উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
পুতুলের মতো প্রিয়াঙ্কাকে মায়ের কোলে দেখেই দৌড়ে গিয়েছিল রাহুল। সেও তখন ছোট্টটি। মা কয়েকদিন ছিল না বাড়িতে। ‘মাম্মি’, ‘মাম্মি?’ জানতে চেয়েছিল রাহুল। ঠাকুরমা ইন্দিরা বুঝিয়েছিলেন, মা গেছে তোমার জন্য খেলার সঙ্গী আনতে। আর সেকথা সত্যি হতেই মা যেদিন স্যার গঙ্গারাম হাসপাতাল থেকে ছোট্ট বোনটিকে বাড়িতে নিয়ে এল, দৌড়ে গিয়ে সে কী আদর!
পিঠোপিঠি দুই ভাইবোন। দু বছরেরও কম ফারাক। রাহুলের জন্ম ১৯৭০ সালে। ১৯ জুন। বোন প্রিয়াঙ্কা ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি। দুজনেই জন্মেছে দিল্লিতে। একই হাসপাতালে। ভারতের অন্যতম ব্যস্ত এবং প্রভাবশালী পরিবারে জন্ম। তা সত্ত্বেও দাদি, মা, বাবা, দাদা, বোন মিলে ব্যক্তিগত পারিবারিক পরিসরটা ছিল অত্যন্ত ঘরোয়া। দুষ্টু একটু বেশিই ছিল প্রিয়াঙ্কা। জেদিও। তবে মিষ্টভাষী। আর দাদা রাহুল হাসিখুশি। দাদাবোনের ভারী ভাব। আজও যার বিচ্যুতি হয়নি। নষ্ট হয়নি সম্পর্ক। বরং বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও গভীর হয়েছে। ভাইবোনের সম্পর্ক পরিণত হয়েছে বন্ধুত্বে। পিঠোপিঠি দুই ভাইবোন যেমন ঠাকুরমার সংস্পর্শে কাটিয়েছে ছোটবেলা, একইভাবে ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াণ নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে রাহুল প্রিয়াঙ্কাকে। দাদির মৃত্যুর খবরে আড়ালে একসঙ্গে অঝোরে কেঁদেছে ভাইবোন।
ছোটবেলায় ঠাকুরমার খুব নেওটা ছিল দুজনে। ‘দাদি, এখানে এটা কী?’ ‘কী খায় এরা?’ ‘কী করে চলে?’ ‘আচ্ছা ওদেরও কি তোমার মতো দাদি আছে?’ ....এরকম হাজারো প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো ‘আয়রন লেডি’ ইন্দিরাকে। রাইসিনা হিলের দপ্তর থেকে ফিরতে দেরি হলে অপেক্ষা করত কখন আসবে দাদি? মা সোনিয়াকে জবাব দিতে হতো, এই তো আসবেন। এক্ষুনি। এক নম্বর অশোক রোডের বাংলোর বসার ঘরে রাখা ল্যান্ডফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠলেই দু ভাইবোনেই ছুটত একসঙ্গে। কে আগে ধরবে! বাংলোর গেটে সাদা অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা ঢোকার শব্দ শুনলেই দুজনেই কখনও দৌড়ে গিয়ে বসে পড়ত ডাইনিংয়ের লাগোয়া ঘরটায় রাখা ছোট্ট টেবিলটায়। কখনও লুকোত পর্দার আড়ালে। ঠাকুমাও জানতেন ওদের দুষ্টুমি। অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল নাতি নাতনির আবদারে।
তাই বাইরে তিনি ব্যক্তিত্বময়ী প্রধানমন্ত্রী হলেও নাতি-নাতনির কাছে ছোট্টটি। ওদের মতোই। তাই দরজা দিয়ে দালানে ঢুকেই মাটিতে চলতে থাকা পুচকি পায়ের পোকাগুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে জবাব দিতে হতো তারা কী খায়। কী করে চলে। ওদেরও তাঁর মতো ঠাকুরমা আছে কি না ইত্যাদি কৌতূহলের। নয়তো পর্দার পিছনে নাতি লুকিয়ে আছে জেনেও ভান করতে হতো, কিছুই জানেন না। লুকোচুরি খেলার মতো করে কয়েক মিনিট এদিক-ওদিক খুঁজেই পর্দার আড়াল থেকে বের করতেন তাঁকে। রাহুল নিজেই শুনিয়েছেন এইসব গল্প।
দূর থেকে মায়ের গায়ে লেপটে বোন প্রিয়াঙ্কা দেখত দাদার দস্যিপনা। ছোট্ট টেবিলটার দু পাশে বসত ভাই বোন। মাঝে ঠাকুরমা। বিরোধীদের প্রশ্ন, দেশ চালানোর মতো গুরুদায়িত্ব সামলে এসে খুদে দুই নাতি-নাতনির কাছে ফের নতুন পরীক্ষায় পড়তে হতো ইন্দিরা গান্ধীকে। ‘তোমরা খেয়ে নিয়েছো?’ জিজ্ঞেস করতেন ঠাকুরমা। ওরাও মাথা দুলিয়ে কখনও বলত হ্যাঁ। আর যেদিন হতো না, সেদিন উত্তর দিত ‘না।’ আর তারপরেই প্রশ্ন। ‘আচ্ছা দাদি, খেলে কী হয়?’ ‘কেন খেতে হয়?’ জবাব চাইত দাদাবোন। দাদিও ওদের সমবয়সি হয়ে আদুরে স্বরে উত্তর দিতেন। বলতেন, খেলে শরীরে রক্ত হয়। খাবার খেলে শক্তি হয়। বুদ্ধি বাড়ে। নাহলে পেট ব্যথা করে। শরীর খারাপ হয়।.... গল্পচ্ছলে খাবার নিয়ে ওই বোঝানোর মধ্যেই সোনিয়া দিতে আসতেন ছেলেমেয়ের ডিনার। আর ঠাকুরমা সেটি নিয়ে খাইয়ে দিতেন নাতি-নাতনিকে। সামনের দিকে ঝুঁকতেই নাতি রাহুল আচমকাই চোখ থেকে খুলে নিত চশমা। পরে নিত নিজের চোখে। তারপর ঠাকুরমার মতো করে নকল। ....খেলে রক্ত হয়। বুদ্ধি বাড়ে......।
এভাবেই পিঠোপিঠি দুই ভাইবোনের ছোটবেলাটা কেটে গিয়েছে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। বাবা রাজীব গান্ধীরও খুব আদরের ছিল রাহুল প্রিয়াঙ্কা। শীতকালে বাড়ির লনেই হতো পিকনিক। নয়তো কাছেই লোধি গার্ডেনে। পোষা দুটি বিদেশি কুকুর ছিল ওদের। স্কুল থেকে ফিরে দুই ভাইবোনে তাদের সঙ্গে চলত খেলা। লেজ ধরে টান মারলেও কিচ্ছু করত না পোষ্য দুটো।
ছোটবেলায় ভাইবোন দুজনে একই স্কুলে পড়তেন। নয়াদিল্লির মডার্ন স্কুলে। পরে রাহুল চলে গেলেন উত্তরাখণ্ডের দুন স্কুলে। প্রিয়াঙ্কা দিল্লির কনভেন্ট জেসাস অ্যান্ড মেরি। পরিবারে পর পর অঘটন ঘটে যাওয়ায় কিছুদিন বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা। নিরাপত্তার কারণে। পরে বড় হয়ে রাহুল গান্ধী নয়াদিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। কিন্তু এক বছর পরেই বিদেশ। ফ্লোরিডার রোলিনস কলেজ। সেখান থেকে বিএ। তারপর কেমব্রিজের ট্রিনিটিতে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে এমফিল। প্রিয়াঙ্কা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সায়কোলজিতে এমএ। পরে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে পড়েছেন। রপ্ত করেছেন বৌদ্ধ বিশ্বাস। প্রতিদিন সকালে এক ঘণ্টার ওপর ধ্যান, যোগাভ্যাস করেন প্রিয়াঙ্কা। আর সেটাই তাঁকে ভিতর থেকে শান্ত থাকার শক্তি জোগায়। কয়েক বছরের তফাতে আচমকা অঘটনের পরেও দুঃখ, শোক সামাল দেয়।
যে দুই ব্যক্তিত্ব ছিল ওদের প্রিয়, একটু বড় হতে না হতেই সেই দিনগুলো যে হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে! বাংলোর মধ্যেই দেহরক্ষীর বন্দুকের গুলি প্রাণ কেড়ে নিল ঠাকুরমা ইন্দিরার। তামিলনাড়ুতে ভোটের প্রচারে মানববোমা ছিনিয়ে নিল রাজীবকে। আচমকাই নিষ্পাপ শিশু কিশোর মন দুটি কেমন যেন বড় হয়ে গেল! মনের মধ্যে উথাল-পাতাল হলেও প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা সহ্য করেছে দুই ভাইবোনই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরপর বয়ে গেল ঝড়। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দাদি। ১৯৯১ সালের ২১ মে ড্যাডি। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবারে ঘটে গেল অঘটন। আর তারই ছবি স্মৃতিতে শিউরে ওঠায় কংগ্রেস নেতা, কর্মীরা যখন সোনিয়াকে দলের হাল ধরতে অনুরোধ করলেন, সবার আগে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল প্রিয়াঙ্কা। দাদা রাহুলকে বলেছিল, মাকে বল, যেন কিছুতেই রাজি না হয়। নাহলে ওরা মাকেও কেড়ে নেবে! ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বহুদিন পর্যন্ত রাজনীতি থেকে সরে থেকেছেন সোনিয়া।
ভাইবোনে সম্পর্ক অত্যন্ত অন্তরের। দাদা রাজনীতিতে এসেছে আগে। এমপি হয়েছেন। এতদিন আড়ালে থাকলেও এখন প্রিয়াঙ্কাও রাজনীতিতে। দাদার জন্যই প্রকাশ্যে আসা। দিনভর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকলেও রবিবার ব্রেকফাস্ট একসঙ্গে। এক টেবিলে। কখনও মা সোনিয়ার ১০ নম্বর জনপথ রোডের বাংলোয়। নয়তো লোধি এস্টেটে প্রিয়াঙ্কার বাড়ি। টোস্ট, গ্রিন স্যালাড। চা কিংবা কফি। মরশুম অনুযায়ী। ভাইবোন দুজনেই নিরামিশ পদ বেশি পছন্দ করেন বটে, তবে তান্ডে কাবাব প্রিয়াঙ্কার বেশ পছন্দ। রাহুলকে মাঝেমধ্যে মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য জোর করেন প্রিয়াঙ্কা। ‘কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই শরীরে মেদ লেগে যাওয়ার ভয়ে তা এড়িয়ে যাই। তবে রাখির দিন আপত্তি করি না।’ হাতে সরু রাখি পরিয়ে মিষ্টিমুখ করান প্রিয়াঙ্কা। পরের বছর পর্যন্ত হাতে থাকে সেই রাখি। রাহুল নিজেই দিয়েছেন এই তথ্য।
রাহুল প্রিয়াঙ্কা বেড়াতে যান একসঙ্গে। কখনও মাকে নিয়ে গোয়া। কখনও দেখে আসেন হিমাচলে তৈরি হওয়া ব্রিটিশ আর্কিটেকচারের বাড়িটা। একসঙ্গে যান ইতালিতে বৃদ্ধা নানিকে দেখতে। রাহুল গান্ধী যেখানকার এমপি, উত্তরপ্রদেশের আমেঠিতে দাদাকে পাশে বসিয়ে প্রিয়াঙ্কা চালান গাড়ি। ভোটের সময় নয় অবশ্য, অন্য সময়। ভাইবোন একসঙ্গে ক্রিকেট গ্যালারিতে উপভোগ করেন চার ছক্কা। দাদা সংসদে বক্তৃতা দিলে ভিজিটর গ্যালারিতে অবশ্যই থেকে সমর্থন জোগান প্রিয়াঙ্কা। রাহুলের যাবতীয় খুঁটিনাটি সামলান বোনই। রাহুল গান্ধী এখনও বিয়ে করেননি। বোনের বিয়ে হয়েছে ১৯৯৭ সালে। ব্যবসায়ী রবার্ট ওয়াধেরার সঙ্গে।
ওদের মেয়ে মিরায়া আর ছেলে রিহানও মামার খুব আদরের। ওদের মধ্যে অনেক সময়ই নিজেদের ছোটবেলা খোঁজেন রাহুল প্রিয়াঙ্কা। নেহরু গান্ধীর মতো প্রভাব প্রতিপত্তির পরিবারে জন্ম, বেড়ে ওঠা হলেও ব্যক্তিগত জীবনের জন্য সময় সামলে রাখেন ভাইবোন। বড় হয়ে গেলেও এখনও আগের মতোই একে অপরের পাশে থাকেন। রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা, প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার নেপথ্য মনিটর বোন প্রিয়াঙ্কাই। দাদার কোনও অনুষ্ঠান কীভাবে পরিবেশন হবে, কী বলবেন রাহুল, তার প্রায় সবই ঠিক করে দেন প্রিয়াঙ্কা।
রাজনীতির অন্য ব্যস্ততা যখন কম থাকে, তখন ফ্যামিলি অ্যালবাম, দাদির স্মৃতিসুধায় আজও মজে যান দুই ভাইবোন। প্রিয়াঙ্কা নিজেও ছবি তুলতে ভালোবাসেন। অ্যালবামের পাতায় কখনও লোধি গার্ডেন, পোষা কুকুর দুটোর ছবিতে চোখ যায় আটকে। রাজহাঁসকে খাবার দিচ্ছেন দাদি। নয়তো ভাইবোনকে ঢেঁকির মতো খেলনা গাড়ির দুদিকে দুজনকে বসিয়ে দোল দিচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধী। কিংবা ভাইবোনের গলা জড়ানো ছোটবেলার সেই ছবিটা। যেখানে বয়েজ কাট চুলের প্রিয়াঙ্কাকে দেখে মনে হয় রাহুলের দাদা। হ্যাঁ দাদা। রাজীব গান্ধীর নির্বাচনী কেন্দ্র আমেঠিতে যখন মা বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় যেতেন প্রিয়াঙ্কা, অনেকেই ভুল করে তাঁকে ডাকত ‘ভাইয়াজি’ বলে। মজা পেয়ে যা রিপিট করতেন রাহুলও। রেগে যেতেন প্রিয়াঙ্কা। ছোট থেকে যত বড় হয়েছেন, ততই নিজেদের মধ্যে ভাইবোনের সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হয়েছে। রাহুলের মধ্যে বাবা রাজীবের অনেক গুণ দেখতে পান প্রিয়াঙ্কা। নিজেই বলেছেন, দেশের বিভিন্ন সংস্থাকে মজবুত করা ওঁর স্বপ্ন। বাবার মতো। রাজনৈতিক ময়দানে যখন নানা সমালোচনা আর কটাক্ষের মুখোমুখি হন রাহুল, চোখ টিপে ইশারায় শান্ত থাকার পরামর্শ দেন প্রিয়াঙ্কা। রাহুলও মানেন। আনন্দে, শোকে, দুঃখে, আশা, নিরাশা, ভরসা আর ভালোবাসার মুহূর্তগুলো একসঙ্গে ভাগ করে নেন ভাইবোন। প্রিয়াঙ্কা নিজেই জানিয়েছেন, ‘রাহুল আমার দাদাই নয়। আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুর নামই হল মেরা ভাইয়া।’ ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে