সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
তিন দিন পার হয়ে গেছে, তিনি আর ফিরে আসেননি। অথচ, হরণীধর দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে এলাকায় ঘুরছে! চুরি-চামারিও করে বেড়াচ্ছে বলে খবর এসেছে থানায়।
থানার মেজদারোগা বিস্মরণ নিয়োগী বড়বাবু চমকিতচরণ দত্তর মিসিং খবরটা উপরতলায় জানাজানি হোক, চাননি।
মেজদারোগার বিস্মরণ নাম তাঁর বিষম ভুলে যাওয়ার জন্য। ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। তাই তাঁর বাবা ওরকম নাম রেখেছিলেন। পরে অনেক চেষ্টায় ব্যায়াম-ট্যায়াম করে ভুলে যাওয়া অসুখটা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন। স্কুলে দু’-একবার ক্লাসে ফার্স্টও হয়েছিলেন।
মেজবাবু সাত-পাঁচ ভেবে হরণীধর দাসকে ডেকে দায়িত্ব দিলেন, বড়দারোগা চমকিতচরণ দত্তকে খুঁজে আনার জন্যে। বললেন, ‘হরণীধর, বড়বাবু যখন তোকেই খুঁজতে বেরিয়ে গেছেন, তখন তোরই দায়িত্ব, তাঁকে খুঁজে আনার। কি, ঠিক কিনা?’
ঠিক কি ভুল, এই ষাট বছর বয়সেও বোঝার ক্ষমতা একটুও বাড়েনি হরণীধরের। বাড়বে কী করে? হরণীধর রাতে চুরি করতে যায়, আর দিনে পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে কাটায়। তাই যথেষ্ট জল-আলো-বাতাসের অভাবে গাছ যেমন বাড়ন্তি হয় না, হরণীর বুদ্ধিবৃত্তিও দিনের আলোর অভাবে ছেলেবেলার মতোই অপরিপক্ব থেকে গেছে।
আজ হরণীধর দিনের বেলা এ গ্রামে ও গ্রামে ঘুরে ফিরে এসে থানায় মেজদারোগা বিস্মরণবাবুর কাছে রিপোর্ট করল, ‘ছ্যার, তেনাকে কোত্থাও পেলাম না!’
খাতা থেকে মুখ তুলে কপাল কুঁচকে মেজদারোগা মনে করার চেষ্টা করলেন মিনিট পাঁচেক। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন না, হরণী কাকে খুঁজে পেল না? হরণী কাকেই বা খুঁজতে গিয়েছিল? তাঁর নিজের বিস্মৃতির ব্যাপারটা এই বয়সে যাতে পাঁচকান না হয়ে যায়, তাই তিনি গম্ভীর গলায় ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘ঠিক আছে!’
হরণীধরের হাতে বেশি সময় নেই। ঝমঝম করে চারদিকে অন্ধকার নামছে! বাড়ি ফিরেই তাকে চুরি করতে বেরতে হবে। সে মনে মনে ভেবে দেখেছে, বড়দারোগাকে খোঁজার ব্যাপারে একটু-আধটু খামতি হলেও চলতে পারে। কিন্তু দুই বউ আর পাঁচ ছেলে-মেয়ের সংসার মাথায় নিয়ে চুরি করতে না বেরলে তার চলবে কী করে?
ঘণ্টা দুয়েক পরে যখন মেজদারোগা বিস্মরণবাবুর হঠাৎ ফস করে মনে পড়ে গেল, হরণীধর কাকে খুঁজে পায়নি! তখনই তিড়িং করে চেয়ার থেকে লাফ কেটে উঠে দাঁড়ালেন। একজন কনস্টেবলকে কড়া গলায় হুকুম করলেন, ‘এক্ষুনি দাগি চোর হরণীধর দাসকে থানায় এনে হাজির করো!’
কনস্টেবল ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এসে বলল, ‘স্যার, হরণীধর বাড়িতে নেই। তার দাদা ধরণীধর বলল, সে চুরি করতে বেরিয়ে গেছে।’
ছেলেবেলা থেকেই হরণী লোকের জিনিস ‘হরণ’ মানে চুরি করে বেড়াত বলে প্রতিবেশীরা ওর এরকম নাম রেখেছে।
টপাস করে কব্জিটা ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে নিয়ে ঘাড় নেড়ে মেজদারোগা বললেন, ‘যাবেই তো! যাবেই তো! ওর কি আর আমাদের মতো অত দেরি করলে চলে?’
এখনও তিন মাস হয়নি বড়দারোগা চমকিতচরণ দত্ত মায়াবীনগর থানা থেকে ট্রান্সফার হয়ে উদ্ভুট্টিডিহি থানায় এসেছেন। মায়াবীনগর ছেড়ে এসে এখানে এসে প্রথমে একদম মন বসেনি তাঁর। আজকালকার দিনে শহর ছেড়ে গাঁ-গঞ্জে পোস্টিং নিতে কারই বা ভালো লাগে? পুলিস লাইনে অনেকেই এই ধরনের ট্রান্সফারকে উপহাস করে বলে, ‘এসব হল পানিশেবল ট্রান্সফার।’
ট্রান্সফার হয়ে এখানে আসার পর দিন দশেক কেটেছে কি কাটেনি, হঠাৎ একদিন বিকেল থেকে বড় দারোগা চমকিতচরণের উদ্ভুট্টিডিহি জায়গাটা ভালো লাগতে শুরু করল। পাহাড়ছোঁয়া দিগন্ত, সবুজ গাছগাছালিতে ভরা জায়গাটা, অনেকটা পুরুলিয়া-পুরুলিয়া দেখতে। নীচে লাল মাটি, উপরে নীল আকাশ, চারপাশে সবুজ বন।
চমকিতচরণ দত্ত চাকরির জায়গায় কখনও কলকাতা থেকে মাথায় করে তাঁর সংসার বয়ে আনেননি। বর্ন ব্যাচেলরের মতো কাটিয়ে গেলেন সারা জীবন। আর তো বছর তিনেক। তবে বড়বাবু ভেবে দেখেছেন, নিরিবিলিতে নিজের মনের সঙ্গে কথাও বলা যায় এখানে।
উদ্ভুট্টিডিহিতে আসার পর স্থানীয় লোকজন বলেছিল, ‘আগে বসন্তটা আসতে দিন স্যার! দেখবেন কেমন পলাশ ফোটে!’
এখন তপ্ত গ্রীষ্ম। একটু জলের ক্রাইসিস আছে বটে। চাঁদি-ফাটা গরমও পড়েছে। তা হলেও জায়গাটা মন্দ নয়। বিকেলে আকাশপথে মালার আকারে দল বেঁধে পাখপাখালির ঘরে ফেরার সময় থেকে পরদিন সূর্য ওঠা পর্যন্ত চরাচর জুড়ে চমৎকার হিমেল বাতাস বইতে থাকে।
এখানে আসার পর থেকে বড় দারোগাবাবু থানার সামনেটায় খাকি রঙের পুলিস-প্যান্ট পরে, খালি গায়ে নীল রঙের প্লাস্টিকের হাতলওলা চেয়ারে বসে ভুঁড়িটা এলিয়ে দিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত হাওয়া খান। আজ তিন দিন এই দৃশ্য কারও গোচর হয়নি।
পুলিস-দারোগার ভুঁড়ি থাকা চলবে না— এরকম একটা ফতোয়া জারি করেছিলেন বটে দেশের মন্ত্রী। কিন্তু বড়লোকের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের মতো কেমন করে যে পুলিস-দারোগার ভুঁড়িও বেড়ে ওঠে, তা পুলিস-দারোগা কেন, কেউ বলতে পারে না!
আজ তিন দিন ধরে চমকিতচরণ দত্তকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই খবরটা মেজদারোগা বিস্মরণবাবু চেপে রাখলেও কেমন করে যে চাউর হয়ে গেল! ফোর্থ ডে-তে হেড অফিস থেকে দুপুর নাগাদ এসপি সাহেব ব্যাপারটার তল্লা করতে এসে হাজির হলেন।
এসেই তিনি তেন্ডাইমেন্ডাই করতে শুরু করে দিলেন, ‘বিস্মরণবাবু, আপনি থানায় মিসিং ডায়েরি লঞ্চ করেননি কেন?’
প্রথমে বিস্মরণবাবু মনে করার চেষ্টা করলেন, এসপি সাহেব কার বিরুদ্ধে মিসিং ডায়েরি লঞ্চ করতে বলছেন? কে মিসিং? কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। মনে মনে বললেন, ‘দুর ছাই! ভুলো মনের দোষে এবার পাকা চাকরিটা না চলে যায়!’
এসপি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?’
মেজদারোগা তাঁর মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেন। নিজের ওপর নিজেই রাগ করছিলেন মনে মনে, ‘কেন যে ঠিক কথাটা ঠিক সময়ে মনে পড়ে না!’
ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্যে শশব্যস্তে উঠে গিয়ে এসপি সাহেবের জন্যে জলখাবারের নির্দেশ দিয়ে এলেন। তারপর নিজের সিটে এসে বসার পরই টকাং করে মনে পড়ে গেল বিস্মরণবাবুর, ও হো! বড়সাহেব তো আজ তিন দিন ধরে নিখোঁজ হয়ে আছেন!
ততক্ষণে থানার বাইরে মহা হইচই শুনে সজাগ হয়ে বসলেন বিস্মরণবাবু। ফের মনে করার চেষ্টা করলেন, এখন বাইরে কী ঘটছে? কী ঘটতে পারে? কিন্তু তাঁর একবারও মনে পড়ল না, বড়সাহেব চমকিতচরণ দত্ত কি ফিরে আসতে পারেন?
এমন সময় হরণীধর দাস বীরদর্পে এসে ঢুকল মেজদারোগার ঘরে, ‘ছ্যার, বড় সাহেবকে পাকড়াও করে এনেছি!’
এসপি সাহেব পিছন ফিরে তার দিকে তাকিয়ে খি খি করে হাসতে লাগলেন। বিস্মরণবাবু মনে মনে বললেন, ‘যাঃ! আবার কী যে হয়ে গেল! এসপি সাহেবের হাসির কারণ তো মনে পড়ছে না?’
বিস্মরণ নিয়োগী হরণীকে দেখে মনে করতে পারলেন না, লোকটাকে চেনা-চেনা লাগছে বটে, কিন্তু লোকটার নামটা তো মনে পড়ছে না! কোথায় যেন কী কারণে লোকটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
তক্ষুনি ফের কী যে হল! বিস্মরণ নিয়োগী অমনি লাফ কেটে উঠে দাঁড়িয়ে এসপি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার মনে পড়ে গেছে স্যার! কী যে ভাবছিলাম, সেটাই তো মনে করতে পারছি না!’
ছোট ছেলেকে স্কুলের অ্যাডমিশন টেস্টে বাবা-মা যেমন করে বলেন— ‘বাবা, মনে করার চেষ্টা করো! এক্ষুনি মনে পড়ে যাবে!’ এসপি সাহেব ওরকম ভঙ্গিতে বললেন, ‘চেষ্টা করুন, চেষ্টা করুন! এবার সব মনে পড়ে যাবে! আপনার কিছু না মনে পড়লে আমি হেড অফিসে ফিরে গিয়ে কী বলব বলুন? আমাকেও তো চাকরিটা বাঁচাতে হবে?’
হরণীধর দাস হাত দুটো দু’দিকে মেলে ধরে বলল, ‘হুজুর, বড়সাহেবকে ধরে এনেছি!’
হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় দু’জন কনস্টেবল একটা হাতল-ছাড়া চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে এল চমকিতচরণ দত্তকে। তখনও তিনি ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছেন। চোখ মেলে তাকাতেই পারছেন না।
হরণীধর বলল, ‘উনি তাজ্জবগঞ্জের বাজারে তিন দিন ধরে এক যাত্রাদলের সঙ্গে ভিড়ে সারারাত ধরে হিরোর পার্ট করছিলেন আর দিনের বেলা নতুন পালার হিরোর রিহার্সাল দিচ্ছিলেন। উনি আসতে চাইছিলেন না। অনেক কসরত করে ধরে-বেঁধে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে এনেছি!’
এসপি সাহেব ধরণীর দিকে তাকিয়ে টকাস করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিস্মরণবাবুকে বললেন, ‘মশাই, আপনি উপায়টা তো ভালোই বের করেছেন!’
মোবাইলের টাওয়ার চলে যাওয়ার মতো আবার বিস্মরণবাবুর স্মৃতি চলে গেল। কিছুতেই মনে করতে পারলেন না কোন উপায়টার কথা বলছেন এসপি সাহেব? জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে থাকলেন।
এসপি সাহেব বললেন, ‘এই যে চোর দিয়ে দারোগা ধরার ব্যাপারটা, এ আপনার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।
আমি কলকাতায় হেড অফিসে ফিরে গিয়ে আপনার জন্যে মোটা অঙ্কের পুরস্কারের সুপারিশ করব।’ বলে উঠে পড়লেন এসপি সাহেব।
তখনই ফের বিস্মরণবাবুর মনে পড়ে গেল, ও হো, হরণীধরকে দিয়ে বড়বাবুকে খুঁজে আনার প্ল্যানটার জন্যে তারিফ করলেন এসপি সাহেব! মুখটা আত্মতৃপ্তিতে থইথই করে উঠল। হরণীধর ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘ছ্যার, আমি কিন্তু কথা দিয়ে এসেছি, বড়বাবুকে যাত্রাদলের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসব। কথার খেলাপ হলে চলবে না। নতুন পালার হিরো না পেলে ওরা কিন্তু ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে ছ্যার!’ তখন চমকিতচরণ দত্ত চেয়ারে হাত বাঁধা অবস্থায় বসে ঘুমে ঢলতে ঢলতে বলে উঠলেন, ‘ওরে পামর, আজি নিস্তার তব নাহি!’ বলে হাত বাঁধা অবস্থায় কোমরের কাছ থেকে তরবারি বের করার ভঙ্গি করতে লাগলেন।
বিস্মরণবাবুর দিকে ঝুঁকে হরণীধর নিচু গলায় বলল, ‘আপনাকে বলছেন না ছ্যার। ওটা যাত্রাপালার ডায়লেগ!’