বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
পরিবেশের সঙ্গে কীভাবে মেশে এই প্লাস্টিকের বিষ?
প্লাস্টিক তাপের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অর্থাৎ, তাপের তারতম্যের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকেরও রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। এই রাসায়নিক পরিবর্তন অথবা বিক্রিয়াই নানা ভাবে পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে। অনেকসময় এই বিক্রিয়ার কুফল সরাসরি মানুষের শরীরেও পরে। যা থেকে ক্যান্সার সহ অন্যান্য মারণ রোগ ছড়ায়।
কীভাবে?
এই যেমন ধরুন রেস্তোরাঁ থেকে প্লাস্টিকের কন্টেনারে আসা খাবার আমরা হামেশাই খাই। এমনকী, চায়ের দোকানে প্লাস্টিকের কাপে গরম চা-ও সাত-পাঁচ না ভেবেই খেয়ে ফেলি আমরা। কিংবা, দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও সেই প্লাস্টিকের বোতলেই দুধ দিয়ে থাকি। আর এখানেই মারাত্মক ভুলটা করি আমরা। এই গরম খাবার বা পানীয় ওই প্লাস্টিকের পাত্রে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বিক্রিয়া ঘটে তা থেকে বিষ বা টক্সিন নিঃসৃত হয়। যা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। মাইক্রোওয়েভে প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করাও ঠিক নয়।
মাইক্রোওয়েভ-প্রুফ প্লাস্টিক কী আদৌ আছে?
সবগুলি মোটেই নয়। কিছু আছে। তবে, কোনও প্লাস্টিকের বক্সই মাইক্রোওয়েভে ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে খাবারে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।
এ তো গেল খাদ্যদ্রব্যকে প্লাস্টিকের ছোঁয়াচ থেকে বাঁচিয়ে রাখার কথা। কিন্তু, পরিবেশে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক কীভাবে ক্ষতি করে?
দেখুন, প্লাস্টিক ‘প্রায় অবিনশ্বর’ বস্তু। পুড়িয়ে বা মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখলেও প্লাস্টিককে সম্পূর্ণ নষ্ট হতে কয়েক দশক পর্যন্ত লেগে যাতে পারে। প্লাস্টিক পোড়ালে তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট তো হয়ই না, উল্টে যে বিষাক্ত হাইড্রো-কার্বন নির্গত হয়, তা বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মিশে জীবজগতের ক্ষতি করে। মানুষের ফুসফুসে এই কার্বন ঢুকলে তা থেকে মারাত্মক অসুখ হতে পারে।
খোলা পরিবেশে প্লাস্টিক ফেলার ক্ষতির দিকগুলি কী কী?
প্রতমত, যত্রতত্র প্লাস্টিক বা তা দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র ফেললে নিকাশিতে সমস্যা তৈরি হয়। বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই বেশি হয়। বাজার থেকে মাছ বা মাংসটা কিনে আনার সময় এইধরনের পলিথিনের ব্যাগ খুব কাজে লাগলেও আদতে যে সেটা কতটা ভয়ঙ্কর তা আমরা ভেবে দেখি না। দ্বিতীয়ত, রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো বহু গবাদি পশু (গোরু, ছাগল) খাবার ভেবে এই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে। যা থেকে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। সমুদ্রেও প্লাস্টিকের দূষণ সেখানকার স্বাভাবিক জীববৈচিত্র সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে। বর্ষাকালে প্লাস্টিকের আবর্জনায় নিকাশি নালা আটকে শহর বানভাসি হলে সরকার ও জনতা একে অপরকে দোষারোপ করেন। কিন্তু, তাতে লাভ কিছু হয় না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে টুথব্রাশ মুখে দেওয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় মশারি টাঙানো পর্যন্ত আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে প্লাস্টিক। এই পরিস্থিতিতে প্লাস্টিক সম্পূর্ণ বর্জন করা কী আদৌ সম্ভব?
না, আমি তা মনে করি না। আমি প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ তুলে দেওয়াকে সমর্থন করি না। পেট্রোলিয়ামের একটা বাইপ্রোডাক্ট হল প্লাস্টিক। আধুনিক মানবসমাজে এর উপযোগিতা অনস্বীকার্য। জলভর্তি লোহার বালতি তোলা থেকে আপনি তুলনায় হাল্কা প্লাস্টিকের বালতিই ব্যবহার করতে চাইবেন।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
গলদটা হল ব্যবহার আর তা নিষ্পত্তির পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, কোন প্লাস্টিক ব্যবহার করব আর কোনটা করব না, সেটা আগে বুঝতে হবে। এরপর আসে সেই প্লাস্টিকের নিষ্পত্তি বা ডিসপোজালের বিষয়টি। খোলা মাটিতে প্লাস্টিক ফেলার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে ভূগর্ভস্থ জলে। কারণ, বৃষ্টির জলকে এই প্লাস্টিক মাটির তলা পর্যন্ত পৌঁছতেই দেয়। এর পাশাপাশি প্লাস্টিক মাটির তাপমাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত যা তাপমাত্রা হওয়া উচিত, তার থেকে অন্তত ৪-৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় প্লাস্টিক। ফলে কোনও উদ্ভিদ বা প্রাণীর বেড়ে ওঠার জন্য যে আদর্শ তাপমাত্রার প্রয়োজন, প্লাস্টিক তাকে নষ্ট করে দেয়। এতে জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিকল্প কিছু আছে কী?
সলিউবল (যা জলে দ্রবীভূত হয়) বা বায়ো-ডিগ্রেডেবল ইত্যাদি নানান ধরনের প্লাস্টিক আবিষ্কৃত হয়েছে। যেগুলি সত্যি পরিবেশে কোনও কুপ্রভাব ফেলে না। কিন্তু, বাজারে এইধরনের প্লাস্টিক তেমন সহজলভ্য নয়। তাছাড়া এর দামও তুলনায় অনেকটাই বেশি। ইন্টারনেটের দু’-একটি ওয়েবসাইট থেকে আপনি এগুলি কিনতে পারবেন। কিন্তু, যতক্ষণ না গণহারে এর উৎপাদন হচ্ছে এবং এর দাম নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে আসছে ততক্ষণ এগুলিকে বিকল্প হিসেবে ধরার ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে।
তাহলে এখন কী নিয়ে বাজারে ঢুকব আমরা?
আমাদের দেশে কিন্তু অনেক আগে থেকেই চট বা কাপড়ের ব্যাগের চল রয়েছে। বিশেষ করে বাঙালি সমাজে আগেকার দিনে মা-মাসিরা কাপড় কেটে সেটা সেলাই করে মাছ-মাংসের জন্য আলাদ ব্যাগ তৈরি করতেন। সেই রেওয়াজই আবার নতুন করে চালু করার সময় এসেছে। এছাড়াও কাগজের ঠোঙা বা বাটার পেপারও (যে কাগজে মাখন মুড়ে রাখা হয়) প্লাস্টিকের ভালো বিকল্প হতে পারে।
কিন্তু, এর সঙ্গে সচেতনতা কতটা জরুরি?
অনেকটাই। আমার মতে, পুরো বিষয়টাই দাঁড়িয়ে আছে সচেতনতার উপর। যেমন ধরুন, এই মুহূর্তে বায়ো ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক মানুষ কেনা শুরু করলেন, আবার সেই প্লাস্টিক তারা আগের মতোই রাস্তাঘাটে, নদীতে-পুকুরে ফেলতে শুরু করলেন। তাহলে কিন্তু ঘুরে-ফিরে আমরা সেই আগের জায়গাতেই ফিরে আসব। মানছি, এই প্লাস্টিক পরিবেশের ক্ষতি করে না। কিন্তু, এদেরও সম্পূর্ণ বিনষ্ট হওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। ততদিন পর্যন্ত ওই প্লাস্টিক যদি খোলা পরিবেশে পড়ে থাকে, তাহলে তার প্রভাব পরিবেশের উপর কতটা পড়বে, সে সম্পর্কিত গবেষণা কিন্তু এখনও তেমন হয়নি। মাটিতে থাকা বিভিন্ন উপকারি ব্যাক্টেরিয়াদের এই বায়ো ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ক্ষতি করবে কিনা, সেটাও এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। এর আবিষ্কর্তারা শুধু বলছেন, সাধারণ প্লাস্টিকের মতো এই প্লাস্টিক ‘প্রায় অবিনশ্বর’ নয়। এটা মাটিতে সম্পূর্ণ মিশে যায়। কিন্তু, মাটিতে সম্পূর্ণ মিশে গেলেই পরিবেশের উপর তার কোনও কুপ্রভাব পড়বে এমনটা আমি বলতে পারব না। তাই, প্লাস্টিকের বিকল্প খোঁজার চেয়ে বরং নিজেদেরকে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেই সঙ্গে দরকার রাষ্ট্র বা সরকারের সদিচ্ছার। বিদেশে যেমন প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে, আমাদের শহরেও সেটা চালু করা যেতে পারে।