পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
আর থাকতে না পেরে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর জানতে চাইলেন মির্জা গালিবের কাছে যে, আম নিয়ে এত গবেষণা করছেন কেন তিনি?
যেন এই প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষাতে ছিলেন মির্জা। তিনি বলে উঠলেন,
‘বাদশা সালামত, ম্যায় বুজুর্গো সে সুনা হ্যায়
দানে দানে পে লিকখা হ্যায় খানে ওয়ালে কা নাম
ইবন ফলো কা নাম ইবন ফলো কা নাম
দেখ রাহা হু কিসি আম পর
মেরে বাপ দাদা কা নাম ভি লিকখা হ্যায় কেয়া?’
অর্থাৎ হে বাদশা, গুরুজনদের কাছে শুনেছি যে, প্রতিটি শস্যের দানায় দানায় নাকি লেখা থাকে খাদকের নাম। এমনকী ফলের গায়ে গায়েও লেখা থাকে। আমি তাই দেখছি এসব আমের মধ্যে কোনওটার গায়ে কি আমার পিতা-পিতামহের নাম লেখা আছে?
মির্জার শেরশায়েরির সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল সঙ্কেত। সেকথা খুব ভালো করে জানেন বাহাদুর শাহ জাফর। আর মির্জাও জানেন যে, মুঘল সাম্রাজ্যের এই সংস্কৃতিপ্রিয় জাঁহাপনাকে প্রকৃত গভীর ও রহস্যময় রূপকধর্মী শায়েরি শুনিয়ে আনন্দ। কারণ সম্রাটের রয়েছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং তাঁর রসজ্ঞানও প্রখর। তাই তিনি রূপকধর্মী শেরশায়েরি সম্রাটকে শোনাতে ভালোবাসেন। অতএব এক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। এটা কোনও উচ্চমানের শায়েরি নয়। কিন্তু মির্জার কথার মারপ্যাঁচেই সম্রাট বুঝে গেলেন যে, আসলে মির্জা কী বলতে চাইছেন। মির্জা গালিব আম খেতে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু বাজারে যে আম পাওয়া যায় তার স্বাদ আর সম্রাটের বাগানের আমের মধ্যে বিরাট ফারাক। তাছাড়া ভালো আমের যা দাম, সর্বদা মুঘল খাজানা থেকে সামান্য বেতন পাওয়া গালিবের পক্ষে সেই আম কিনে খাওয় সম্ভব হয় না। এদিকে আম খাওয়ার লোভ তো আর পরিত্যাগ করা যায় না। আবার তিনি হলেন মির্জা আসাদুল্লা বেগ। একটা বংশপরিচয় আছে। বাবা ছিলেন সামন্ত সেনাপতি। যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ দিয়েছেন। আজ না হয় নিজের ভাগ্যদোষে এভাবে কবিতা শুনিয়ে সম্রাটের দরবার থেকে অর্থোপার্জন করতে হয়। তাই বলে তো আর অন্য সভাসদদের মতো তিনি সম্রাটের কাছে আম ভিক্ষা করতে পারেন না! অতএব পরোক্ষে বোঝানোর জন্যই ওই কথাগুলো বললেন। আর সম্রাট বুঝে গেলেন যে, মির্জার এই বাগানের আম খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে। অবশ্য তিনি তখনই কিছু বললেন না। তবে পরদিন সকালে যাতে মির্জা গালিবের হাভেলিতে একঝুড়ি আম পৌঁছে যায়, সেই নির্দেশ দিলেন। যথারীতি পরদিন ঘুম ভাঙার পর গালিব আবিষ্কার করলেন একঝুড়ি আম। উমরাও বেগম বললেন, সাত সকালে এক পেয়াদা এসে দিয়ে গিয়েছে। মির্জা দেখলেন, বাহাদুর শাহ জাফর নিছক আম পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি। সঙ্গে এসেছে চিরকুট। যেখানে লেখা— মিয়াঁ আম খাইয়ে...গিনিয়ে মাত!
মির্জা গালিবের প্রিয় খাবার কী কী ছিল? কাবাব, ভুনা গোশত, শামি কাবাব, ডাল মোরব্বা, সোহান হালুয়া।
আশ্চর্য ঘটনা হল, আমসহ তাবৎ মরশুমি ফল অথবা এইসব খাবার, আজও স্বমহিমায় সবথেকে বেশি পাওয়া যায় যেখানে, তার নাম বাল্লিমারান। যে আমের জন্য মির্জা গালিব সম্পর্কে এত গল্প পুরনো দিল্লির বাতাসে মিশে আছে, সেই আমভর্তি ভ্যানরিকশ নিয়ে আজও প্রতিটি গ্রীষ্মে একাধিক হকার এসে দাঁড়ায় মির্জা গালিবের হাভেলির আশপাশে।
হাভেলি? একে আর হাভেলি বলা যায়? চৌরি বাজার মেট্রো স্টেশন থেকে এগিয়ে যেতে হবে। যে গলিটা ঢুকছে সেটা অত্যন্ত সাধারণ একটি চাঁদনী চক মার্কা সরু লেন। রাস্তা আর ফুটপাতে জুতোর পাহাড়। কারণ এসবই জুতোর দোকান। দোকানগুলিকে এড়িয়ে আরও অগ্রসর হওয়ার পর ডানদিকে এই যে গলি কাশিম জান। আর সেখানেই মির্জা গালিবের শেষ জীবনের আবাসস্থল আজও দাঁড়িয়ে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কী ছিল এখানে? হিটার কারখানা।
১৯৯৯ সালে অবশেষে বহু প্রয়াসের পর হাভেলির কিয়দংশ উদ্ধার করে অধিগ্রহণ করা গিয়েছে। দু’টি মাত্র ঘর আর প্রবেশদ্বার পেরনো ড্রইংরুম। তবুও এই শব্দবাজার, এই বাণিজ্যবাস্তব এবং এই কঠোর জীবনসংগ্রামের বিখ্যাত চাঁদনী চকের চেনা যাপনদৃশ্য পেরিয়ে আজও যদি কেউ বাল্লিমারানে মির্জা গালিবের হাভেলির অন্দরে ভরদুপুরে নির্জনে ক্ষণিকের জন্য প্রবেশ করে, আচমকা যেন আলো আঁধারির একটি জাদুবাস্তব তৈরি হয়। সকাল ৯টায় হাভেলি থেকে বেরিয়ে লালকেল্লায় যাওয়া মির্জা হয়তো এখনই ঢুকবেন দুপুরের খাবার খেতে। তারপর উমরাও বেগমকে বলবেন, লেখার খাতাটা দিয়ে যাও...।
আগ্রায় ১৭৯৭ সালে জন্ম হয়েছিল গালিবের। আগ্রা থেকে চলে এসে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর জীবনে দু’টি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যুক্ত হয়েছিল। স্ত্রী উমরাও বেগম ও শহর দিল্লি! যার একজনকেও তিনি কখনও ছেড়ে থাকতে চাননি। আগ্রায় তিনি যেতেন। যেখানে তাঁকে সম্বোধন করা হল, ‘আসাদ’ নামে। আর দিল্লির কাছে তিনি গালিব! আসাদ নয়, গালিবকেই কণ্ঠলগ্ন করেছিলেন আজও বিষণ্ণতার সেরা আশ্রয়, এই কবি। দিল্লি ছিল তাঁর আত্মা।
গালিব অসুস্থ এবং প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় এই হাভেলিতে বসেই একদিন লিখেছিলেন,
‘ইক রোজ আপনি রুহ সে পুছা, কী দিল্লি কেয়া হ্যায়?
তো ইঁউ জবাব মে কহে গয়ে
ইয়ে দুনিয়া মানো জিসম হ্যায়, অওর দিল্লি
উসকি জান!’