সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
এই ভদ্রলোক ঝুপড়ি থেকে পাকা স্টলের মালিক হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের জামানাতেই। আগে জলাধারের পাশে গুমটিতে ডোকরা, পুঁতি সহ হাতের কাজের মালপত্র নিয়ে বসতেন। সেই সব ঝুপড়ি, গুমটি এখন ঢালাই দেওয়া স্টল। সৌজন্যে মা-মাটি-মানুষের সরকার। মুকুটমণিপুরকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে এবং হস্তশিল্পীদের মাথার উপর ছাদ দিতে ৪০টির মতো স্টল তৈরি করেছে সরকার। সেই স্টলের একটি পেয়েছেন এই ছিপছিপে চেহারার মানুষটি। তৃণমূল পরিচালিত সরকারের বেনিফিশিয়ারি হলেও তাঁর মনে ‘পাওয়ার আনন্দ’ নেই। উল্টে বিস্তর ক্ষোভ।
না, এই স্টল মালিক বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং তৃণমূলের সঙ্গে সখ্যের সূত্রেই তাঁর কপালে জুটেছে সরকারি উদ্যোগে তৈরি স্টল। তবুও তাঁর মনে ক্ষোভ। ক্ষোভের কারণ, নিয়ম মেনে স্টল তৈরি না করা।
ওই স্টল মালিক বলছিলেন, দেখুন, এই স্টলগুলির উচ্চতা মাত্র সাত ফুট। সিলিং ফ্যান লাগালে হাত কেটে যাওয়ার ভয়। এমনিতেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় গরমে টেকা দায়। তার উপর ছাদের হাইট কম। বুঝতেই পারছেন, কী অবস্থা। যতদিন ব্যবসা করব, ততদিন এই যন্ত্রণা বইতে হবে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখুন, সরকার স্টলের হাইট ১০ ফুট করার কথাই বলেছিল। কিন্তু, কাটমানির লোভ ১০ ফুটকে টেনে করে দিল ৭ ফুট। তাহলে এবার বুঝুন, সরকার আমাদের ভালোর জন্য একটা প্রকল্প তৈরি করল, টাকা দিল। কিন্তু যাদের হাতে পড়ল, তারা এমন কাণ্ড ঘটাল যে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতার বদলে নেতাদের উপর মানুষ চটে গেল। ঠিকাদার মার্কা নেতাদের কৃতকর্মের সব দায় গিয়ে পড়ল সরকারের উপর।
চোখের সামনে সাত ফুট উচ্চতায় ঢালাই হচ্ছে দেখেও প্রতিবাদ করতে পারলাম না। মানে সাহসে কুলালো না। কারণ এখানে তো বেশিরভাগ নেতা হয় ঠিকাদার, না হয় সুপারভাইজার। দলটা ঠিকাদার, আর সুপারভাইজারদের দখলে চলে যাওয়াতেই যত বিপত্তি। তাই উন্নয়ন করলেই ভোটে জেতা যায়—এটা ভুল ধারণা। কৌশলী হতে হয়। উন্নয়নটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। সেই জন্যই বলছিলাম, শুধু মাস্টারের পিছনে টাকা ঢাললেই ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না, নজরদারি ভীষণ জরুরি।
উত্তরবঙ্গের সুদূর কোচবিহার থেকে দক্ষিণবঙ্গের ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, দলের চার আনা, আট আনা নেতাদের ঠিকাদার ও সুপারভাইজার হয়ে ওঠা এবং তাদের সঙ্গে ‘আত্মীয়তাই’ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। দল যাঁদের মাস্টারি করার দায়িত্ব দিয়েছিল, তাঁদের বেশিরভাগই এলাকায় গিয়ে কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক না করে বসতেন ‘ঠিকাদার নেতার’ সঙ্গে ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’ ঝালিয়ে নিতে। আর তাতেই সারা হয়ে যেত পর্যবেক্ষণের কাজ।
ঠিকাদারদের দল হয়ে গেলে পার্টির রসাতলে যেতে যে বেশি সময় লাগবে না—এই ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী। বর্ধমান টাউনহলে জলসম্পদ দপ্তরের এক অনুষ্ঠানে ফেটে পড়েছিল তাঁর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ। সেই সভায় বিনয়বাবু বলেছিলেন, আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, সরকার এখন মানুষের জন্য ভাবছে না। সরকার এখন ’ফর দ্য কন্ট্রাক্টর, অফ দ্য কন্ট্রাক্টর, বাই দ্য কন্ট্রাক্টর।’ প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতার সতর্কবার্তায় সেদিন সিপিএমের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা কর্ণপাত করেননি। উল্টে চরম অপ্রিয় এবং চরম সত্যি কথাটা বলে ফেলায় দলে তাঁকে তীব্র সমালোচিত হতে হয়েছিল। এমনকী, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পর্যন্ত তাঁকে ভর্ৎসনা করতে ছাড়েননি।
তৃণমূলের আমলে দলের মধ্যে ঠিকাদার ও সুপারভাইজারদের দাপট বেশ বেড়ে গিয়েছিল। আর সেটা মারাত্মক আকার নিয়েছিল ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতা দখলের পর। প্রায় বিরোধীশূন্য রাজ্যে সর্বত্র তৃণমূলের নেতারা নামে বেনামে ঠিকাদারিতে নেমে পড়েন। ‘টেন্ডার’ শব্দটিই হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের মধ্যে ড্রেন তৈরি হয়েছে। কিন্তু, সেই নিকাশি নালার জল কোথায় গিয়ে পড়বে, তা দেখা হয়নি। টাকা খরচ করাটাই উদ্দেশ্য হয়ে গিয়েছিল। কারণ যত উন্নয়ন, তত পকেটমানি।
হুগলি জেলার আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত পুরশুড়া বিধানসভায় তৃণমূলের বিপুল ভোটে পিছিয়ে থাকার পিছনেও এক যুব নেতার ঠিকাদারি ব্যবসা এবং ফুলেফেঁপে ওঠাকেই অনেকে দায়ী করছেন। ওই নেতার দাপটে দলের প্রবীণ এবং আদিদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছিল। বাঁকুড়ার খাতড়াতেও এক ঠিকাদার নেতার ভূমিকা জঙ্গলমহলে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বর্ধমান শহরেও এক প্রভাবশালী নেতার দাপট এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে শহরবাসী মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দলের বেশিরভাগ নেতা তাঁর কাজে ক্ষুব্ধ। কিন্তু কিছু করার নেই। কারণ দলের মাস্টারমশাইদের সঙ্গে তাঁর ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’।
বলা দরকার, জায়গার নামগুলি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই একই ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি জায়গায় এরকম কিছু দাপুটে নেতার জন্যই উন্নয়নের সুফল তৃণমূল ঘরে তুলতে পারেনি। অথচ ভোটের আগে দিস্তা দিস্তা অভিযোগ জমা দিয়েও দাপুটেদের ঠান্ডা করা যায়নি। কারণ দলের মাস্টারমশাইদের সঙ্গে দাপুটেদের সম্পর্ক অতীব ‘মধুর’। ফলে সমস্ত অভিযোগের পিছনেই কাণ্ডারীরা দেখতে পেতেন, ষড়যন্ত্রের গভীর ছায়া। পুলিসি ঘেরাটোপের লালগাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া কাণ্ডারীরা ভেবেছিলেন, প্রায় বিরোধীশূন্য রাজ্যে মানুষ হয়তো তাঁদের এভাবেই স্যালুট
জানিয়ে যাবে। তাই ঠান্ডিগাড়িতে বসে গুনগুনিয়ে গাইতেন, ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।’
কিন্তু তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়’ বলেও একটি গান আছে।
ইতিহাস শিক্ষা দেয়। ইতিহাসকে যাঁরা মনে রাখেন, তাঁদের ভবিষ্যতের পথচলা অনেক মসৃণ হয়। ইতিহাস শিক্ষা দিয়েছে, নেতাদের দলে টেনে নেওয়া যত সহজ, মানুষকে ধরে রাখা ঠিক ততটাই কঠিন। ভালোবাসা আর সম্মানে ঘাটতি হলেই মানুষ ২৩৬ থেকে একটানে ৩৬ করে দিতে পারে। আবার ৩৪ থেকে বাইশও হয়।
অম্বিকানগর, বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধের প্রত্যন্ত এলাকা। অত্যন্ত দুর্গম ও জঙ্গলঘেরা হওয়ায় ইংরেজ আমলে গোরা পুলিসকে ধোঁকা দিতে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই এলাকায় গা ঢাকা দিতেন। বারিকুলের ছেন্দাপাথর ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিরাপদ আস্তানা। কথিত আছে, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু গোরা পুলিসদের নাগাল এড়াতে এই ছেন্দাপাথরেই আত্মগোপন করেছিলেন।
সেই দুর্গমতার জন্যই রানিবাঁধ হয়ে উঠেছিল ‘মাওবাদীদের অভয়ারণ্য’। খুন আর অপহরণের আতঙ্কে রাত জাগত জঙ্গলমহল। সন্ধ্যার আগেই ঝুপ ঝুপ করে পড়ে যেত দোকানের ঝাঁপ। কিন্তু, সেই রানিবাঁধ, সেই বারিকুল, সেই অম্বিকানগর এখন এতটাই মসৃণ যে কোনও রকম ঝাঁকুনি ছাড়াই কলকাতা থেকে চলে আসা যায় মুকুটমণিপুর। নিরাপত্তা এখন এতটাই সুনিশ্চিত যে গভীর রাতেও বাড়ির বাইরে থাকা লোকজনের জন্য পরিবারের দুশ্চিন্তা হয় না। সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিন্দুকও একথা স্বীকার করে। তবুও...।
লোকসভা ভোটে বহু আসনে হেরেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। বিপুল ভোটে। কারণটা শোনা যাক গুরুপদ প্রামাণিকের মুখে। গ্রামের মধ্যে একটা ছোট্ট সেলুনে চুলদাড়ি কেটে তাঁর সংসার চলে। গুরুপদ একজন ছাপোষা মানুষ। গুরুপদর অবস্থা হরিপদ কেরানির চেয়েও খারাপ। কিন্তু, মেরুদণ্ডটা এখনও ঠিকঠাক, সোজা। ভোট বিপর্যয়ের পরেও মার খাওয়ার ভয়ে আত্মগোপন করতে হয়নি। এখনও নিজেকে তৃণমূল কর্মী বলেই দাবি করেন। ভোলও বদলাননি। গুরুপদ কিন্তু এই ফলে অবাক নন।
গুরুপদ বলেন, এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। আমাদের এখানে একটা গ্রামে আবাস যোজনার সাতটি বাড়ির অনুমোদন এসেছিল। তিনজন পেয়েছিল, চারজনকে দেওয়া হয়নি। কারণটা কী জানেন, নেতাদের দেওয়ার জন্য ওই চারজনের গোরু বা হাল কিছুই ছিল না, যা ওরা বিক্রি করতে পারত। একেবারে হতদরিদ্র। অথচ যারা কাটমানি দিতে না পারায় ঘর পেল না, তারা কিন্তু আমাদেরই লোক ছিল। এরপরেও ওদের ভোট আশা করা যায়?
১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ না করে কত লোকে টাকা পেত। তাতে যারা গতর খাটিয়ে টাকা নিত, তাদের রাগ হয়ে গেল। আমি এসবের প্রতিবাদ করেছিলাম বলে আমাকে ঘর থেকে বেরতে বাধা দিল। কারা বাধা দিল জানেন? এক সময় যারা লালপার্টির লোক ছিল। এরপরেও তৃণমূল জিতলে বা ভালো ফল করলে দলটা শুধরোত না। গুরুপদ চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে ভাঁড়টা ফেলে দিলেন।
অনেক আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। ফেরার জন্য পা বাড়তেই গুরুপদ সেলুন ছেড়ে পিছন পিছন এলেন। বললেন, তবে একটা কথা মনে রাখবেন, মানুষ তৃণমূলকে ফেলতে চায়নি, ধাক্কা দিতে চেয়েছে। এই ধাক্কায় যদি লোহার বিমে লাগা মরচে খসে যায় তাহলে ফের জঙ্গলমহল হাসবে। আর যদি উপর উপর রং করে দেওয়া হয়, তাহলে মরচে একদিন হয়তো গোটা বিমটাকেই খেয়ে ফেলবে।