সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের বাজার সরকার। মাসিক বেতন কুড়ি টাকা। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর কেমন লতায়-পাতায় আত্মীয়তা ছিল বলেও শোনা যায়। সামাজিক প্রতিপত্তি ও বংশ কৌলিন্যে গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার ঠাকুর পরিবারের সমকক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছায় শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হল মহর্ষির পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
কাদম্বরী দেবীর বয়স তখন নয়, এবং সুদর্শন ও নানাবিধ গুণ সম্পন্ন স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সেইসময় সদ্য উনিশের যুবক। বউ হয়ে ঠাকুর পরিবারে জীবন শুরু করলেন কাদম্বরী দেবী। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র সাতবছরের শিশু। তিনি খেলার সাথী হিসেবে কাছে পেলেন তাঁর নতুনদাদার স্ত্রী নতুন বৌঠানকে। দুই বালক-বালিকার মধ্যে সেদিন যে সুন্দর, পবিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা বজায় ছিল আজীবন। তাই নতুন বৌঠানের অকাল মৃত্যুকে একদম মেনে নিতে পারেননি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন লেখা ও কবিতায় সেই ‘বিষাদ’ বারে বারে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয় তাঁর প্ল্যানচেটের আসরে বহুবার এসেছেন নতুন বৌঠান। তবে কোনওবারই রহস্যময়ী কাদম্বরী দেবী নিজ নাম নিজ মুখে প্রকাশ করেননি। তাঁর উপস্থিতি একমাত্র বুঝেছেন রবীন্দ্রনাথ।
ঠাকুর পরিবারের এই বিবাহের খবর ১৮৭০ সালের শ্রাবণ সংখ্যার তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল—‘ গত ২৩ আষাঢ়, ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পঞ্চমপুত্র শ্রীমান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত কলিকাতা নিবাসী শ্রীযুক্তবাবু শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যার যথাবিধি ব্রাহ্মধর্মের পদ্ধতি অনুসারে শুভবিবাহ সমারোহপূর্বক সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। বিবাহসভায় বহু সংখ্যক ব্রাহ্ম এবং এতদ্দেশীয় প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণ সকল উপস্থিত ছিলেন। দরিদ্রদিগকে প্রচুর তক্ষ্যভোজে পরিতৃপ্ত করিয়া বিস্তর অর্থ প্রদান করাও হইয়াছিল।’
মহর্ষির ইচ্ছায় সম্পন্ন হওয়া এই অসম বিবাহকে কেন্দ্র করে শোনা যায় ঠাকুর পরিবারের অন্দরমহলে তীব্র বিদ্রোহের ঝড় ড়ঠেছিল। মহর্ষির দ্বিতীয় পুত্র বিলেত ফেরত আইসিএস অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী এই বিয়ে কোনওদিনই মেনে নেননি। জ্ঞানদানন্দিনী নাকি একথাও বলেছিলেন, বাবামহাশয়ের অন্যায় জেদের কারণেই এই বিয়েটা হল। নতুন মেনে নিল, কোনও প্রতিবাদ পর্যন্ত করল না। কিন্তু এই বিয়েতে কারও মঙ্গল হবে না! নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। কোথায় নতুন আর কোথায় ওর বউ!
এই বিয়েতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে খুব অখুশি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের এই লেখাটি পড়লে তা একবারও মনে হয় না। তিনি লিখছেন, ‘দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রুপার রেকাবিতে বেলফুলের গোড়ে মালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক গ্লাস বরফ দেওয়া জল আর বাটিতে ছাঁচি পান। বউঠাকরুন গা ধুয়ে, চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা, বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান। গলায় যেটুকু সুর দিয়েছিলেন বিধাতা তখনো তা ফিরিয়ে নেননি। সূর্যডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত আমার গান। হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভরে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার সবথেকে বড় সমালোচক ছিলেন তাঁর বউঠাকরুন। তিনি কবিকে লেখক বলে পাত্তাই দিতেন না। বলতেন, তুমি কোনওকালেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারবে না। এটা নিয়ে বড়ই আক্ষেপ ছিল রবীন্দ্রনাথের। তিনি লিখছেন, ‘বউঠাকরুনের ব্যবহার ছিল উলটো। কোনো কালে আমি যে লিখিয়ে হব, এ তিনি কিছুতেই মানতেন না। কেবলই খোঁটা দিয়ে বলতেন, কোনোকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারব না। আমি মনমরা হয়ে ভাবতুম তার চেয়ে অনেক নীচের ধাপের মার্কা যদি মিলত তাহলে মেয়েদের সাজ নিয়ে তাঁর খুদে দেওর-কবির অপছন্দ অমন করে উড়িয়ে দিতে তাঁর বাধ সাধত।’
সুখ ক্ষণিকের, সুখ হয় না দীর্ঘস্থায়ী! তাই সময় একদিন কাল থেকে কালান্তরে উড়িয়ে নিয়ে গেল দেওর- বউদির জীবনের সেই সুন্দর, মধুর মুহূর্তগুলিকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর নিজের জগতে। পরিবারের ইচ্ছায় রবীন্দ্রনাথ গেলেন বিদেশে। নিঃসঙ্গ কাদম্বরী দেবী বোধহয় তখন থেকেই তলিয়ে যেতে শুরু করলেন অবসাদের চোরাবালিতে। এরপরেই রবীন্দ্রনাথের জীবনে আসবেন মৃণালিনী দেবী। তাঁর অত্যন্ত আদরের ছোটবউ। ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃণালিনী দেবী বউ হয়ে এলেন ঠাকুর পরিবারে। আর তার ঠিক সাড়ে চারমাসের মাথায় ১৮৮৪ সালের ২১ এপ্রিল জীবন থেকে ঝরে গেলেন কাদম্বরী দেবী। তবে তিনি এর আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সেবার অবশ্য তিনি মৃত্যুর অতুলনীয় স্পর্শ পাননি, পেলেন পঁচিশ বছর বয়েসে।
এই অপঘাত মৃত্যু ও কাদম্বরী দেবী প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এক সময় কলম ধরেছিলেন। তিনি লিখলেন, ‘এই অসামান্যা নারী ছিলেন যেমন অভিমানিনী, তেমনি সেন্টিমেন্টাল এবং আরো বলিব ইনট্রোভার্ট, সিজোফ্রেনিক। অপরদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথও দোষক্রটির উর্ধ্বে ছিলেন না। পত্নীর প্রতি মনযোগী থাকিলে তাঁহার নিঃসন্তান জীবনের সঙ্গীহীন শূন্যতা কিছুটা পূরণ হইতে পারিত, তদ্বিষয়ে উদাসীনতাই দেখা যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যৌবনে নাট্যকার ও অভিনেতার খ্যাতি অর্জন করিয়া রঙ্গমঞ্চের নটনটীদের সহিত ঘনিষ্ঠ হইয়াছিলেন বলিয়া অপবাদ শোনা যায়। জানি না, এইরূপ কোনো সন্দেহের বশবর্তী হইয়া এই অভিমানিনী আত্মহত্যার চেষ্টা করিয়াছিলেন কিনা?’
১৯ এপ্রিল শ্যামা নামের কোনও মহিলার থেকে আফিম সংগ্রহ করে কাদম্বরী দেবী চললেন চিরঘুমের দেশে। তারপর দুদিন অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে তিনি অবশেষে চিরতরে হারিয়ে গেলেন। কিন্তু এই মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন দুজন মানুষ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেদিন মৃতা স্ত্রীকে দেখতে পর্যন্ত যাননি। নিজের ঘরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিলেন। নিজের স্ত্রীর মুখাগ্নি করতেও অস্বীকার করেছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ! তিনি আমৃত্যু পরম মমতায় নিজের হৃদয়ে লালন করেছিলেন তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীকে।
(ক্রমশ)
ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও
কাদম্বরী দেবী।