পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
তিতাস এতক্ষণ অপলক তাকিয়েছিল বাইরের দিকে। চোখ জানলা বেয়ে ওর উদাসী মন পরিযায়ী বিহঙ্গের মতো পাড়ি জমিয়েছিল সুদূরের কোনও দেশে! শহরের আঁচলে ছড়ানো শেষ বিকেলের ম্লান সোনালি আভা, ঘুমন্ত দেশি কুকুর, একচিলতে গাছের নার্সারি, পথচলতি লোকজন ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওর স্থির দৃষ্টি। খানিকক্ষণ আগেই কসবা পোস্ট অফিস পেরিয়ে গাড়িটা হালতুর ভেতরে ঢুকে পড়েছে। গেরস্ত পাড়া। আনাচেকানাচে বড় চেনা আটপৌরে জীবনের রং। তিতাসের দু’চোখে এখনও বড় রাস্তার ভিড়ভাট্টা, ঔজ্জ্বল্য আর গতিময়তার রেশ। দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলে এখন আর ওর আসাই হয় না। অথচ একসময় কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে কী দৌরাত্ম্যটাই না করে বেড়িয়েছে ওরা! গড়িয়াহাট, কসবা-হালতু তখন ছিল ‘সেকেন্ড হোম!’ তিতাসের বেস্টফ্রেন্ড গায়ত্রী এইখানেই একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকত। দক্ষিণ ভারতের মেয়ে গায়ত্রী। কত দুপুর যে ওরা একসঙ্গে শপিং-হুল্লোড়-খাওয়াদাওয়া করে কাটিয়েছে, হিসেব নেই! তিতাসের কোলের উপর রাখা ফোনের স্ক্রিনে খোলা বেশ পুরনো কিছু হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন। বেশিরভাগই একতরফা। কালেভদ্রে মিতুলের প্রশ্নগুলোর দায়সারা উত্তর দিয়েছে তিতাস। কখনও এড়িয়ে গিয়েছে তাচ্ছিল্যভরে। উড়ো কথারা জমা হয়েছে ঝরা পাতার মতো। শুধু জীবনের পৃষ্ঠা থেকে তাদের আর সরাতে পারেনি কেউ। ‘কেমন আছিস দিদি?’ ‘আমি আজও তোর অপরাধী। এখনও ক্ষমা করিসনি না?’ মিতুলের সঙ্গে দূরত্বটা তো কখনওই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। অমিয়-মিতুলের বিয়ের পর নিজে হাতে একের পর এক পাথর গেঁথে দুর্বোধ্য ওই প্রাচীর গড়েছিল বলেই হাজার ঝড়ঝাপটা এলেও বাধাটুকু অতিক্রম করতে চায়নি তিতাস। ড্রাইভারের কথায় ওর সংবিৎ ফিরল। আধভেজা অবিন্যস্ত চুলগুলোকে ক্লাচারে আটকে ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়ে ও। গ্রিলঘেরা ক্লাবঘরের গা-ঘেঁষে টিনের ছাউনি দেওয়া পান-বিড়ি-সিগারেটের গুমটি। সামনে জনা সাতেক স্থানীয় মানুষ। ধীর পদক্ষেপে এগয় তিতাস। ভিড়টার পিছনে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলে, ‘দাদা, অমিয়ভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িটা...’
কম্পমান গলার প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই গুমটির অন্ধকার থেকে জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে দোকানি ভদ্রলোক বললেন, ‘এই যে দিদিভাই, ডানহাতে এগিয়ে গলির ভিতরে ঢুকেই দু’নম্বর বাড়িটা।’
তিতাস ভদ্রলোকের আঙুল অনুসরণ করে পিছন ফিরতেই ভিড়ের মধ্যে অমিয়র আকস্মিক মৃত্যু নিয়ে আলোচনাটা শুরু হয়ে গেল। দোকানির গলাটা সদ্যপরিচিত বলে সেটাই সর্বাগ্রে ওর মনোযোগ দখল করে নিল।
‘সকাল থেকেই দলদল লোক আসছে। চেনা পরিচিত তো আর কম ছিল না। অমিয়দা লোকটা ভালো ছিল! আমার ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে কি কম সাহায্য করেছে! জীবনের কোনও দাম নেই ভাই। জলজ্যান্ত লোকগুলো পটপট করে মরে যাচ্ছে। এই তো কাল সন্ধে সাতটার সময় সিগারেট নিয়ে গেল। সকালে চোখ খুলে শুনি লোকটা আর নেই!’
অচেনা এক কণ্ঠস্বর বলল, ‘হার্ট অ্যাটাক আগেও হতো কিন্তু আজকাল যেন বেড়ে গেছে। এই তো তিন মাস আগে আমার ভায়রাভাই চলে গেল। সেম কেস! ম্যাসিভ অ্যাটাক!’
তিতাস পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। সকাল থেকে ওর বুকের ভিতরে একটা শুষ্ক বাতাস ঘূর্ণির মতো পাক খাচ্ছে। ঘুমচোখেই খবরটা কানে পৌঁছেছিল। কনফারেন্স কলে ওকে জুড়ে নিয়েছিল শাক্য। ফোনের অপরপ্রান্তে মা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে তখন। মাছবাজারের কোলাহল, টোটো-রিকশর হর্ন, দর কষাকষির সঙ্গে মিশে থাকা কান্নার শব্দ ছাপিয়ে তিতাস শুনতে পাচ্ছিল শাক্যর শান্ত গলাটা।
‘মা কী বলছেন শোনো, তিতাস।’
আচমকা মায়ের কান্না শুনে ওর বুকের ভেতরে সে কী তোলপাড়! ও বাড়িতে থাকে মোটে দু’টি বয়স্ক প্রাণী। কোনও বিপদআপদ হল না তো! তিতাসের জিভ জড়িয়ে যাচ্ছিল। ক্ষণিকের জন্য চোখের সামনে জমাট বাঁধা অন্ধকার! পরমুহূর্তে যে কী শুনতে হবে সেই ভাবনায় হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো অবস্থা!
‘কী হয়েছে মা? বাবা ঠিক আছে তো? কাঁদছ কেন তুমি? প্লিজ বল!’
হালকা করে ধমক দিয়েছিল শাক্য।
‘আরে বাবা, শান্ত হও। কথাটা শোনো
তো আগে।’
তখন অতি কষ্টে ওর মা কেটে কেটে বলল, ‘অমিয় আর নেই রে! কাল অনেক রাতে...’
কথাটা শেষ না করেই আবার কান্নায় ডুবে গেল মা। তিতাসের সদ্য ঘুমভাঙা মস্তিষ্ক অমিয়র মুখটাকে ওর স্মৃতিপটে ভাসিয়ে তুলতে পারছিল না কিছুতেই। দূরত্ব তো এমনই, চির চেনাকেও একসময় ম্লান থেকে ম্লানতর করে দেয়। শাশুড়িকে থামিয়ে গাঢ় স্বরে শাক্যই স্ত্রীকে জানাল আসল কথাটা।
‘কাল শেষ রাতে মিতুলের হাজব্যান্ড এক্সপায়ার করেছেন। ম্যাসিভ অ্যাটাক!’
‘ওহ!’
স্মৃতির সরণী বেয়ে জগদ্দলসম একটা ভারী বোঝা নিম্নমুখে অগ্রসর হচ্ছিল ক্রমে। ওই একটা শব্দ উচ্চারণ করেই থমকে গিয়েছিল তিতাস। প্রস্তরমূর্তির ন্যায় মূক। কাঁদতে পারেনি। এখনও ওর কান্না আসছে না। কেবল মুখটাই যা মেঘাচ্ছন্ন। সকাল থেকেই নিজের আচরণ অদ্ভুতরকমের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে তিতাসের। মা হয়তো আশা করেছিলেন ও কিছু বলবে, নিদেনপক্ষে মিতুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করবে, সামান্য হলেও কাঁদবে, কিন্তু না! তিতাস যেন ভাবগম্ভীর এক সন্ন্যাসিনী, জন্ম-মৃত্যু-বিরহ-উল্লাস কিছুই যাকে স্পর্শ করতে পারে না। অতিশয় আনন্দের ক্ষণেও যেমন সে স্থির, গভীর বেদনাতেও তেমনি অবিচল।
‘কিছু বলবি না তিতি? জানিস, মেজমাসি জানাল মিতুটা কেঁদেকেঁদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে!’
একরাশ নৈঃশব্দ্য ছাড়া মাকে আর কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারেনি তিতাস। ফোন রাখার আগে মা বলল, ‘আমরা যাচ্ছি। পারলে তুইও আয়! আপনজনের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোটা নৈতিক কর্তব্য। কথাটা ভুলিস না!’
তারপর শাক্য বাজার থেকে ফিরে খুব সাবলীলভাবেই জানতে চেয়েছে, ‘গাড়ি নিয়ে যাবে তো? মধুকে ডেকে নিই?’
‘দরকার নেই। আমি ক্যাব বুক করে নেব।’
অতি সংক্ষেপে জানিয়েছে তিতাস। শাক্য অফিস চলে গেলে হেলায় অনেকটা সময় ব্যয় করেছে। অমিয়র লেখা বইগুলো তাক থেকে নামিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছে। পুরী বেড়াতে গিয়ে অমিয় যেসব প্রবাল, ঝিনুক আর কড়ি এনে দিয়েছিল ওর আঠেরোর জন্মদিনে, সেগুলো হাতে তুলে বুকের কাছে ধরে থেকেছে কিছুক্ষণ। নাকের সামনে এনে লবণজলে স্নাত অমিয়র ঘ্রাণটুকু প্রাণপণে খুঁজেছে। কিন্তু হায়! তিতাসের বসার ঘর জুড়ে রুক্ষ বাতাস পাক খেয়ে উঠেছে কেবল। অবশেষে স্নান সেরে বেরতে-বেরতে ও ভেবেছে এভাবে শেষ দেখা হওয়ারও কি খুব প্রয়োজন ছিল? সেই মুহূর্তে মা ফোন করে আবারও তাড়া মারল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তিতি, তুই যে এতটা পাষাণী তা তো জানতাম না রে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে তোকে আমি পেটে ধরেছিলুম!’
***
আশপাশের বাড়িগুলো যে প্রৌঢ়া তা তাদের গণ্ডদেশের ঈষৎ কালচে ছোপ আর মেচেতার মতো ছিটছিট দাগ দেখে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বন্ধ দোকানপাট এখনও নিঝুম আমেজ গায়ে মেখে ঝিমোতে ব্যস্ত। টানা লম্বা পাঁচিলের উপর কানাভাঙা টবে অযত্নলালিত কিছু পাথরকুচি আর রিয়ো গাছ। ইটের নোনায় কাঁধ মিশিয়ে হেঁটে যেতে গেলে মাথায়-গায়ে ঠেকে যায় ছেঁড়া পাপোশ, শীর্ণ ন্যাতা, অলস ভঙ্গিতে ঝুলন্ত বেতের চুপড়ি। তিতাসের মনে পড়ে গেল, মেজমাসিদের বাড়ির পিছনে আলোছায়া ঘেরা ঠিক এরকম একটা জায়গাতেই একবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল ওরা দু’জন। অমিয় তখন কলেজের তৃতীয় বর্ষে। তিতাসের উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি তুঙ্গে। বাংলা পড়াতে এসে ভালোলাগার কথা অমিয় জানিয়েছিল কেমন যেন খেলাচ্ছলে। তবে সাড়া পেয়েছিল অবিলম্বে। অমিয়র ওরকম গমগমে আবৃত্তির গলা, কবিতা লেখার উদার হাত বরাবরই মুগ্ধ করত তিতাসকে। এক শ্রাবণদিনে চুপিচুপি দু’জন বদল করেছিল নিজেদের হাতের আংটি। কিন্তু অমিয়র বুকে মাথা রেখে কখনও সাহসের উষ্ণতা অনুভব করেনি তিতাস। বরাবরই ভিতু, লাজুক মানুষ। নিজেকে দমিয়ে রাখতে যে কী সুখ পেত! তিতাস তবু শাক্যর সামনে খোলা ডায়েরির মতো নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছে। অকপটে জানাতে পেরেছে নিজের অতীতের কথা, কিন্তু মিতুল? ছেলেমানুষের মতো জেদের বশে ওর থেকে অমিয়কে কেড়ে নিয়ে নিজের সংসার পেতেছিল মেয়েটা! কী পেল জীবনে? বালুকণা ধরে রাখার মতো সুগভীর হাতের তালু যে সে জন্মসূত্রে পায়নি!
***
‘কী ব্যাপার? এইখানে এই ভরদুপুরে কী করছিস তোরা?’
তিতাসের গলা এতটুকুও কাঁপেনি। বরং লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল অমিয়র চোখমুখ। আর মেজমাসি? সে তো মহাভারত রচনায় সিদ্ধহস্ত। সামান্য হাত ধরাধরির অপরাধে তিতাসকে লক্ষ্য করে যেসব বাক্যবাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করেছিল, সেগুলো ওকে ছুঁতে না পারলেও পরের রবিবার ঢাকুরিয়া লেকে দেখা হতে অমিয়র অদৃশ্য ক্ষতচিহ্নগুলো স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল তিতাস। সেই বোধহয় ভাঙনের শুরু। তারপর থেকে পাশে বসা যুবকটির ভেতর তিতাস একমাত্র মাসতুতো বোন মিতুলের প্রাইভেট টিউটরকেই খুঁজে পেত। দু’বছরের ছোট মাসতুতো বোনের গ্র্যাজুয়েশনের পর একদিন জানতে পারল পাশে বসা ছেলেটাকে ওর বোনের সঙ্গে একাসনে বসতে হবে জীবনের তপস্যায়। বাধা দেয়নি তিতাস। কাঁদেওনি। অসময়ের কালবৈশাখী এসে ওর আলাভোলা প্রেমিকটাকে তো কবেই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বেপরোয়া চাঁদিয়ালের গায়ে পোষা ময়নার গেরস্থ গন্ধ তিতাস সইতে পারেনি। অমিয়র সঙ্গে তিতাস ধরা পড়েছিল যেদিন, মেজোমাসি সেইদিনই মন ভরে অপমান করেছিল ওকে আর ওর মাকে।
‘তোর মেয়েকে আর কোনওদিন এ বাড়িতে আনিস না দিদি। মোটে ক্লাস টুয়েলভ, কোথা থেকে এসব শিখছে জানি না! কিন্তু মিতুলকে যদি খারাপ করে দেয়, আমার দেওররা কিন্তু চুপ করে থাকবে না দিদি!’
অপমানে তিতাসের মায়ের মুখ রাঙা। মায়ের হাত ধরেই ফ্যাকাশে মুখে মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। মায়ের শরীরের গনগনে আঁচ ওকে নিঃশব্দে বুঝিয়ে দিচ্ছিল সন্তানের জন্য মাতৃহৃদয়েও সবসময় সহানুভূতি জন্মায় না। গ্রীষ্মের দুপুর, তাই ফেরার পথে ট্রেন একেবারে ফাঁকা ছিল। জানলার ধারের সিটে স্থাণুবৎ বসেছিল মা। একমাত্র মেয়ের দিকে তাকাতেও তখন তাঁর সংকোচ! মাসির আঘাত খানখান করে দিচ্ছিল তিতাসকে। ওর হাত ছাড়িয়ে অমিয়র বেরিয়ে যাওয়াটা বুকের ভেতরটাকে ভরে দিচ্ছিল ঘেন্নায় আর অবিশ্বাসে। সেদিন কোন প্রতিশোধপ্রবণতায় কে জানে, মনে মনে ওই মিতুলের জন্য বিষাক্ত একটা জীবন কামনা করছিল তিতাস।
***
বসার ঘরে প্রবেশের মুখে একগাদা চটি-জুতো। সেগুলো পেরিয়ে বরফঠান্ডা মেঝের পরশে চমকে উঠল তিতাস। ছিমছাম ফ্ল্যাটের সর্বত্র অদ্ভুত বিষণ্ণতা। ভেতরের ঘর থেকে পরিণত কণ্ঠের বিলাপবাণী ভেসে আসছে। ঈশানকোণের ছাইরঙা সোফায় মৃতের সহকর্মীরা বসেছেন কোনও এক গভীর আলোচনায়। জলের ট্রে হাতে ভাবলেশহীন মুখে আতিথেয়তা বিলোচ্ছেন জনৈকা। খাওয়ার টেবিলে স্তূপাকার ফাইলপত্রের পাশে কিছু ওষুধের মোড়ক। ঘরের কোণে ক’টা ক্যাকটাসের সুতীক্ষ্ণ উপস্থিতি। ক্যাবিনেটের মাথায় ফ্রেমবন্দি প্রকৃতির রূপশোভা অথবা কোনওটায় একাকিনী মিতুল। কিন্তু মিতুল-অমিয়র যৌথযাপনের কোমল চিহ্ন তো কোথাও নেই! কেমন যেন ছন্নছাড়া, অগোছালো ঘরদোর। দেখলে মনেই হয় না এই বাসা কোনও দম্পতির!
‘এলি তিতি? এদিকে আয় মা।’
বাবার ডাকে পর্দাটানা ঘরটার দিকে পা বাড়ায় তিতাস। বিছানায় শায়িত দীর্ঘদেহী পুরুষকে দেখলে যে কেউ বলবে, পরিশ্রমান্তে হা-ক্লান্ত মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে। জামাতাকে ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে তিতাসের মেজোমাসি। বিপন্ন মেসোর কাঁধে হাত রেখে বিছানার পাশেই তিতাসের বাবা দাঁড়িয়ে। আর ওর মা? নির্বাক! আরও কয়েকজন উপস্থিত সেই ঘরে। তিতাস ধীর স্বরে জানতে চাইল, ‘হঠাৎই এমন হল? কোনও লক্ষণ ছিল না? বোঝা গেল না কিছু?’
হুতাশভরা গলায় ওর মেজোমাসি বলল, ‘বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল মাঝরাতে। ভেবেছিল অ্যাসিড। এমন যে হবে কেউ বুঝতে পারেনি রে। কথা শুনত না তো! খুব স্মোক করত, টাইমে খেত না, ঘুমতো না। আসলে আমার মিতুলটা কোনওদিন বাঁধতেই পারল না অমিয়কে।’
আর কোনও কথা খুঁজে পেল না তিতাস। অন্তিম যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হতে ভিড় ও ব্যস্ততা বাড়তে লাগল ফ্ল্যাটের চতুর্দিকে। আনাচে-কানাচে নিজের অতীতকে খুঁজে বেড়াতে লাগল তিতাস। হাতখরচা জমিয়ে যে বইগুলো, যে পেনগুলো অমিয়কে দিয়েছিল সেগুলো কোথায়? নিশ্চয়ই সব ফেলে দেয়নি অমিয়!
***
বসার ঘরের সোফাটা ধরাধরি করে সরিয়ে দেহটা মাটিতে শোওয়ানো হল। কান্নার শব্দ অনেকটা থিতিয়ে পড়েছে এখন। অমিয়র বৃদ্ধা মা পুত্রবধূর উদ্দেশে শ্লেষ বর্ষণ করে চলেছেন, ‘পনেরো বছরের বিয়েতে একদিনের জন্যও সুখ পায়নি আমার বাবু। আমি তো জানি, একটা সন্তান চেয়েছিল ও, সেটাও হল না! কেন যে ওই মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দিতে গিয়েছিলাম! আমার সব শেষ করে দিল!’
একের পর এক অভিযোগের ক্রুদ্ধ তির ধেয়ে বেড়াচ্ছে ঘরময়। মিতুলের মা-বাবা নিঃশব্দে বিদ্ধ হচ্ছেন। তিতাসের বুকের ভিতরে বোঝাটা ক্রমেই বাড়ছিল। মাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ও বলল, ‘এবার আমি যাব মা। আমার আর কী কাজ এখানে? তুমি ডেকেছিলে, তাই এসেছিলাম!’
‘মিতুলের সঙ্গে একবার দেখা করবি না? যে ভুল তোর বোন আর মাসি করেছে তার ক্ষমা হয় না জানি, কিন্তু আজকের দিনে তুই পাশে দাঁড়ালে মেয়েটা হয়তো...’
মায়ের ঝাপসা চোখে অনেক অব্যক্ত কথা। ভাঙনটা তিতাসের অন্দরেও শুরু হচ্ছিল। নিজেকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে ও বলল, ‘থাক না মা!’
মিতুলদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়ল তিতাস। সন্ধে বেশ ঘন হয়ে এসেছে আর হাওয়াটা ভারহীন, পাতলা। ওর ফেরার ক্যাবও উপস্থিত। মৃত্যুর আঁধার থেকে দূরে সরে আসতে আসতে তিতাস বুঝতে পারল সেদিনের অসমাপ্ত কান্নাটা আজ বহু বছর পর ওর ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।