কৃষ্ণপ্রেম প্রকাশ করে ভক্তের শরীরে যে সমস্ত লক্ষণ প্রকাশিত হয়, তাকে বলা হয় অনুভাব। অনুভাবের ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত হচ্ছে—নাচা, ভূমিতে লুটানো, উচ্চৈঃস্বরে গান করা, আড়মোড়া দেওয়া, উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করা, হাই তোলা, দীর্ঘশ্বাস ফেলা, অন্যের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা, মুখ থেকে লালা ঝরা, উন্মাদের মতো অট্টহাস্য করা, মাথা ঘোরা ও হিক্কা তোলা। এই সমস্ত লক্ষণ সহ যখন ভগবৎ-প্রেমের আতিশয্য দেখা যায়, তখন দিব্য আনন্দ অনুভূত হয়। এই সমস্ত লক্ষণগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলি হচ্ছে শীত ও ক্ষেপণ। হাই তোলা আদি লক্ষণগুলিকে বলা হয় শীত এবং নৃত্য আদি লক্ষণগুলিকে বলা হয় ক্ষেপণ।
নৃত্য করা:গোপীদের সঙ্গে রাস-নৃত্যরত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখচন্দ্র দর্শন করে শিব ডিম্ ডিম্ রবে ডমরু বাজাতে বাজাতে নৃত্য করতে শুরু করেন। দেবাদিদেব মহাদেবকে এইভাবে আনন্দমগ্ন হয়ে নৃত্য করতে দেখে, তাঁর জ্যেষ্ট পুত্র গণেশও তাঁর সঙ্গে নাচতে শুরু করেন।
ভূমিতে লুটানো: শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে বিদুর উদ্ধবকে জিজ্ঞাসা করেন, “হে সখে! অক্রূর কুশলে আছেন ত? তিনি কেবল একজন নিষ্পাপ মহাপণ্ডিতই নন, তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন মহান ভক্তও। আমি নিজে দেখেছি যে, কৃষ্ণপ্রেমে অধীর হয়ে তিনি শ্রীকৃষ্ণের চরণচিহ্নে অঙ্কিত ভূমিতে লুটাচ্ছিলেন।” তেমনই কোন একজন গোপিকা শ্রীকৃষ্ণকে এসে বলেন যে, তাঁর বিরহে কাতর হয়ে এবং তাঁর গলার মালার সুগন্ধে মত্ত হয়ে, তাঁর প্রতি অভিনব অনুরাগবতী রাধারাণী কঠিন ভূমিতে লুটাতে লুটাতে তাঁর কোমল শরীরকে আহত করছেন। উচ্চৈঃস্বরে গান করা: একজন গোপিকা শ্রীকৃষ্ণকে বলেন যে, শ্রীমতী রাধারাণী তাঁর মহিমা কীর্তন করছেন। তাঁর সেই কীর্তন শুনে সখীরা এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন যে, তাঁরা পাষাণের মতো জড় ও অচেতন হয়ে পড়েছেন। আর সেখানকার পাষাণগুলি সেই প্রেমে গলে যাচ্ছে। নারদ মুনি যখন ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তন করছিলেন, তখন তিনি এত উচ্চৈঃস্বরে কীর্তন করছিলেন যে, তা শুনে মনে হচ্ছিল যেন নৃসিংহদেব আবির্ভূত হয়েছেন। তখন সমস্ত অসুরেরা চতুর্দিকে পালাতে শুরু করে। আড়মোড়া দেওয়া: উল্লেখ আছে যে, কখনও কখনও বীণাধারী নারদ মুনি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে গভীর আনন্দে এমন প্রবল বেগে আড়মোড়া দেন যে, তাঁর যজ্ঞোপবীত ছিঁড়ে যায়। উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন: একজন গোপিকা শ্রীকৃষ্ণকে বলেন, “হে নন্দনন্দন, তোমার বাঁশির সুরে শ্রীমতী রাধারাণী এতই ব্যাকুল ও ত্রস্ত হয়ে উঠেছেন যে, রুদ্ধ কণ্ঠে তিনি কুররী পক্ষীর মতো ক্রন্দন করছেন।” শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে চকিত হয়ে, দেবাদিদেব মহাদেব এত উচ্চৈঃস্বরে মহাশূন্যে হুঙ্কার করেন যে, সেই শব্দ শুনে দানবদের বিনাশ হয় এবং ভক্তরা আনন্দে অধীর হয়ে ওঠেন।
শ্রীল রূপ গোস্বামীর বিরচিত ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ থেকে