সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর আকস্মিক অকাল মৃত্যুর পর দলের নিয়ন্ত্রণভার কয়েক বছর নরসীমা রাও সীতারাম কেশরীর মতো পোড়খাওয়া প্রবীণদের হাতে ছিল ঠিকই, কিন্তু সেসময়ের বড় বড় স্পর্শকাতর ঘটনায় কী ভিতরে কী বাইরে কংগ্রেস দলের আচরণ অভিব্যক্তি অনেকের কাছেই অনেক ক্ষেত্রে অচেনা ঠেকেছে! ঘটনাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের রাজনৈতিক তৎপরতা ও প্রতিক্রিয়াও দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গেও নানা সময় সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারেনি। আমজনতা কংগ্রেস দলের আচরণে খুঁজে পাননি তাঁদের চিরচেনা রাজনৈতিক ছন্দ। অযোধ্যার কথাই ধরা যাক। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে অযোধ্যার বিতর্কিত সৌধ যেদিন ভাঙা হল সেদিন কেন্দ্রে নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার, কংগ্রেস দলের প্রধান পরিচালক সভাপতিও তিনি! অথচ, কী প্রধানমন্ত্রী কী জাতীয় দলের সর্বপ্রধান কর্তা হিসেবে কী করলেন তিনি!? অযোধ্যার বিতর্কিত সৌধ ধূলিসাৎ হল প্রায় নির্বিঘ্নে—ইউপির কল্যাণ সিং সরকারের প্রশাসন-পুলিসের সঙ্গে কেন্দ্রীয়-বাহিনী নির্বিকারভাবে করসেবকদের সৌধনিধন দেখে গেল! এই চূড়ান্ত অপ্রীতিকর ঘটনার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে দেশজুড়ে আগুন জ্বলল—ঘর-বাড়ি পুড়ল, মানুষ মরল, কলকাতার মতো শান্ত নগরীতে পর্যন্ত দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, নামল সেনা—বাংলার সাম্প্রদায়িক প্রীতি ও সংহতির শত শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ম্লান হল! দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা অখণ্ডতা সংহতি ইত্যাদি নিয়ে নানা মহলে নানান অবাঞ্ছিত প্রশ্ন উঠে গেল!
এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নরসিমা সরকারের ভূমিকা খুব বলিষ্ঠ ছিল তা বোধকরি কেউই বলবেন না। বলবেন কীভাবে? অযোধ্যার বিতর্কিত সৌধ বিনাশের ঘটনায় ইনট্যালিজেন্সের ওই নজিরবিহীন ব্যর্থতার পরও নরসিমা সরকার তেমন কোনও কঠিন পদক্ষেপ করেছিলেন কি? কল্যাণ সিং সরকারের বিরুদ্ধেই বা তেমন কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় ভূরিভূরি প্রস্তাব পাঠের অন্ত ছিল না ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে তার কটা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল? কিছু প্রতিবাদ ছাড়া দেশের শাসক দল হিসেবে কংগ্রেসই বা আর কী করেছিল! এমন আরও ডজন ডজন প্রশ্ন বিস্ময় সেদিনের কংগ্রেস সরকার ও কংগ্রেস দল সম্পর্কে আজও হয়তো দেশের মনের কোণে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। এইসব প্রশ্নের সামনে দাঁড়ালে কে আর বলতে পারবেন—সেদিন সরকারের ভূমিকা বলিষ্ঠ ছিল। বলতে পারবেন, তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সৌধ বিনাশকারীদের বিরুদ্ধে দলকে জাগিয়ে তুলে দেশব্যাপী একটা তোলপাড় সাড়া ফেলে দিতে পেরেছিলেন?!
তথ্যভিজ্ঞরা অনেকে অবশ্য বলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল কংগ্রেসের সরকার ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই, ঘটনার প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে তড়িঘড়ি কোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তাঁরা। সেইসঙ্গে অযোধ্যা নিয়ে সরকারে এবং দলে কিছু ভিন্নমতের উদ্গম ব্যাপারটাকে আরও গুলিয়ে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে নিজেদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক ছন্দ হারিয়ে কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়েছিল নরসিমা নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। পরবর্তীতে দলের সভাপতি বদলে নরসিমার জায়গায় সীতারাম কেশরীর মতো দুঁদে কংগ্রেসিকে এনেও যে বিশেষ সুরাহা হয়নি ১৯৯৮ সালের মার্চে সোনিয়া গান্ধী স্বয়ং মঞ্চে প্রবেশ করে সভাপতির আসনে আসীন হয়ে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন!
কিন্তু শুরুতে সোনিয়াজিকেও একটা ধাক্কা খেতে হয়েছে। অটলবিহারী আদবানি যোশীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। প্রথমবার কদিনের জন্য, তারপর ফুলটার্ম রাজত্ব চালিয়েছেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। কার্গিল যুদ্ধ থেকে পোখরান পরমাণু বিস্ফোরণ—কত কিছুই না ঘটেছে তাঁর সময়কালে। পোখরানের পর ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে আত্মপ্রকাশ করেছে। তা সত্ত্বেও অবশ্য ২০০৪ সালে পতন ঠেকাতে পারেননি অটলজি আদবানিজির বিজেপি। দেশের মানুষ ফের একবার গান্ধী ফ্যামিলির প্রতি আস্থা বিশ্বাস দেখিয়ে ফিরিয়ে এনেছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকার। জনতার আশীর্বাদে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের ক্ষমতায় আসতেও অসুবিধে হয়নি। আর ক্ষমতায় থাকার মাহাত্ম্য এই যে, তখন সব কিছুকেই মনে হয় ‘শুভ্ শুভ্’ সব ঠিক হ্যায়—ফার্স্ট কেলাস। ফলে কংগ্রেস হাইকমান্ড তথা সভাপতি হিসেবে সোনিয়াজিকে অন্তত ২০১৪ অবধি দলের সর্বস্তরে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বেগ পেতে হয়নি। এমনকী কংগ্রেসি মন্ত্রী নেতাদের দুর্নীতি বা লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির মতো ইস্যুতে দেশ যখন উত্তাল তখনও সভাপতি হাইকমান্ড সোনিয়াজির উপর ভরসা রাখতে কসুর করেনি দল। তখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কারও কারও মন্তব্য শুনে মনে হতো, সোনিয়া গান্ধীর সভাপতিত্বে কংগ্রেস খানিকটা হলেও তাঁদের হারানো ছন্দ ফিরে পেয়েছে। এবং এতদ্বারা সোনিয়াজি এটাও প্রমাণ করে দিতে পেরেছেন, জাতীয় কংগ্রেসের হাল ধরতে গান্ধী ফ্যামিলির বিকল্প নেই।
কিন্তু, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালে নবরূপে বিজেপির প্রবল উত্থানের ধাক্কায় কংগ্রেসের আসন যখন সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা আদায়ের ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হল, এই মহাবিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে দিশেহারা দল, তখন যেন সবকিছু ওলটপালট হতে শুরু করল। তার উপর কিছুদিনের মধ্যেই এসে পড়ল সোনিয়াজির অসুস্থতা! কংগ্রেসের সর্বস্তরে যেন একটা বিপর্যস্ত আবহ তৈরি হয়ে গেল। শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতেই পারছিলেন—সোনিয়াজি অব্যাহতি চাইবেন, আর তাই নতুন নেতা চাই অবিলম্বে।
বলা বাহুল্য, অনিবার্য এবং অবধারিত পছন্দ সোনিয়া-পুত্র গান্ধী রাহুল। হলও তাই। প্রাথমিকভাবে গুজরাত সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের নজরকাড়া ফল কিছু সময়ের জন্য হলেও রাহুলের সুযোগ্যতার নির্ণায়ক হিসেবে দেশজনতার মনে জায়গাও পেল। কিন্তু, ২০১৯ সালের লোকসভা ফলে নরেন্দ্র মোদিজির রেকর্ড সাফল্য এবং কংগ্রেসের অবস্থার তেমন কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় (৪৪ থেকে ৫২ আসন) রাহুলে মোহভঙ্গ হল অনেকেরই। সেটা আন্দাজ করেই সরে দাঁড়ালেন রাহুল—সাফ জানালেন, আপাতত সভাপতি থাকবেন না তিনি। ব্যাস, ছত্রখান কংগ্রেস। দেখা গেল, তালাক থেকে ৩৭০ রদ—কোনও ইস্যুতেই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না কংগ্রেস! বরং, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ নিয়ে তো কংগ্রেসের অন্দরে-বাহিরে রীতিমতো মতপার্থক্য জনসমক্ষেই চলে এল! উত্তাল মাঝ সমুদ্রে ক্যাপটেনহীন জাহাজের মতো দেশ রাজনীতির গেরুয়া জোয়ারের মুখে রীতিমতো বিপর্যস্ত বিভ্রান্ত দেখাল কংগ্রেসকে! শক্ত হাল ধরার লোক খুঁজতে মুকুল ওয়াসনিক কুমারী শৈলজা থেকে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া—কত নামই না এল! টিকল না একটাও! ওয়াসনিকের নামটা চূড়ান্ত হয়েও হল না, নিন্দুকেরা বলছেন—স্বয়ং রাহুল নাকি তাঁর নামে সহমত হতে পারেননি। আর প্রিয়াঙ্কাও আপাতত গররাজি।
অগত্যা সেই সোনিয়াজি! শেষপর্যন্ত গান্ধী ফ্যামিলিতেই আস্থা রাখতে হল কংগ্রেসকে! এবং দলের স্বার্থে অসুস্থতা উপেক্ষা করে সোনিয়াজিকেই অন্তর্বর্তী হিসেবে সভাপতির দায়িত্ব নিতে হল! যুক্তি, বাইরের কেউ হলে দল ভেঙে যাবে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, সাময়িক হলেও সভাপতি পদে সোনিয়া গান্ধীর এই প্রত্যাবর্তনে কংগ্রেস কি হারানো ছন্দ ফিরে পাবে? কিছুটা তো পাবেই। তার কারণ, যত না সোনিয়াজির ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক কলাকৌশল, তার চেয়ে বেশি দলের সর্বস্তরে তাঁর অবিসংবাদী মান্যতা। গান্ধী পরিবারতন্ত্র নিয়ে যাঁরা খোঁচা দেন কংগ্রেসকে, তাঁরা হয়তো এটাকে নতুন সুযোগ ভেবে মজা পাচ্ছেন। কিন্তু, বাস্তবটা হচ্ছে—কংগ্রেস দল এখনও গান্ধী পরিবার নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি—কী প্রবীণ কী নবীন কোনও পক্ষই না! কংগ্রেসে গান্ধী পরিবারের প্রতি শর্তহীন আনুগত্যের ট্র্যাডিশন এখনও অব্যাহত।
সেই সুবাদেই হয়তো পরবর্তী স্থায়ী সভাপতি হিসেবে কংগ্রেসি রাজনীতিতে নবাগতা প্রিয়াঙ্কার নাম উঠে আসছে। অদূর ভবিষ্যতে তাঁকে সভাপতির আসনে দেখা যাবে কি যাবে না সেটা সময় বলবে। তবে, এটা নিশ্চিত—চট করে গান্ধী ফ্যামিলির বাইরের লোকের সভাপতির আসন লাভ মুশকিল। আর এক্ষেত্রে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা কংগ্রেসই। এই প্রতিকূলতা দূর করতে না পারলে কংগ্রেসের সর্বময় কর্তৃত্বে গান্ধীদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় থাকবে ঠিকই, তবে তাতে দলের পুরনো ছন্দ পুরোপুরি ফিরবে কি না তা নিয়ে দেশরাজ্যের রাজনৈতিক মহলের একাংশে যথেষ্ট সংশয় আছে। তাঁদের বক্তব্য, আজকের রাজনীতিতে গতি এবং ভেদশক্তির তীব্রতা ছাড়া সফল হওয়া মুশকিল। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহের মতো জবরদস্ত জুটির সঙ্গে সমানে সমানে লড়তে ওই দুইয়ের বিকল্প নেই। এবং এক্ষেত্রে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এর সার্থক দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরছেন। তাঁরা বলছেন, আনুগত্য দিয়ে নিষ্কণ্টক কর্তৃত্ব ভোগ করা চলতে পারে কিন্তু তার সঙ্গে গতি ও ভেদশক্তির সমন্বয় ঘটাতে না পারলে কংগ্রেসের পুরনো ছন্দে ফেরা বা আগামী দিনে সফল হওয়া খুব সহজ হবে না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা কি খুব ভুল বলছেন?