পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
কাল সকাল হলেই ওরা থানায় যাবে। বিশু হুমকি দিয়ে গেছে। বিশুর মারের ভয়ে নিজেকে বাঁচাতে জবাও থানায় গিয়ে বলবে, ‘হ্যাঁ, উনি আমাকে...।’ পুলিস এসব কেসের গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসবে। এতদিন সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার পরে তাঁর উঁচু মাথা মুহূর্তে হেঁট হয়ে যাবে। মানুষ গায়ে থুতু ছেটাবে। কানাঘুষো, কানাকানি, ফোনাফুনি চলবে। থানা, পুলিস, কোর্ট কাছারি, পি সি, জে সি, হাজতবাস। নন বেলেবেল অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট। বিজন কোথায় পালিয়ে বাঁচবেন? আত্মপক্ষ সমর্থনে গলা ফাটালেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এসব মহিলাঘটিত ব্যাপারে তাঁকে যদি কেউ নির্দোষ ভাবেও, তবু বলবে, কী জানি, হতেও পারে। আজকালকার যা যুগ, যা ঘটছে চারপাশে। সাধু-সন্ন্যাসীরা পর্যন্ত রেপ কেসে কনভিকটেড হচ্ছে। আর বিজন তো ঘোরতর সংসারী মানুষ। সবাই বলবে, বউ-মরা বেচারার বুড়ো বয়সে ভীমরতি আর কাকে বলে। না না এসব শোনার আগে তাঁকে চলে যেতে হবে এই পৃথিবী থেকে। জবা যেমন ঠান্ডা সুস্থির ভীতু মেয়ে, বিশু ওকে যা শিখিয়ে দেবে মারের ভয়ে ও তা-ই বলবে থানায় গিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা হল, বিজনের নিজের ছেলে আর ছেলের বউ যখন তাঁকে দুশ্চরিত্র, লম্পট ভাবছে, তখন বাইরের পাঁচজন আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব কি বলতে ছাড়বে? বলবে, ভীমরতি বুঝলে, স্রেফ ভীমরতি। ডাকু বলেছে, ‘ছিঃ, ছিঃ বাবা! শেষ পর্যন্ত এই! ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে আমার।’
গভীর রাতে সবার অলক্ষ্যে চুপিসারে বেরিয়ে পড়লেন বিজন সেন। সদর দরজা এমনকী তাঁর শোবার ঘরের দোরদরজা সব আলগা পড়ে রইল। আসুক চোর। বাড়ি ফাঁক করে সব নিয়ে যাক। এখন আর তাতে কিছুমাত্র যায় আসে না বিজনের। সবই পড়ে থাকবে। তাঁর তো পিছুটান বলে কিছু নেই এখন। ডাকাত পড়ুক বাড়িতে। লুটপাট করে নিয়ে যাক সব।
সন্ধেবেলা জবার বর বিশু এসে যখন হুজ্জোত করল, তখন তিতলিকে দেখে বিজন অবাক হয়ে গেছেন। বিশুর পক্ষ নিয়ে শ্বশুরকে সে টেনে হিঁচড়ে নর্দমায় নামিয়ে দিল। জবাকে খুবই হিংসে করে তিতলি। জবা প্রায়ই সন্ধেবেলা বিজনের কাছে আসে। আজও এসেছিল। কিন্তু এতদিন যা হয়নি, আজ তাই ঘটে গেল। কেন আজ বিজন তাঁর আবেগকে সংযত করতে পারলেন না? তাতেই নিয়তি তাঁকে নিয়ে এই খেলা খেলল। বাষট্টি বছর বয়সে তাঁকে টেনে নিয়ে এই কঠিন পথের প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। তাঁর সামনে এখন একটাই পথ খোলা। সেই পথ গেছে সোজা রেললাইনে। রাত আড়াইটায় একটা সুপার এক্সপ্রেস ছুটে যায় এই আধা শহর আর আধা গ্রাম কাঁপিয়ে। বিজনের টার্গেট এখন সেই সুপার এক্সপ্রেস। হন হন করে হেঁটে সেই ট্রেন ধরতে এগিয়ে যাচ্ছেন বিজন।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একবারও তিনি বাড়ির দিকে ফিরে তাকালেন না। বিজনের রক্তজল করা পয়সায় তিল তিল করে তৈরি সাধের বাড়িটা। বিজন বলতেন, ‘দেয়ার ইজ নো প্লেস লাইক হোম। হোম সুইট হোম।’
বিজনের বাড়ির সামনে একফালি ফাঁকা জমিতে সাজানো বাগান। প্রকৃতি যেন বসন্তকে বন্ধক রেখেছিল সেই বাগানে। নিরুপমা চলে যাওয়ার পরে সেই বাগানের চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট নেই। বুক ফেটে হা-হুতাশ হাহাকার বেরিয়ে আসত বিজনের। নিরুপমা সিঁথির সিঁদুর নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গে চলে গেলেন। ব্যস, এই সংসারের সব সুখও তিনি আঁচলে বেঁধে নিয়ে গেলেন।
এই মাঝরাতে সেই বাড়িটা থেকেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন বিজন। অলিগলির জংলা পথ ধরে হন হন করে হাঁটছেন তিনি। সদর রাস্তা দিয়ে এত রাতে যাওয়া মুশকিল। থানার লোকেরা জিপ নিয়ে টহল দেয়। পুলিস যদি এত রাতে বিজনকে এভাবে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে যেতে দেখে, তাহলে পাকড়াও করবে। বিজনের কাছে তো কোনও সদুত্তর থাকবে না। পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাবে। তাঁকে থানায় টেনে নিয়ে যাবে। তারপর সকালে বিশু জবাকে নিয়ে থানায় ডায়েরি করতে এলে তখন দুয়ে দুয়ে চার করে নেবে পুলিস। বলবে, ‘পালাচ্ছিলেন?’
বিজন জংলা ঝোপঝাড় ভেঙে ভেঙে এগচ্ছেন। নয়নকাননের এই সব ঝোপেজঙ্গলে শঙ্খচূড় সাপের আড্ডা। সেসব কোনও ভয়ই তাঁকে ছুঁতে পারছে না এখন। মৃত্যু ভয় তো এখন তুচ্ছ তাঁর কাছে। এক বীভৎস মৃত্যুকেই তো আলিঙ্গন করতে ছুটে যাচ্ছেন বিজন।
নিরুপমা চলে যাওয়ার পরে একদিন স্টেশনে পাকাচুলের আসরে শরৎবাবু রহস্য করে বলেছিলেন, ‘পরপারে যাওয়ায় জন্য গোছগাছ করে তৈরি থাক হে বিজন। এবার তোমার ডাক এল বলে।’ শরৎবাবুর এই ধরনের রসিকতা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি বিজন। তাঁর চিবুক শক্ত হয়। শরৎবাবুর নজর এড়ায়নি তা। তিনি বিজনের পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘কথাটা শুনতে খারাপ লাগে জানি। কিন্তু মোদ্দা কথাটা কী জানো ভায়া? কথাটা হল, বুড়ি মরে গেলে বুড়ো আর বেশিদিন টেকে না।’ শরৎবাবুর কথা সত্যি হয়নি। নিরুপমা চলে যাওয়ার পাঁচ বছর পরেও কি শমন এসেছে তাঁর?
একটা প্রাইভেট ফার্মে অল্প মাইনের চাকুরে ছিলেন বিজন। রিটায়ারমেন্টের পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পুরোটাই বাড়িতে ঢেলেছেন। গ্র্যাচুইটির টাকাও বাড়িটাকে ঠিকঠাক আদল দিতে গিয়ে ফিনিশ। একেবারে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়লেন। পেনশন বলে যা আছে, তারচেয়ে বেশি বিল হয় ইলেক্ট্রিসিটির। ডাকুটা মোটা মাইনের ভালো চাকরিটা পেয়ে গেছে তার আগেই। সেই ভরসাতে সর্বস্ব বাড়ির পেছনে ঢেলে ডাহা বোকামি করেছেন তিনি। বিজনের পকেটও শূন্য আর নিরুপমাও চলে গেলেন। একা একেবারে নিঃস্ব আর নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন বিজন। সদর রাস্তার ওপর ভালো পজিশনে বাড়িটায় নজর পড়েছে প্রোমোটারদের। ডাকু আর ডাকুর বউ সে নিয়ে ঠারেঠোরে গাওনা গাইতে এসে বুঝে গেছে সুবিধে হবে না। সেই থেকে বিজন ছেলে-ছেলের বউয়ের বিষ নজরে। এই বাড়িতে একা একা একটা ফালতু লোক হয়ে কোনওমতে টিকে ছিলেন বিজন।
পাশের বাড়ির বিশুটা অটো চালায়। রাতে বেহেড হয়ে ফেরে। জবাকে মারধর করে। নিরুপমা বেঁচে থাকতে ছুটে গিয়ে বউটাকে বুক দিয়ে আগলাতেন। নিরুপমার কাছে ছুটে ছুটে আসত জবা। নিরুপমা ওকে মেয়ের মতো বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সে নিয়ে ডাকুর বউ তিতলির গায়ের জ্বালাপোড়া কম ছিল না। জবাকে বাঁকা কথা শোনাত তিতলি। নিরুপমা বলতেন, ‘ওসব গায়ে মাখিস না। বাড়িটা তোর মাসিমার এটা মনে রাখিস।’ তাই জবা কারও পরোয়া করত না। নিরুপমা চলে যাওয়ার পরেও জবার আসা বন্ধ হয়নি। বরং আসা যাওয়া আগের চেয়ে বেড়েছে। বিজনের ঘর গুছিয়ে দেয় জবা। চা করে দেয়। বিজন বলেন, ‘তুই রোজ রোজ মুখ বুজে মার খাস কেন?’ জবা চুপ করে থাকে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদে। কামিজের দোপাট্টায় চোখ মুছে পাথরপ্রতিমার মতো বসে থাকে।
আজও সন্ধেবেলা চা করে দিতে গিয়ে জবা ধরা পড়ে গেল বিজনের কাছে। বিজন বললেন, ‘মুখ লুকোচ্ছিস কেন? কই দেখি, ইস! এমন অমানুষিক মার মেরেছে। চোখের নীচে কালশিটে পড়ে গেছে। বুঝলি জবা, তুই যদি আমার মেয়ে হতিস তাহলে তোকে ডিভোর্স করিয়ে আমার কাছেই এনে রেখে দিতাম।’ বিজনের এই কথায় বাপ-মা মরা মেয়ে জবা চমকে ওঠে। বিজনের দিকে সরাসরি তাকায়। জবার ভেজা চোখে যেন গর্জন তোলে। দেখে বিজনের বুকের ভেতরটা ককিয়ে ওঠে। এক অপার আবেগ তাঁর বুকের রক্তে আঘাত করতেই জবার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। জবাও ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজনের বুকে। বিজনও অপত্য স্নেহে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরেন জবাকে। তখনই বিশু ঘরে ঢুকে পড়ে। বিশুর কানে বিষ ঢেলে রেখেছিল তিতলি। তিতলির ওপরের ঘরেই এসে ওত পেতে বসে ছিল বিশু। কিন্তু জবার মুহূর্তের রূপান্তরে বিজনের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে। বিশুকে দেখে জবা বলে ওঠে, ‘ছাড়ুন, ছাড়ুন আমাকে।’ বলে বিজনের হাত ছাড়িয়ে ছিটকে সরে যায় জবা। কথাটা সে এমনভাবে বলে, যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিজন তাকে জোর করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেখানেই শেষ নয়, জবা নিজেকে নিরপরাধ সাব্যস্ত করতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বিজনের দিকে তর্জনী তুলে বিশুকে বলে, ‘দেখো না, উনি আমাকে...’
হন হন করে হাঁটছিলেন বিজন। ভোর হতেই হয়তো তাঁর খোঁজে বাড়িতে পুলিস যাবে। দিস ইজ আ কেস অব মলেস্টেশন। পুলিস বলবে, ‘আপনাকে একটু থানায় আসতে হবে। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’ পাড়া প্রতিবেশীর সামনে হেঁটে গিয়ে পুলিসের ভ্যানে উঠতে হবে। পাড়ার সব লোক ভিড় করে বিনে পয়সার সিনেমা দেখতে আসবে। এই কলঙ্ক কোনওদিন মুছে যাবে না। মানুষ এসব কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কথা ভোলে না। স্মৃতির দেরাজে সযত্নে ভ’রে রেখে দেয়। অবকাশ যাপনের জন্য দেরাজ খুলে বের করে জমিয়ে জাঁকিয়ে বসবে। পুরনো টিকেয় আবার নতুন করে আগুন জ্বেলে নিয়ে হুঁকোমুখোদের গুলতানি চলবে।