সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
ভারতের সংবিধানে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাময়িকভাবে ৩৭০ ধারা যুক্ত করা হয়েছিল। ৩৭০ ধারার মতো কোনও সাময়িক ব্যবস্থা ছাড়াই ৫৬০টির বেশি রাজন্যশাসিত রাজ্য ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। রাজন্যশাসিত এইসব রাজ্যে বিভিন্ন ঐতিহ্যশালী সম্প্রদায় বাস করত। কিন্তু ৩৭০ ধারার মতন কোনও বিশেষ ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা তাদের জন্য করেননি। কারণ, আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা ছিলেন জ্ঞানী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এখানে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি। তা হল জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া বাকি ৫৬০টির বেশি রাজন্যশাসিত রাজ্যের ভারতভুক্তির কাজটি করেছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। আর ওই রাজ্যগুলি আজ ভারতের অংশ বলে গর্বিত। জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। সর্দার প্যাটেল সেই সময় ছিলেন উপপ্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিই রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির বিষয়টি নিয়ে কাজ করছিলেন। ফলে, নেহরুর এই ভূমিকায় তিনি বিব্রতই হয়েছিলেন।
জম্মু-কাশ্মীরের সমস্যাটি ৭০ বছরের বেশি থেকে গেল। এই সমস্যায় ৪২হাজার মানুষের প্রাণ গেল। বন্দুকের নলের মুখে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উদ্বাস্তু হতে হল। তথাকথিত ওই বিশেষ ব্যবস্থায় ভারত-বিরোধী শক্তিগুলি উৎসাহ পেল। কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার ১১ বছর শেখ আবদুল্লাকে কারাবন্দি করে রেখেছিল। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত উপত্যকায় বছরে গড়ে ২০০ দিন কারফিউ থাকত। অতীত বিচার করলে নেহরুজির মানসিক যোগের ফলশ্রুতিতে জম্মু-কাশ্মীরের বিষয়ে বিষণ্ণ এই চিত্রই ফুটে ওঠে।
স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আমরা অবশ্যই সবথেকে যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নটি করব, তা হল এই ৩৭০ ধারায় কারা লাভবান হলেন? জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ তো নিশ্চিতভাবেই হননি। পাহাড়ি, শিয়া সম্প্রদায়, গুজ্জর, বাক্কারওয়ালস, গাড্ডি, অন্যান্য তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্তরা এবং লাদাখ ও কার্গিলের অধিবাসীরা এই ধারার থেকে কোনোভাবেই উপকৃত হননি।
সরকারের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের জন্য জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ সমস্যার মধ্যে ছিলেন। নতুন দিল্লি ভাবত, যদি জম্মু-কাশ্মীরের কয়েকটি পরিবারকে তুষ্ট রাখা যায় তাহলে ওই পরিবারগুলি রাজ্যের সব সমস্যা দূর করে ফেলবে। এই কয়েকটি পরিবার ৩৭০ ধারা ব্যবহার করে তাঁদের কুক্ষিগত ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আর যখনই দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উঠেছে, তখনই তাঁরা ৩৭০ ধারার আশ্রয় নিয়েছেন। আমলা এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির আশ্রয় নিলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবার জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন রয়েছে। অথচ ওই আইন জম্মু-কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। যেমন ছিল না শিক্ষার অধিকার আইন, বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ আইন, তথ্যের সুরক্ষা আইন, হাত দিয়ে ময়লা সাফাই প্রতিরোধ আইন। এগুলির আজ কীভাবে বিচার করা হবে? রাজ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যও ৩৭০ ধারা একটি বাধা ছিল। মানুষের
এখনও মনে আছে, দীর্ঘ সময় পরে অটল বিহারী বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সেখানে একটি সুষ্ঠভাবে নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছিল।
যাঁরা আজ ৩৭০ ধারার বিপক্ষে কথা বলছেন, আশ্চর্যজনকভাবে তাঁরা, সেনা আধিকারিক উম্মের ফয়াজ, রাইফেলম্যান ঔরঙ্গজেবের মতন বহু সাহসী কাশ্মীরি মুসলমানকে যখন নৃশংসভাবে জঙ্গিরা হত্যা করেছিল, সেইসময় নীরব ছিলেন।
৩৭০ ধারার অপব্যবহার করে রাজ্যের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের থেকে কীভাবে কয়েকটি পরিবার লাভবান হতো, সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল জগমোহনের লেখা বই ‘মাই ফ্রোজেন টারবুলেন্স’ থেকে। ওই সম্পদের অপব্যবহারের ফলে রাজ্যের রাজস্বের ক্ষতি হয়েছে। ওই অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না জম্মু-কাশ্মীরের আইন পরিষদ ১৯৫৬ সালে রাজ্যের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করেছিল। সেখানে তৃতীয় অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারায় লেখা ছিল “জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য এখন এবং ভবিষ্যতেও ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।“ ১৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদের তৃতীয় ধারায় উল্লেখ ছিল ওই (জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য এখন এবং ভবিষ্যতেও ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ) ধারাটির পরিবর্তনে কোনও আইন বা সংশোধনী রাজ্য বিধানসভার কোনও কক্ষে আনা যাবে না। যখন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের আইন পরিষদ একটি সংবিধান প্রণয়ন করে, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে—যে-কোনও অবস্থাতেই জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য এখন এবং ভবিষ্যতেও ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ—এই ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটানো যাবে না, তখন তো ৩৭০ ধারারই আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না।
৩৭০ ধারা ছিল পুরোপুরি একটি সাময়িক বন্দোবস্ত। প্রধানমন্ত্রী সঠিকভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন যে যাঁরা এটিকে সমর্থন করেন, তাঁদের এটিকে স্থায়ী করার সাহসও ছিল না। এটা খুবই জরুরি যে, যখন আইন পরিষদ সংবিধানকে কার্যকর করেছিল, সেই সংবিধান অনুযায়ী ১৪৭ ধারার সংশোধনের কাজ করতে পারে রাজ্য বিধানসভা। এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক ৩৭০-এর (৩) ধারা অনুযায়ী আইন পরিষদ বিবেচিত হবে রাজ্য বিধানসভা হিসেবে। যেহেতু রাজ্যে এখন রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে, তাই ভারতের সংবিধানের ৩৫৬-র ১-এর বি উপধারা অনুসারে সংসদেরই সংবিধানসম্মতভাবে সেই সংশোধনের ক্ষমতা রয়েছে।
সংসদে উভয় কক্ষে বিতর্কের সময় জম্মু-কাশ্মীরের সব অঞ্চলের বক্তব্য শোনা গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, বিজেপি ভারতের জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা হবে। আর বিজেপি বিপুলভাবে মানুষের সমর্থন পেয়েছে। আলোচনার সময় অনেকে বলেছেন, উত্তর পূর্বাঞ্চল ও উপজাতি এলাকার জন্য ৩৭০-এর মতো যে ধারাগুলি রয়েছে সেগুলিও বাতিল করা উচিত। কিন্তু, এই যুক্তি এখানে প্রযোজ্য নয়। ৩৭১ ধারার এ থেকে জে পর্যন্ত উপধারাগুলি সংবিধান অনুযায়ী বিশেষ সংস্থান। এগুলি সাময়িক বন্দোবস্ত নয়। তাই সেগুলি থাকবে। নতুন নতুন রাজ্য গঠনের সময় নির্দিষ্ট অঞ্চল বা নির্দিষ্ট জনজাতির উন্নয়নের জন্য এই বিশেষ সংস্থানগুলি করা হয়েছিল। এগুলি স্থায়ীভাবে করা হয়েছে।
কাশ্মীর উপত্যকার অনেক মুসলমান তরুণী যখন রাজ্যের বাইরের কাউকে বিয়ে করেছেন, তখন তাঁরা তাঁদের সব অধিকার হারিয়েছেন। সম্প্রতি আমার সঙ্গে সর্বভারতীয় কৃত্যকে কর্মরত এক তরুণী আধিকারিকের দেখা হয়েছিল। তিনি জম্মুর মেয়ে এবং হিন্দু। তিনি জানান, অন্য রাজ্যের বাসিন্দা এক সরকারি আধিকারিককে বিয়ে করায় তিনি জম্মু-কাশ্মীরের সব অধিকার হারিয়েছেন। অশ্রুসিক্ত অবস্থায় সেই আধিকারিক নরেন্দ্র মোদির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ৩৭০ ধারা বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতি সুবিচার করেছেন।
সরকারের উন্নয়নমুখী উদ্যোগের ফলে আজ শ্রীনগর, সোপোর, বাদ্গাম, ভারেরওয়া এবং জম্মুতে বিপিও সংস্থাগুলি দপ্তর খুলেছে। রাজ্যজুড়ে ৩১৫৮টি ‘কমন সার্ভিস সেন্টার’ কাজ করছে। এর ফলে নাগরিকরা সেখান থেকে নানা ডিজিটাল পরিষেবা পাচ্ছেন। যখনই আমার তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়, আমি তাঁদের চোখে আশার আলো দেখি। এইসব যুবক-যুবতী জানিয়েছেন, আরও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের আরও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত।
নিশ্চিতভাবেই জম্মু-কাশ্মীরের জন্য উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তির নতুন প্রভাত সূচিত হয়েছে। এর ফলে যাঁরা অবহেলিত ও বঞ্চিত হয়েছিলেন, তাঁরা এখন নানা সুযোগ-সুবিধে পাবেন। স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদতদাতারা এতে অখুশি, কিন্তু এই ভারতে তাঁদের কোনও ঠাঁই হবে না।
লেখক ভারতের আইন ও বিচার, যোগাযোগ এবং বৈদ্যুতিন ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী