সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
স্বাধীনতার পূর্বে জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি হতেন বরেণ্য জাতীয় নেতারা। সে সময় কংগ্রেস সভাপতি রাষ্ট্রপতি নামে বন্দিত হতেন। তবে টানা বিশ বছর কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সোনিয়া গান্ধী রেকর্ড স্থাপন করেছেন। অথচ মহাত্মা গান্ধী মাত্র এক বছর কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন। নেতাজি সুভাষ দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি হওয়ায় কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিরাগভাজন হন এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আবার গান্ধীজির নির্দেশমতো স্বাধীনতার পূর্বে কংগ্রেস সভাপতি হন তাঁর প্রিয় শিষ্য জওহরলাল নেহরু। অচিরেই তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হন।
স্বাধীনতার পর কংগ্রেস আর জাতীয় আন্দোলনের মঞ্চ রইল না। রাষ্ট্র নির্মাণের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কংগ্রেস একটি রাষ্ট্রবাদী দলে পরিণত হল। নেহরু প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভাপতি দুটি দায়িত্ব সামলেছেন। পরে কংগ্রেস সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। সংসদীয় গণতন্ত্র ও পরিকল্পিত অর্থনীতির ইমারত গড়ায় তিনি ছিলেন অগ্রণী। তবে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তিনি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেননি। চীন ও পাকিস্তান এই দুই প্রতিবেশী দেশের বৈরী আচরণে তিনি মর্মাহত হন। পাকিস্তান শুরু থেকেই ভারত-বিরোধী ভূমিকা নেয়, আর চীনের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপনে নেহরু সচেষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত চীন ভারত আক্রমণ করে (১৯৬২)। হতাশা নেহরু আর দু’বছর বেঁচেছিলেন। তবে তাঁর সময়ে কংগ্রেস কেন্দ্রে ও অঙ্গরাজ্যগুলিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বজায় রাখতে পেরেছিল। তবে তিনি বুঝেছিলেন দলের ভাবমূর্তি ও সাংগঠনিক শক্তিতে চিড় ধরেছে। তাই কামরাজ পরিকল্পনা নিয়ে সংগঠনকে মজবুত করার চেষ্টা চালান।
কিন্তু ১৯৬৯ সালে মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবর্ষে কংগ্রেস দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য সংঘাতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেস দলের প্রার্থী সঞ্জীব রেড্ডিকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী প্রার্থী ভি ভি গিরিকে সমর্থন জানালেন। এরপরেই কংগ্রেসে বিভাজন হল। ইন্দিরা তাঁর সমর্থকদের নিয়ে কংগ্রেস (আর) গঠন করেন। আর কংগ্রেস সংগঠনের শীর্ষ নেতারা কংগ্রেস (সংগঠন) নামে পরিচিত হলেন। ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়যুক্ত হয়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকার গঠন করেন।
১৯৭০-এর দশকে কংগ্রেস (আর) কার্যত কংগ্রেস (আই) বা ইন্দিরা কংগ্রেসে পরিণত হল। দলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ক্ষীণ হয়ে উঠল। কংগ্রেস দলের সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া বললেন, ‘ইন্দিরাই ভারত’ (Indira is India)। দলীয় গণতন্ত্রের বিনাশের পর দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আঘাত নেমে এল জরুরি অবস্থা জারি করার পর (জুন ১৯৭৫)। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর ১৯৮০ সালে ইন্দিরা বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে এলেন। ইতিমধ্যে পরিবারতন্ত্রের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সঞ্জয় গান্ধী দলে ও প্রশাসনে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে লাগলেন। সঞ্জয়ের অকাল প্রয়াণের পর ইন্দিরার জ্যেষ্ঠপুত্র রাজীব গান্ধী রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরার হত্যাকাণ্ডের দিনেই রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হলেন। একই সঙ্গে দলীয় সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী পদে রাজীব গান্ধী দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। এইভাবেই কংগ্রেসে নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রাধান্য কায়েম হল।
রাজীবের প্রয়াণের পর (১৯৯১ খ্রিঃ) কংগ্রেসে পরিবারতন্ত্রের ইতিহাসে ছেদ ঘটল। পি ভি নরসিংহ রাও ছিলেন নেহরু-গান্ধী পরিবারের বাইরের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পাঁচ বছর পর কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যস্ত হল। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দু’বছর কংগ্রেসের সমর্থনে অ-বিজেপি দলগুলি ক্ষমতায় বসে। এরপর এল বিজেপি’র নেতৃত্বে এনডিএ সরকার। ১৯৯৮-এর মার্চ মাসে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস সভানেত্রীর পদে আসীন হলেন। তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে দশ বছর ধরে ইউপিএ সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃত হলেন। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেন। তবে ইউপিএ সরকারে সোনিয়াই ছিলেন অন্তরাত্মা ও শেষ কথা। সঞ্জয় বারু রচিত The Accidental Prime Minister গ্রন্থে দেখা যায় কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করা হয়। সরকারের নীতি নির্ধারণে ইউপিএ-র চেয়ারপারসন তথা কংগ্রেস সভানেত্রী ছিলেন মূল পরিচালিকা শক্তি। এ যেন সিংহাসনের পশ্চাতে শক্তির আস্ফালন। কিন্তু ইউপিএ সরকারের আমলে দুর্নীতির চরম স্ফীতি সারা দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। জাতীয় কংগ্রেসের ভাবমূর্তি বিপন্ন হল।
এই প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ বিপুলভাবে জয়যুক্ত হয়। বিজেপি একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। বিগত ত্রিশ বছরে কোনও একটি দল একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কংগ্রেস দলের আসন সংখ্যা ৪৪-এ নেমে এল। ইতিপূর্বে আর কখনও এতটা ভরাডুবি হয়নি। লোকসভায় বিরোধী দলের তকমা জুটল না। ২০১৯-এর বিগত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস হৃতগৌরব ফেরাতে ব্যর্থ হল। ইতিমধ্যে ২০১৭ সালের অক্টোবরে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস দলের সভানেত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধীকে সরাসরি কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হল। রাহুল প্রথম দিকে দলের শক্তি বৃদ্ধিতে তৎপর হলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সুর চড়ালেন।
রাজ্যস্তরে বিধানসভা নির্বাচনে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস সরকার গঠনে সক্ষম হল। মনে হচ্ছিল বুঝি কংগ্রেস কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু সব কিছু ব্যর্থ হল। রাহুল দুটি আসনে দাঁড়িয়ে গান্ধী পরিবারের শক্ত ঘাঁটি নামে পরিচিত আমেথি কেন্দ্রে পরাজিত হলেন। রাহুল বুঝি এরকম বিপর্যয় হবে তা কল্পনাও করেননি। নির্বাচনে পরাজয়ের দায়-দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। শত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। আড়াই মাস অচলাবস্থা চলার পর গত ২০ আগস্ট কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি রাহুলের পদত্যাগ গ্রহণে বাধ্য হলেন এবং অন্তর্বর্তী সভাপতি হিসেবে তাঁর মা প্রাক্তন সভানেত্রী সোনিয়ার নাম গৃহীত হল।
পরিষ্কার হয়ে গেল পরিবারতন্ত্র ভিন্ন কংগ্রেসের কোনও গতি নেই। কংগ্রেসে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, উপদলীয় সংঘাত ও কংগ্রেস থেকে অন্য দলে যোগদানের হিড়িক বন্ধ করে কংগ্রেসকে টিকিয়ে রাখতে পরিবারতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সভানেত্রী কি কংগ্রেস দলের সজীবতা, শৃঙ্খলা ও সংহতি সুনিশ্চিত করতে পারবেন? গণভিত্তির উপর দলীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত না হলে দলের ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। বিজেপি’র দলীয় শৃঙ্খলা, সাংগঠনিক শক্তি, দলীয় কর্মীদের উদ্যোগ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের পাশে কংগ্রেস তার অতীত ঐতিহ্যকে পুঁজি করে কতদূর এগবে সেই বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়।