পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
তবে কলকাতার পথে হাঁটাচলার যে খুব সুব্যবস্থা ছিল, সেটা ভাববার কারণ নেই। উনিশ শতকের একটা বড় সময় ধরেই রাস্তা ছিল মাটির। আর ফুটপাতও ছিল না। হুতোম প্যাঁচার নকশায় চড়ক পার্বণের সময়, মানে চৈত্র মাসের শেষে চিৎপুরের রাস্তার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মেঘ করলেই কাদা আর না করলে এক হাঁটু ধুলো মাড়িয়েই লোকে যাতায়াত করত সেকালে। তাই ভাড়ার পালকি এসে কলকাতায় সাধারণ মানুষের চলাফেরার ধাঁচটাই বদলে দিল।
তবে এটর্নি উইলিয়াম হিকির মতো সমাজের উঁচুতলার লোক তিনশো টাকা দামের পালকি চড়লেও অল্প বেতনের কেরানি বাবুদের অফিস যাতায়াতের বাহন হিসাবেই দেখা যেত সাধারণ ভাড়ার পালকিতেই। অন্তত সেকালের লেখাপত্র থেকে তেমনটাই জানা যায়। বনেদি বাড়ির মহিলারা পালকি চড়লে তাদের সম্ভ্রম রাখার জন্য পালকির দরজা বন্ধ করে তার উপর রঙিন কাপড়ের ঘেরাটোপ পরিয়ে দেওয়া হতো। সেই দমবন্ধ অন্ধকারেই মেয়েদের পালকি ভ্রমণ। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘চলতি গোরস্থান’। ভাড়ার পালকিতে সেসব ব্যবস্থা না থাকলেও আরাম যে থাকত না, সে কথা হলফ করে বলা যায়।
এরপর এল ঘোড়ার গাড়ির যুগ। একটু হলেও যাতায়াতের সুরাহা হল। আগে এক পালকিতে দু’জন চড়া যেত না। এবার যাকে বলে ‘শেয়ার’ করে যাওয়ার সুবিধে হল। কিন্তু গাড়ির ভেতর আরোহীদের বসার আরাম খুব বাড়ল কি? মনে হয় না। গরমকালে একই গন্তব্যের দু’জন স্থূলকায় ভদ্রলোকের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও তারা এক গাড়িতে সফর করা সব সময় এড়িয়ে চলতেন। ধর্মতলায় অবস্থিত ঠিকা গাড়ির আড্ডায় পরস্পর মুখোমুখি হলেও একে অপরকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি হতো। আর এসবের কারণ ছিল গ্রীষ্মকালে এক ঘণ্টা ধরে ঠিকা গাড়ির কাঠগড়ার মধ্যে ঘর্মাক্ত কলেবরে বন্ধ থেকে পরস্পরের ধাক্কা খেতে খেতে যাওয়ার কষ্ট। সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীর পক্ষেই বোঝা সম্ভব ছিল। তার উপর তাড়ি বা ধান্যেশ্বরীর কিঞ্চিৎ প্রভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে দুই গাড়োয়ান যদি গাড়ি ছোটানোর প্রতিযোগিতা শুরু করে, তাহলে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় আরোহীদের প্রাণ নিয়েও টানাটানি পড়ত।
সময় বদলাল। শহরের গণপরিবহণ হিসেবে সামনের সারিতে উঠে এল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। কিন্তু অফিস বসার সময় ও অফিসবাবুদের বাড়ি ফেরার সময় হুড়োহুড়ি ব্যস্ততা লেগে যেত। প্রত্যেকেই আগে গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। ১৮৮২ সালে সরকারের তরফে ট্রাম চলাচলের নিয়মে সিলমোহর দেওয়া হয়। নিয়ম হয় যে, প্রতি বেঞ্চে চারজন বসতে পারবে। কিন্তু অফিস টাইমের ভিড়ে দু’বেঞ্চের মাঝে আরও এক সারি লোক দাঁড়িয়ে পড়ত। একে ঘোড়ায় টানা গাড়ি খুব জোরে চলত না, তার উপর গ্রীষ্মের সময় ঘামে ভেজা সারা শরীর নিয়ে সেই এক লাইন দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর কল্যাণে বসে থাকা যাত্রীদের ট্রাম সফর কতটা সুখের হতো, সেটা সহজেই কল্পনা করা যায়। যদিও লেখা থাকত ‘দাঁড়ানো নিষেধ’, তবু কন্ডাকটার নিয়ম করেই অতিরিক্ত যাত্রী তুলতেন এবং তাই অনেককেই দাঁড়িয়ে সফর করতে হতো। ১৮৮১ সালে এই বিষয় নিয়ে একটি বিবাদ একেবারে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেদিন বিডন স্ট্রিট থেকে পুলিস কোর্ট পর্যন্ত পুরো যাত্রাপথ দাঁড়িয়ে সফর করে এক উকিলবাবুর মনে হল যে সমান ভাড়া দিয়ে কেউ বসে যাবে আর কেউ দাঁড়িয়ে যাবে— এ কেমন অন্যায়! উনি কন্ডাকটারকে কয়েকবার অনুরোধ করলেন অতিরিক্ত যাত্রী না তুলতে। কন্ডাকটার সেই কথায় কান দিয়ে নিজের কাজ যথারীতি করে গেলেন। এবার নামার সময় উকিলবাবু ভাড়া দিতে অস্বীকার করলেন। তাকে আটক করে আদালতে পাঠানো হল বিচারের জন্য। সেখানে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট রায় দিলেন যে, ভাড়া না দিয়ে উকিলবাবু কোনও অন্যায় করেননি। তাই বিবাদীর পক্ষেই মামলার রায় গেল!
১৮৮৪ সালে ট্রাম কর্তৃপক্ষ নতুন ডিজাইনের ট্রামবগি দিয়ে পরিষেবা শুরু করেন। আগের চারদিক খোলার পরিবর্তে চারদিক ঢাকা এই গাড়িতে চালক ও যাত্রীদের পৃথক করার জন্য পার্টিশনও বসানো হয়। ট্রাম কোম্পানি মনে করে যে, এর ফলে গাড়িতে অতিরিক্ত ভিড় কমানো যাবে এবং গ্রীষ্মে ঘোড়াদের কষ্ট কম হবে।
কিন্তু দেখা গেল যে, সব পরিকল্পনার পরেও এই সমস্যার সমধান হল না। এমনকী, পরবর্তীকালে ইলেক্ট্রিক ট্রাম এবং তারও পরে একতলা ও দোতলা বাসে ছবি হয়ে রয়ে গেল— ‘ট্রামে বাসে বাদুড়ঝোলা অবস্থা’।
এ বছর গরম দাপট দেখিয়েছে। চল্লিশ ডিগ্রি পেরিয়েও ছুটেছে থার্মোমিটার। দুপুরে সেই তাপে রাস্তার পিচ গলেছে। তার উপর টায়ারের আলপনা এঁকে বিরামহীন কলকাতার পথচলা। তার মধ্যেই একটু স্নিগ্ধতার ছোঁয়া যেন ভোরের দিকে ময়দান এলাকার উপর দিয়ে ট্রাম যাত্রা। সকালের ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে ময়দানের সবুজ দৃশ্যপট উপভোগ— এমন যাত্রাসুখ মনে হয় না আর আছে গ্রীষ্মের শহরে। সেকালেও গ্রীষ্মের ভোরে হাইকোর্ট থেকে পার্ক স্ট্রিট যাওয়ার ট্রামে চড়ার সমান সুখ পথঘাটের যাতায়াতে খুব কম ছিল। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় ফিরে আসে দার্জিলিংয়ের ট্রয় ট্রেনের মতো চারদিক খোলা সেই ট্রামে চড়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কাছে যাওয়ার কথা। অদ্ভুতভাবে এই একটা জায়গায় মিলে যায় একাল ও সেকাল। হাজার বদলের মধ্যেও কলকাতা যেন কোথাও যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখে উনিশ শতকের স্মৃতি।