সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
বাস্তবে কিন্তু তখনই ভোম্বলদাসদের কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। সঙ্গে আরও কারণ আছে অবশ্যই। আমরা অতটা ঠাহর করতে পারিনি, এই যা। বাঘের জনসংখ্যায় (বাঘ-সংখ্যায়) টান ধরে গিয়েছে তখনই। পৃথিবী জুড়েই। আসলে ‘পৃথিবী জুড়ে’ কথাটা তো এক্ষেত্রে গৌরবে বহুবচন। এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঘের বাসভূমি তো আমাদের ভারতবর্ষের জঙ্গলগুলি। গত শতকের সাতের দশকের গোড়াতেই পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা কমে যায় বিপজ্জনক ভাবে। মনে আছে, হরতকী গ্রামের বাঘা বাইন জঙ্গলে গিয়ে বাঘের ভয় পায়, কিন্তু দেখা পায় না বাঘের। ওই যে উপেন্দ্রকিশোর লিখেছেন, ‘বাঘে খাবে দূরে থাক, সে বনে বাঘ-ভালুক কিছু নেই।’১৯৭৩ সালেই ভারত সরকার শুরু করে ‘প্রোজেক্ট টাইগার’। অনেকটা যেন 'বাঘ বাঁচাও' প্রকল্প। যেন আগে থেকে সাবধান হওয়া যাতে এমন দিন না আসে যে, উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের বাঘগুলি সম্পর্কে আমাদের বলতে হয়, “হ্যাঁ, বাঘ নামে এক প্রাণী এক সময় ছিল পৃথিবীতে...”।
কিন্তু ২০১০ সাল নাগাদ দেখা গেল যে, গোটা পৃথিবীতে বাঘ মাত্র ৩,২০০টি। পরিবেশের বদল, খাদ্যে টান, বাঘেদের বাসস্থান ধ্বংস এবং নির্বিচারে বেআইনি বাঘ শিকার, এসবের মিলিত ফলশ্রুতিতে। সে বছর ভারত-সহ পৃথিবীর ১৩টি বাঘ-সমৃদ্ধ দেশ বৈঠকে বসে রাশিয়ায়। সেন্ট পিটার্সবার্গে। পরিকল্পনা হয় বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর। লক্ষ্য পরিষ্কার। ২০২২-এর মধ্যে দেশগুলি যাতে দ্বিগুণ করতে পারে নিজ নিজ দেশের বাঘের সংখ্যা। ভারত কিন্তু, অন্তত, সেই লক্ষ্যে পৌঁছেছে এর মধ্যেই, ২০১৮-র হিসেবে।
২০১৮-র চতুর্থ বাঘ-শুমারি অনুসারে এদেশে এক বছর বয়সের ঊর্ধ্বে থাকা বাঘের সংখ্যা ২,৯৬৭। চার বছর পরে পরে হয় এই বাঘ গোনার কর্মকাণ্ড। ২০০৬-এর বাঘ-শুমারিতে এদেশে বাঘ ছিল ১,৪১১টি, ২০১০-এ তা দাঁড়ায় ১,৭০৬টিতে, আর ২০১৪ সালের তৃতীয় বাঘ-শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ছিল ২,২২৬টি। তাই, এটা পরিষ্কার যে, বাঘের অনুকূল বাসস্থান, খাদ্য ইত্যাদির সংরক্ষণ করা এবং ভোম্বলদাসদের আটকাতে ভারত মোটামুটিভাবে বেশ সফল এই সময়কালে। পৃথিবীর মোট বাঘের সংখ্যা এখন মোটামুটি ৩,৯০০-র মতো। তাই ২০১৮-র হিসেব অনুসারে পৃথিবীর ৭৭ শতাংশ বাঘই এখন ভারতে। তাই ভারতে বাঘ সংখ্যায় বাড়লেও, অন্যান্য জায়গায় মোটের উপর বাঘের সংখ্যা যে কমে এসেছে এই সময়ের মধ্যে, সেটাও পরিষ্কার।
এবারের বাঘ-শুমারির হিসেব অনুসারে কোনও বাঘ নেই উত্তরবঙ্গের বক্সার ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্রে। এনিয়ে বিস্তর হইচই আর আলোচনা চলছে মিডিয়াতে। বিশেষ করে বাংলার মিডিয়াতে। তবে, সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যার হিসেবটা একবার দেখা যেতে পারে। ২০১০-এর শুমারিতে ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা ছিল ৭০। গত ২০১৪-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬, আর এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮-তে। তাই একটু একটু করে উজ্জ্বল হলুদ হয়ে উঠছে আমাদের সুন্দরবন।
বাঘ গোনার কাজটা কিন্তু মানুষ গোনার চাইতে ঢের কঠিন। বাঘেরা ঘুরে বেড়াবে ঘন জঙ্গলে। গভীর জঙ্গলের গভীরতম অংশে সমীক্ষা করতে যাবে কে? কীভাবে? এমনিতে জঙ্গলের বাঘকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। তার উপর খুঁজে পেতে তাকে পাশে বসিয়ে মানুষের আদমশুমারির মতো প্রশ্ন করে ফর্ম ভর্তি করার মতো উপেন্দ্রকিশোরীয় গল্প তো বাস্তবে সম্ভব নয় একেবারে। বাঘগুলিকে লাইনে দাঁড় করিয়েও পটাপট গুনে ফেলা সম্ভব নয়। তাই বাঘ গোনাটা হয় একেবারে অন্যভাবে।
আসলে গোনা যায় বা দেখা যায় কিছু সংখ্যক বাঘ, আর সেই সঙ্গে অনুমান করা হয় না দেখা বাঘের সংখ্যা। যোগ করা হয় এই দুটো সংখ্যাকে। ২০১৪-তে যেমন দেখা আর অনুমান করা বাঘ যথাক্রমে মোট সংখ্যার ৭০ আর ৩০ শতাংশ। ২০১৮-তে দেখে গোনা বাঘের সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি। দেখা বা অন্য কোনও সূত্রে খোঁজ পাওয়া বাঘ এবার ৮৩ শতাংশ। কিন্তু বাঘের খোঁজ পাবার পদ্ধতিটাও বদলাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
প্রায় বছর পনেরো আগে কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে আমার কয়েকজন সহকর্মী বাঘের পায়ের ছাপ থেকে সুন্দরবনের বাঘ গোনার জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক প্রোজেক্টে এক সফটওয়্যার তৈরি নিয়ে কাজ করেছিল। এমনিতে বাঘের পায়ের ছাপ একেবারেই আলাদা আলাদা। ধরা যাক, সেটাই বাঘের স্বাক্ষর। পায়ের ছাপ বলতে চারটে করে আঙুল, আর প্যাডের ছাপ। বাঘ বদলালে বদলে যাবে এই বিভিন্ন আঙুল আর প্যাডের দূরত্বগুলি। বাঘের পায়ের ছাপের প্লাস্টারের ছাঁচগুলি থেকে অনুমান করা হয়েছে বাঘের সংখ্যা, রাশিবিজ্ঞানের তত্ত্বের প্রয়োগ করে। আর সেই সঙ্গে রাশিবিজ্ঞানের সাহায্যেই অনুমান করা হয় ছাপ পাওয়া যায় নি এমন বাঘের সংখ্যা।
সময় বদলেছে। বদলেছে বাঘ গোনার প্রযুক্তিও। ২০১৮-তে বাঘ গুনতে চষে ফেলা হয়েছে দেশের ৩ লক্ষ ৮১ হাজার বর্গ কিলোমিটার জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে যাওয়া হয়েছে ৫ লক্ষ ২৩ হাজার কিলোমিটার ফুট। দেশের ১৪১টি অঞ্চলের প্রায় ২৭ হাজার জায়গাকে আনা হয়েছে ক্যামেরার আওতায়। তোলা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ছবি, যার মধ্যে বাঘের ছবি প্রায় ৭৭ হাজার, আর চিতার ছবি প্রায় ৫২ হাজার। এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে আরও নানা ধরনের তথ্য—গাছপালা, অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। এ এক বিপুল তথ্য। এইসব তথ্য সংগ্রহে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রায় ৪৪ হাজার কর্মকর্তা আর ৫৫ জন জীববিদ্যা-বিশারদের একযোগে মোট ৬ লক্ষ মানব-দিবসের ফল এবারের এই বাঘ-শুমারি। এই বিপুল তথ্যকে বিশ্লেষণ করে পাওয়া গিয়েছে ২,৪৬১টি বাঘের খোঁজ। বাকি শ’পাঁচেক বাঘ অনুমান করা হয়েছে অন্যান্য তথ্যের উপর নির্ভর করে রাশিবিজ্ঞানের ব্যবহারে।
দেখা যাচ্ছে, বাঘ সংরক্ষণে বেশ ভালোই কাজ করছে ভারত। তাই, মোটের উপর বলা চলে, এদেশের বনে বাঘ আছে। এবং তারা বাড়িয়ে চলেছে তাদের সংখ্যা। বছরে ৬ শতাংশ হারে। তবে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়। দেশের নানা প্রান্তের জঙ্গলের মধ্যে বাঘের বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, সংরক্ষণ করা, এবং সেই সঙ্গে ভোম্বলদাসদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করা খুব সহজ নয়। চার ভাগের এক ভাগ বাঘই মারা যায় চোরা-শিকারের ফলে। গোটা পৃথিবীর মধ্যে বাঘের প্রধান বাসভূমি আমাদের এই দেশ, আর তাই আমাদের দায়িত্ব অবশ্যই খানিক বেশি। যাই হোক, আপাতত আমরা বেশ গর্বের সঙ্গেই বলতে পারি যে, আমাদের বনে জঙ্গলে ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’, এবং বেশ ভালোভাবেই।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত