পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
হ্যাঁ, জানি পাঠক বলবেন সে সময়ে এত গরম পড়ত না। কিন্তু ১৮৮৯ সালে কলকাতার আবহাওয়া নিয়ে সঙ্কলিত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল-মে মাসে শহরের সর্বাধিক তাপমান প্রায়ই ১০৫ বা ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছে যেত। মানে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সেই তাপপ্রবাহে সমান নাজেহাল হতেন সাহেব, নেটিভ নির্বিশেষে আপামর শহরবাসী। সাহেবদের মতো এদেশীয় ধনীরাও টানা পাখার হাওয়া, ভেজা খসখসের পর্দার আরাম বা আইস হাউস থেকে নগদে কেনা বরফের বিলাসিতায় খানিকটা সামাল দিতেন। স্বাভাবিকভাবেই সে সব তো ছিল সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। তবে তাদের হাতে ছিল এক প্রাচীন পদ্ধতি। সেটা হল ‘স্নান’। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলেই গায়ে মাথায় জল ঢেলে গরমের জ্বালা জুড়োতেন।
ভারতে স্নানের, বিশেষ করে গঙ্গা স্নানের মাহাত্ম্য ধর্মীয় আচারের পথ ধরে ব্যক্তিগত আচরণের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। কলকাতার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস মানুষ গঙ্গা স্নান করে এসেছেন। অমৃতলাল বসুর স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় উত্তর কলকাতার ভোরে ‘শিব ধন্য কাশী’ ‘শিব ধন্য কাশী’ জপ করতে করতে যাওয়া এক নামহীন গঙ্গা স্নানার্থীর কথা। বনেদি বাড়ির মহিলারা গঙ্গা স্নানে যেতেন ঘেরাটোপ ঢাকা পালকিতে চড়ে। সেই পালকি সমেত গঙ্গায় ডুব দিয়ে আব্রু-সম্ভ্রম বজায় রেখে স্নানপর্ব মিটত নির্বিঘ্নে। আবার গঙ্গার তীর বরাবর যে সব বিত্তবান প্রাসাদ গড়তেন, তাদের অনেকে বাড়িতে সরাসরি জোয়ারের জল নির্দিষ্ট অংশে ঢুকে আসার জন্য সুড়ঙ্গ জাতীয় পরিকাঠামো তৈরি রাখতেন। দিনে দু’বার সেই জলে স্নান করার সুযোগ পেতেন বাড়ির বাসিন্দারা। তবে দৈনন্দিন ব্যবস্থা হিসাবে স্নানের জন্য ভারীদের এনে দেওয়া তোলা জলের উপরই ভরসা করা হতো। গ্রীষ্মের দুপুর পেরিয়ে সেই জলেই বিকেলের গা ধোয়া ছিল মেয়ে মহলের এক নিজস্ব শৌখিনতা।
সমাজের উঁচুতলার কথা ছেড়ে যদি সাধারণ মানুষের স্নানের কথা বলি, তাহলে গঙ্গা স্নান ছাড়াও প্রতিটি পাড়াতেই ছড়িয়ে থাকা পুকুরগুলি ছিল মানুষের স্নানের জায়গা। কিন্তু শহর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সব পুকুরের জল দূষিত হয়ে নানা রোগের উৎস হয়ে উঠল। উনিশ শতকের শেষ দিকে পুরসভার হেলথ অফিসার ডাক্তার পেইন-এর উদ্যোগে এই বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ শুরু হয়। এই অভিযানের অংশ হিসেবে ১৮৮৩-’৮৪ সালে কলকাতা পুরসভা প্রচলন করে নিঃশুল্ক সর্বজনীন স্নানাগারের। ১৯১৪ সালে পুরসভার দেওয়া গঙ্গার অপরিস্রুত জল ব্যবহার করা কাঠামোগুলির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১২।
অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকেই শহরের বিশেষ কিছু জায়গায় ‘হামাম’ বা সর্বজনীন স্নানাগারের কথা জানা যায়। মধ্য কলকাতায় একটি রাস্তার নামই ছিল হামাম গলি। ঠিক টার্কিশ হামাম বলতে যে স্নান-বিলাসিতার ছবি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে, ঠিক তেমনটা হয়তো নয়, তবে পুরসভার ব্যবস্থাপনায় পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা স্নান ও কাপড় কাচার জায়গাগুলি বিশ শতকের মাঝের সময়েও রীতিমতো কার্যকর ছিল। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ অতুল সুর তেমন তিনটি হামামের কথা বলেছেন নিজের স্মৃতিকথায়। প্রথমটি ছিল শ্যামবাজার পোস্ট অফিসের সামনে মোহনবাগান লেনে ঢুকতে বাঁ-দিকে। দ্বিতীয়টি রাজাবাজারের সামনে আর তৃতীয়টি প্রিন্সেপ স্ট্রিটে। ঔপনিবেশিক শহরের স্বাস্থ্যবিধান ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি এই জায়গাগুলোকে স্থানীয়রা
বলতেন ‘হৌস’।
‘হৌস’ শব্দটি হয়তো চৌবাচ্চা বোঝাতেই ব্যবহার করা হতো। ‘কলিকাতা দর্পণ’ বইতে রাধারমণ মিত্র শহরের জল সরবরাহ ব্যবস্থার কথা বলতে লিখেছেন যে, ১৮২০ সালে চাঁদপাল ঘাটের পাশে একটি ছোট স্টিম ইঞ্জিন বসিয়ে গঙ্গার জল পাম্প করে তুলে এক প্রকাণ্ড হৌস বা চৌবাচ্চায় রাখা হতো। চৌবাচ্চা থেকে বেরনো সরু নালা বেয়ে সেই জল বিভিন্ন পাড়ায় যেত। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে একসময় এভাবে জল সরবরাহ করার প্রয়োজন ফুরল। তবে মজার কথা হচ্ছে যে, তখন সেই বিশাল চৌবাচ্চা, যাকে চৌবাচ্চা না বলে পুকুর বলাই ভালো, তার উপরেই গড়ে উঠল ‘ক্যালকাটা বাথ হাউস’। প্রাচীন বাথ হাউসের সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে ১৮৮৭ সালে শহরের শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের স্নানকেন্দ্রিক সামাজিক মেলামেশার স্থান হিসাবে শুরু হয় সংস্থাটি। ‘বাথ হাউস’ হিসাবে শুরু হয়ে পরবর্তী সময়ে অবশ্য পরিচয় বদল করে হয় ‘ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাব’। সেই সাবেক পরিকাঠামো আজও টিকে আছে শহরের বুকে। তার উৎস এবং বিবর্তনের সঙ্গে শহরের গ্রীষ্মের সম্পর্কের কথা ক’জনই বা খোঁজ রাখে!
পাইপের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি অপরিস্রুত গঙ্গার জল পৌঁছে দেওয়া ছিল শহরের পুর উন্নয়নের একটি ধাপ। বিশেষ করে ১৮৮৫ সালে মল্লিকঘাটে নতুন পাম্পিং স্টেশন বসানোর পর। সেই জলে কাপড় কাচা বা ঘর ধোয়ার মতো কাজ চলত। আবার সেই পাইপে হাইড্রান্ট বসিয়ে জল দিয়ে রাস্তা ও ফুটপাত ধোয়ার মতো নাগরিক পরিষেবাও দেওয়া হতো। এক পর্যায় সেই হাইড্রান্টের সংখ্য ১ হাজার ১০০ ছাড়িয়ে যায়। তারপর একসময় সেই কাজ পুরসভা বন্ধ করল। কিন্তু গঙ্গার জলের সেই কল কি একেবারেই মুছে গেল শহরের বুক থেকে?
এই গ্রীষ্মের সকালে একবার উত্তর বা মধ্য কলকাতার কিছু অঞ্চলে ঘুরলেই পেয়ে যাবেন এই প্রশ্নের উত্তর। দেখবেন প্রচুর মানুষ ফুটপাতের ধারে কোনও চৌবাচ্চা থেকে ঘোলা জল তুলে গরমের জ্বালা মেটাচ্ছেন। সেই জলে শীত-গ্রীষ্ম তাঁদের স্নান চলে। গ্রীষ্মে অবশ্যই একটু বেশি সময় ধরে। ব্রিটিশ আমলে বিনে পয়সায় পাওয়া পরিষেবা স্বাধীনতাত্তোর দেশে টাকার বিনিময়ে নিতে বাধ্য করতে একসময়ে এই স্নানার্থীদের পুলিস দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও দেখেছে শহর! তারপর সময় বদলেছে সব অর্থেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে ফুটপাত ভরসা করে জীবনধারণ করা এই সব মানুষ আর তাদের ‘গঙ্গা কল’। যে জলের উৎস মা গঙ্গা। একটু আশ্চর্য লাগলেও, এটাই ঘটনা যে গঙ্গার জলের লাইন হিসেবে যে ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল উনিশ শতকে, তা আজও গ্রীষ্মের তাপ ক্লিষ্ট সহ নাগরিকদের কাছে শান্তির বারি পৌঁছে দিচ্ছে।