সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
এই মরুবাসিনী ওশিয়াঁ মাতার কথা শুনেছিলাম জয়পুরের এক ভক্ত তীর্থযাত্রীর মুখে। কিন্তু কেমন করে কীভাবে যাব, তা সঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে না পারায় মনের দিক থেকে তেমন কোনও উৎসাহ পাইনি।
সে বার যোধপুরে গিয়ে মাণ্ডোর উদ্যানে অজিত পোলের পাহাড়ের গা কেটে খোদাই করা কতকগুলি দেবদেবীর মূর্তি দর্শন করে নাগগঙ্গায় এসে জনৈকের মুখে ওশিয়াঁ মাতার স্থানে যাওয়ার পর নির্দেশ পেলাম।
আমি যোধপুরে বার তিনেক গেছি। সস্তার ঠেক হিসেবে ওখানকার সরাইখানায় থাকি। ওশিয়াঁর অবস্থান জানতাম না। এখন তাই পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিলাম ওশিয়াঁয় যাওয়ার।
মাণ্ডোর থেকে ফিরেই পরদিন সকালে চলে এলাম যোধপুর শহরের সরকারি বাসস্ট্যান্ড রায়কাবাগে। এখান থেকেই ওশিয়াঁর বাস ছাড়ে। সকাল সাতটায় বাস ছাড়ল। এই বাসের অধিকাংশ যাত্রীই চলেছেন ওশিয়াঁ মাতার পুজো দিতে। আমিও তাঁদেরই একজন হয়ে গেলাম। শহর ছেড়ে বাস মরুরাজ্যে ‘মথানিয়া’ নামে একটি ছোট্ট জনপদে এসে থামল। এ পথে মরুভূমি ঠিক গোবি, সাহারার মতো নয়। বালিতে মাটির মিশ্রণ আছে। আছে নানারকমের কাঁটাগাছ, ফণিমনসা, আকন্দ ও বাবলাগাছের সমারোহ।
আর আছে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। যাই হোক, প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাস এসে পৌঁছল ওশিয়াঁয়। ওশিয়াঁ মাতাকে এখানকার লোকেরা বলে সিচ্চাই মাতা।
মরুভূমির মাঝখানে খোলার ঘরের একটি বস্তির সামনে বাস থেকে নেমে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ওশিয়াঁ মাতার জয়ধ্বনি দিতে দিতে বস্তির ভেতর দিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। ওসওয়াল জৈন সম্প্রদায়ের আদি বসতি বলেই জায়গাটার নাম ওশিয়াঁ। স্থানটি আগে উপকেশপত্তনের অন্তর্গত ছিল। যাই হোক, পায়ে পায়ে কিছু পথ যাওয়ার পরই মন্দির মার্গে পৌঁছলাম। সেখানে সারি সারি দোকানগুলোতে পূজা সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। সিঁদুর, নোয়া, শাঁখা, লাল চেলি, ধূপ, নারকেল, এলাচিদানা কত কী।
এখানেই একটি টিলার মতো উচ্চস্থানে ওশিয়াঁ মাতার মন্দির। মরুভূমির মাঝখানে এমন সুরম্য মন্দির দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কারুকার্যমণ্ডিত মণ্ডপ অতিক্রম করে ওপরে উঠতে হয়। খানিক ওঠার পরই প্রকৃত মরুভূমির রূপ দেখে উল্লসিত হলাম। সমুদ্রের তরঙ্গের মতো সীমাহীন বালির স্তর দিগন্তে বিলীন হয়েছে এখানে।
মরুভূমির দৃশ্য দেখার পর দেবী দর্শনে মন দিলাম। আরও কয়েক ধাপ উঠতেই বজরঙ্গবলীর দর্শন পেলাম। এরপর দেবী দর্শন। মূল মন্দিরে শতাধিক স্তম্ভ। গর্ভমন্দিরে ওশিয়াঁ মাতার সঙ্গে ভৈরব, সন্তোষীমাতা ও শীতলা। এছাড়াও মন্দির চত্বরে আছে বেশ কয়েকটি বড় বড় মন্দির। যেমন— অষ্টম দুর্গা, মহাগৌরী, শ্রীশ্রী চণ্ডিকামাতা, রাধাকৃষ্ণ ও আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির। এঁদের মাঝখানেই বিরাজ করছেন ওশিয়াঁ মাতা বা সিচ্চাই দেবী।
এবার ওশিয়াঁ মাতার কাহিনী প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক— উপকেশপত্তনের অধীশ্বর ছিলেন উৎপলদেব। তাঁর আরাধ্যা দেবী ছিলেন চামুণ্ডা। তাঁর রাজত্বকালে জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের ষষ্ঠতম স্থলাভিষিক্ত আচার্য রত্নগর্ভ একবার পাঁচশত শিষ্য নিয়ে হঠাৎ উপকেশপত্তনে উপস্থিত হলেন এবং নগরের বাইরে লুণাদ্রী পল্লিতে অবস্থান ও সাধনভজনের পর আচার্যের কয়েকজন শিষ্য ভিক্ষার্থে নগরে গেলেন। কিন্তু গেলে কী হবে? শূন্য হাতেই ফিরে আসতে হল সকলকে। কেন না উপকেশপত্তনের সবাই তন্ত্রাচারে অভ্যস্ত বলে আমিষভোজী। ওদিকে জৈন সম্প্রদায় নিরামিষাশী বলে আহার না পাওয়ার কারণে ফিরে এলেন। রত্নপ্রভর পার্শ্বচর উপাধ্যায় বীরধবল তখনই সেই স্থান ত্যাগের পরামর্শ দিলেন সকলকে। স্থান ত্যাগের সিদ্ধান্ত যখন পাকা নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা সে রাতে রত্নপ্রভকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে চাতুর্মাস্য করার নির্দেশ দিলেন। জৈন সম্প্রদায় অবশ্য হিন্দু দেবীর এই স্বপ্নাদেশ অমান্য করলেন না।
এর ঠিক কয়েকদিন পরেই উৎপলদেবের জামাতা সর্পাঘাতে মারা গেলেন। মৃতদেহ যখন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল দেবী চামুণ্ডা এক সন্ন্যাসীর বেশে শ্মশানযাত্রীদের সামনে এসে বললেন, ‘একি! এই জীবন্ত মানুষটাকে তোমরা শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছ? ছিঃ।’ বলেই অন্তর্হিত হলেন। সবাই তখন সৎকার ফেলে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন সন্ন্যাসীকে। এমন সময় হঠাৎই গিয়ে পড়লেন রত্নপ্রভর আশ্রমে। তাঁকে দর্শনমাত্রেই চিনতে পারলেন সবাই। ইনিই তো সেই সন্ন্যাসী। সবাই তাই লুটিয়ে পড়লেন রত্নপ্রভর চরণে। এমন সময় দৈববাণী হল, ‘রত্নপ্রভর পাদোদক সিঞ্চন করলে মৃত ব্যক্তি তাঁর প্রাণ ফিরে পাবেন।’ বলা বাহুল্য রত্নপ্রভর চরণ ধোয়া জল মুখে দিতেই প্রাণ ফিরে পেলেন জামাতা। রাজাদেশে সেই থেকে উপকেশপত্তনে ‘জৈনং জয়তী শাসনং’ প্রচলিত হল।
রত্নগর্ভর চাতুর্মাস্য পূর্তির তখনও অল্প কয়েকদিন বাকি। এমন সময় এক বিস্ময়কর ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভগবান মহাবীরের একটি মূর্তিও আবিষ্কৃত হল। ঘটনাটি এই—
উৎপলদেবের মন্ত্রীর একটি দুগ্ধবতী গাভী ছিল। কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছিল সেই গাভীটি যখন চরভূমি থেকে ফিরে আসে তখন সে সম্পূর্ণ দুগ্ধহীন। এই দেখে তার রাখাল একদিন গাভীটিকে নজরে রেখে দেখে গাভীটি চরভূমির একটু উচ্চস্থানে গিয়ে দাঁড়ায় এবং সেখানেই আপনা থেকেই তার সমস্ত দুধ নিঃসৃত হয়। এই ব্যাপারটা মন্ত্রীকে জানালে তিনি লোকজন দিয়ে সেই স্থানে খনন করাতেই বালির ভেতর থেকে এক অপূর্ব মহাবীর মূর্তি আবিষ্কার হল। রত্নপ্রভ সেই মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন। এখানকার দেবী চামুণ্ডাই মহাবীর মন্দিরের অধিষ্ঠাতা এমন ঘোষণাও করলেন তিনি। দেবীর স্বপ্নাদেশে রত্নপ্রভর অভীষ্ট পূর্ণ হওয়ায় দেবীর নাম হল সাচ্চাই দেবী। কালক্রমে সেই সাচ্চাই দেবী এখন সিচ্চাই মাতাতে পরিণত হয়েছেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর চাতুর্মাস্য শেষ হলে রত্নপ্রভ বিদায় নিলেন। দর্শন শেষে আমারও এখন বিদায় নেওয়ার পালা। এই থর মরুর বুকে হিন্দু ও জৈন ধর্মের এমন সহাবস্থান সত্যই বিস্ময়কর।