সনাতন, শান্ত, ঐশ্বর্য্যশালী, শম, মহৎ ও ব্রহ্মময় সুদুর্ল্লভ তোমাকে বন্দনা করি। তুমি নিজ তেজে সর্ব্বদা মায়ারূপ কপটতা পরাভূতা করিয়া থাক। হে কৃষ্ণ! তোমার নিরাময় চরণ-কমল সর্ব্বদা ভক্তগণ ধ্যান করিয়া থাকেন; প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যগণের ততকাল পর্য্যন্ত সুখ-দুঃখ থাকে, যতকাল পর্য্যন্ত কৃষ্ণের প্রতি তাহাদের মন অর্পিত না হয়। কৃষ্ণে মন অর্পিত হইলে দুরতিক্রমণীয় ভক্তিরূপী খড়্গ মনুষ্যগণের কর্ম্মময় বৃক্ষের মূল উচ্ছেদ করিয়া থাকে। নির্গুণ পরমাত্মা ব্রহ্মের দুইটি রূপ, তাহাদের মধ্যে একটি অক্ষর ব্রহ্ম এবং দ্বিতীয়টি ক্ষর ব্রহ্ম। যাবৎ দৃশ্যবস্তু ক্ষর ব্রহ্ম বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। নির্গুণ ব্রহ্মকেই অক্ষর ব্রহ্ম বলা হইয়া থাকে। যাবদ্ ভূতময় রূপই ব্রহ্মের রূপ।
তত্ত্বদর্শী মুনিগণ সেই সর্ব্বভূতাত্মক ব্রহ্মকেই সগুণ ব্রহ্ম বলিয়াছেন। নির্গুণ ব্রহ্মেতেই সগুণ ব্রহ্ম সংলগ্ন আছেন এবং সগুণ ব্রহ্মেতেই নির্গুণ সংলগ্ন আছেন। ইঁহারা পরস্পর সংলগ্ন আছেন, অথবা তিনি সগুণ-নির্গুণ ভেদে দুই রূপে অবস্থান করিতেছেন; যেমন, মণি ও সূত্র পরস্পর সংলগ্ন অবস্থায় থাকে। যাঁহারা সগুণ ব্রহ্মকে জানিয়েছেন, তাহা হইতেই তাঁহারা নির্গুণ ব্রহ্মকেও জানিতে পারেন। নির্গুণ ব্রহ্মকে জানিতে পারিলে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি সগুণত্ব হইতে নিবৃত্ত হইয়া থাকেন। ততকাল পর্য্যন্ত সগুণ ব্রহ্মকে ধারণ করিতে হয়, যতকাল পর্য্যন্ত নির্গুণ ব্রহ্ম লাভ না হয়। নির্গুণ ব্রহ্মকে লাভ করিতে পারিলে অহং ভাবের নিবৃত্তি হইয়া থাকে। যোগী সমস্ত ব্রহ্মময় দর্শন করিয়া সমস্ত পাপ হইতে মুক্ত হন এবং তখন যোগীর “সোঽহং” “সোঽহং”—এই উত্তম জ্ঞান হইয়া থাকে।
গুণে আসক্ত মন বন্ধনের হেতু, পুরুষোত্তমে মনের গতি মুক্তির সাধক; মনই এই উভয়ের কারণ কথিত হয়। সেই মনকে দূর হইতেই জয় করতঃ সঙ্গরহিত হইয়া পৃথিবীতে বিচরণ করিবে। বিবেকী ব্যক্তি যখন প্রশস্ত অধ্যাত্মযোগে পরাৎপর সাক্ষাৎ ব্রহ্ম আমাকে সর্ব্বগত বলিয়া বিদিত হইবে, তখনই মনের মালিন্য দূর করিতে পারিবে।
সমস্ত ধর্ম্মই বিষ্ণু, সমস্ত কর্ম্মও বিষ্ণু, তিনিই কর্ম্মফল-ভোক্তা; কার্য্যও বিষ্ণু, ইন্দ্রিয়সমূহও বিষ্ণু, তাহা হইতে কিছু অতিরিক্ত এ জগতে নাই। তিনিই বন্ধন, তিনিই বন্ধনকর্ত্তা; তিনিই পাশ, তিনিই সমস্ত পশু; তিনি সকলের জ্ঞাতা, অথচ তাঁহাকে কেহ জানে না; তাঁহাকেই আদ্য পুরাণ-পুরুষ বলিয়া থাকে। পণ্ডিতগণ তাঁহাকেই মহাবিষ্ণু বলিয়া থাকেন, তাঁহাকেই আবার মহাদেবও বলিয়া থাকেন। তিনিই বৌদ্ধগণকর্ত্তৃক পরিবর্জ্জিত শিব বলিয়া কথিত হইয়া থাকেন।
স্বামী শংকরানন্দ সংকলিত ‘রত্নমালা’ থেকে