প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
১৯২৮ সালের কংগ্রেস অধিবেশনের প্রাক্কালে গান্ধীজি মতিলাল নেহরুর একটি চিঠি পেলেন। ততদিনে তিনি কংগ্রেস সংগঠনের অঘোষিত সিদ্ধান্তপ্রণেতায় পরিণত হয়েছেন। গান্ধীজির অভিমতের গুরুত্ব অপরিসীম। চিঠিতে মতিলাল নেহরু জানালেন, আমি এবার সভাপতি হতে চাই না। আমাদের উচিত বল্লভভাই প্যাটেল অথবা জওহরলালকে দায়িত্ব দেওয়া। বল্লভভাই প্যাটেল গান্ধীজিকে বলেছিলেন, এই বছরটা তিনি বরদৌলি নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। এখন তাঁর পক্ষে কংগ্রেসের সভাপতি হওয়া সম্ভব নয়। বরদৌলিতে কী হয়েছে? আচমকা বম্বে প্রেস্টিডেন্সি থেকে ৩০ শতাংশ ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে হঠাৎ ট্যাক্স বাড়ানোর প্রতিবাদ করেছেন কৃষকরা। কিন্তু তাঁদের কথায় কর্ণপাত করেনি ব্রিটিশ প্রশাসন। তাই কৃষকদের নিয়ে বয়কট আন্দোলন শুরু করেছেন প্যাটেল। কৃষকদের একা ফেলে রেখে এলে আন্দোলন ভেঙে যাবে। সুতরাং রইল বাকি একটি বিকল্প। জওহরলাল নেহরু। গান্ধীজি চাইছিলেন নতুন প্রজন্ম এবার দায়িত্ব নিক কংগ্রেসের। কিন্তু ঠিক সেই সময় কলকাতা থেকে একটি চিঠি এল তাঁর কাছে। প্রেরকের নাম সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি চিঠিতে বলেছেন, আপনাকে একটা অনুরোধ আছে। বাংলার কংগ্রেস ইউনিট চায় মতিলাল নেহরু সভাপতি হন। আমরা সকলেই সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে। কিন্তু যদি সেটা না হয়, তাহলে আপনি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখবেন। গান্ধীজি ইঙ্গিতটা বুঝলেন। আর তিনি সুভাষচন্দ্রের কলকাতার সাংগঠনিক শক্তিও জানতেন। মতিলাল নেহরুকেই সভাপতি করার পক্ষে মত দিলেন গান্ধীজি। পুনরায় চিঠি লিখে সুভাষচন্দ্র জানালেন, বাংলার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সাহায্য করার জন্য আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
১৯৩৮ সালের ২১ আগস্ট ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভায় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুকে প্রশ্ন করলেন, আমরা কি জানতে পারি ভবিষ্যতের ভারত সম্পর্কে আপনাদের পরিকল্পনা কী? সেই ভারত কি ফিরে যাবে ভারতের প্রাচীন দর্শন এবং গোরুর গাড়ির গ্রামীণ জীবনে? নাকি শিল্পোন্নয়নে জোর দিয়ে, প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র দূর করে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে? যাতে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলিরমধ্যে স্থান করে নিতে পারে। প্রত্যুত্তরে কংগ্রেস সভাপতি বলেছিলেন, কংগ্রেসের সকলেই যে এই প্রশ্নে সহমত পোষণ করেন না, সেকথা আমি স্পষ্ট জানাতে চাই। তবে আমি জানি ভারতের তরুণ প্রজন্ম শিল্পোন্নয়নেরই পক্ষে। বিদেশি শিল্পের সঙ্গে লড়াই করে দেশের কর্মহীনতা দূর করার জন্য শিল্পায়ন করতেই হবে। এই প্রশ্নটা উত্থাপিত হল কেন? কারণ,কংগ্রেসের চালিকাশক্তি মহাত্মা গান্ধী গ্রামভিত্তিক ভারতের পক্ষে। ইংল্যান্ডের মতো শিল্পায়নভিত্তিক আধুনিক সভ্যতার ভাবনা ভারতে যে কার্যকর করা যায় না—তিনি ছিলেন এই মতে বিশ্বাসী। যা নিয়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রবল মতান্তর ছিল। কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু সেই বছরের অক্টোবর মাসে ভবিষ্যৎ ভারতের পরিকল্পনা করার জন্য গঠন করলেন একটি কমিটি। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি। সেই কমিটির চেয়ারম্যান করলেন জওহরলাল নেহরুকে। কারণ, এই বিষয়ে তিনি ও নেহরু সমমনস্ক ছিলেন। অথচ তাঁরা জানতেন, এই ইস্যুতে সবথেকে বড় আপত্তি করবেন মহাত্মা গান্ধী। একইসঙ্গে সুভাষচন্দ্র চাইছিলেন, তখন থেকেই পূর্ণ স্বরাজ নিয়ে সরব হতে। গান্ধীজির সে ব্যাপারে দ্বিধা ছিল। তাই পরবর্তী বছরে কংগ্রেসের সভাপতি হওয়া নিয়ে সরাসরি গান্ধীজি বনাম সুভাষচন্দ্রের সাংগঠনিক লড়াইয়ের ইতিহাস সকলেই জানেন। সুভাষচন্দ্রকে কিছুতেই সভাপতি হতে না দেওয়ার পণ করে গোবিন্দবল্লভ পন্থ ও বল্লভভাই প্যাটেলরা কীভাবে জোট বেঁধেছিলেন, সেকথাও কারও অবিদিত নয়।
এই কাহিনীগুলি উত্থাপনের কারণ কী? কারণ, কংগ্রেসের ইতিহাসে অন্তর্কলহ, সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধ এবং চরম মতান্তর আগাগোড়া হয়ে এসেছে। কিন্তু সেটা কখনওই কংগ্রেসের পরিচালন পদ্ধতির এগিয়ে যাওয়ায় প্রভাব ফেলেনি। কংগ্রেস যে এসব কারণে সাংঘাতিক দুর্বল হয়েছে, তাও নয়। কারণ, কংগ্রেসের অন্দরে এই গণতান্ত্রিক কাঠামোটি সমান্তরালভাবেই ছিল। এমনকী জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যে সরকার পরিচালনার নানাবিধ ইস্যু ছাড়া দলের সাংগঠনিক নির্বাচনেও তুমুল মতান্তর এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই হয়েছে। দেশের নিজস্ব সংবিধান গ্রহণের পর যখন গভর্নর জেনারেল পদটি বিলুপ্ত হয়ে রাষ্ট্রপতি পদ তৈরি হবে, তখন প্রথম রাষ্ট্রপতি কে হবেন? প্যাটেল চাইছেন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে। নেহরুর ইচ্ছা চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, কংগ্রেসের নিচুতলায় সকলেই প্যাটেলের ক্যান্ডিডেট অর্থাৎ ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকেই সমর্থন করছেন। সুতরাং নেহরুকে পিছু হটতে হয়। ১৯৫০ সালে কংগ্রেসের সভাপতি কে হবেন? আবার বিরোধ প্যাটেল বনাম নেহরুর। এবার প্যাটেল চাইছেন পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডনকে। এমনিতে ট্যান্ডনের সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক ভালো। দুজনেই এলাহাবাদের। কিন্তু ট্যান্ডন ছিলেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী। তিনি একবার মতপ্রকাশ করেছিলেন, গোটা ভারতে হিন্দি ভাষাকেই প্রধান ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেটা ভারতের ঐক্যের একটি দৃষ্টান্ত হবে, এটাই তাঁর মনোভাব। কিন্তু ওই অভিমতের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন নেহরু। তিনি বলেছেন, ভারতের অভিনবত্ব হল, বিভিন্ন প্রান্তে এতরকম ভাষা আর কালচার। তা সত্ত্বেও দেশটি একজোট রয়েছে। এটাই হওয়া উচিত বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে। কিন্তু তার বিরোধিতা বিফলে গেল। এবারও জয় হল প্যাটেলের। নির্বাচনে জয়ী হলেন ট্যান্ডন। অথচ এই প্রবল মতান্তর সত্ত্বেও প্যাটেল ও নেহরুর সম্পর্ক কতটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ছিল?
প্যাটেল প্রবল অসুস্থ। ১৪ নভেম্বর ১৯৫০। নেহরু তাঁকে দেখতে গেলেন। প্যাটেল বলেছিলেন, তোমার সঙ্গে আমার একান্তে কিছু কথা বলা দরকার। মনে হচ্ছে, আমার উপর তোমার আর বিশ্বাস নেই। নেহরু প্যাটেলের হাত ধরে বলেছিলেন, আমার নিজের উপরই আর বিশ্বাস নেই। মূত্যুর কিছুদিন আগে ডাক্তাররা প্যাটেলকে বলেছিলেন, দিল্লির ঠান্ডা তাঁর পক্ষে ভালো নয়। তিনি বরং বম্বেতে শিফট করুন। নেহরু বারংবার বলেছিলেন, আমরা সবরকম ব্যবস্থা করব, যাতে ঠান্ডা ঢুকতেই না পারে। তবু আপনি আমাদের কাছেই থাকুন। কিন্তু ডাক্তাররা জোর করলেন। বম্বে যাওয়াই উচিত। প্যাটেলকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন এন ভি গ্যাডগিল। প্যাটেল গ্যাডগিলের হাত ধরে বললেন, একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোমাকে। যতই মতান্তর হোক, পন্ডিতজিকে কখনও ছেড়ে যাবে না, কথা দাও!
* * *
গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসে দেখেছিলেন, কংগ্রেস নামক সংগঠনটি একটি ইংলিশ স্পিকিং এলিটদের দল। এখানে স্থান নেই গ্রামের, দলিতের, আঞ্চলিক ভাষার, মহিলার। গান্ধীজি ঠিক এখান থেকেই বদলে দিতে শুরু করলেন কংগ্রেসকে। তিনি প্রাদেশিক কমিটিগুলির উপর জোর দিলেন, যাতে সেখানে সব কাজ আঞ্চলিক ভাষায় হয় (যদিও তার অনেক আগে ১৯০৮ সালে পাবনা কংগ্রেস অধিবেশনে, আর একজন অরাজনৈতিক মানুষও কংগ্রেসের আগত প্রতিনিধিদের সামনে প্রথমবার বাংলায় বক্তব্য রেখে সকলকে চমকে দেন। বক্তার নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। এরপর গান্ধীজি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। কংগ্রেসের ১৯২৩ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ একটি নোট পেশ করে বলেছিলেন, যে দল অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে না, যে দল নিজেই নিজের দেশবাসীকে অচ্ছুৎ করে রেখেছে, তারা বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে না। গান্ধীজি এই মতের সমর্থক ছিলেন। আপার কাস্ট কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, বানিয়ার দল থেকে তিনি কংগ্রেসকে মাটির কাছে আনতে মরিয়া পরিশ্রম করলেন। কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় আর সরোজিনী নাইডুদের মাধ্যমে কংগ্রেসের মাস মুভমেন্ট অর্থাৎ জন আন্দোলনে প্রবলভাবে অংশ নিতে শুরু করলেন ঘরের মহিলারাও। অর্থাৎ সকলকে যুক্ত করে এগতে হবে। সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বল্লভভাই প্যাটেলকে। যুবশক্তি এবং বিশ্ব রাজনীতিকে ভারতের বার্তা দিতে বাছাই করা হয়েছিল জওহরলাল নেহরুকে, সি রাজাগোপালাচারী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, জে বি কৃপালনি, জে সি কুমারাপ্পা, জাকির হোসেন... কংগ্রেসের বিভিন্ন দায়িত্বে ছড়িয়ে দেওয়া হল এরকম প্রথম সারির প্রভাবশালীদের। এমনই ছিল কংগ্রেসের সাংগঠনিক কাঠামো।
এই প্রবণতাটি ধাক্কা খেতে শুরু করল ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে। অন্য এক চরিত্রের কংগ্রেসের জন্ম হল তখন। কালেকটিভ লিডারশিপের দল থেকে কংগ্রেস চলে গেল সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অধীনে থাকা একটি দলে। যাকে বলা হল হাইকমান্ড। কারণও স্বাভাবিক। তিনি আর দলের নেতাদের বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই দলকেই ভেঙে দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের নামের দলকে প্রকৃত কংগ্রেসে পরিণত করলেন। এবং ইন্দিরা গান্ধীর শক্তি ও ক্যারিশমা এতটাই উচ্চতায় চলে গেল ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ এর মধ্যে যে, বিরোধী নেতারা তাঁর উজ্জ্বলতার কাছে ম্লান হয়ে গেল। আজকাল নেতৃত্বের শক্তির কথা বলা হয়। কিন্তু ১৯৬৭ সালে মিজোরামে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দিয়ে চীন দেখেছে, কঠোর প্রধানমন্ত্রী বলতে কী বোঝায়। ওই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ধ্বংস করতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর এয়ারফোর্সকে বলেছিলেন আইজল শহরে বোমা ফেলতে। স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত কোনও প্রধানমন্ত্রী নিজের দেশের কোনও শহরে এয়ারফোর্সকে দিয়ে বোমা নিক্ষেপ করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সেই এয়ারফোর্স বাহিনীর প্রধান দুই পাইলটের নাম ছিল সুরেশ কালমাদি ও রাজেশ পাইলট! পাকিস্তানকে শিক্ষা নয় শুধু, দেশটাকেই ভেঙে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সুতরাং ১৯৭৭ সালে পরাজিত হলেও মাত্র তিন বছরের মধ্যে আবার বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ফিরতে কোনও সমস্যাই হয়নি ইন্দিরার। দুর্বল বিরোধীদের জগাখিচুড়ি সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আরও বেশি করে মনে করিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত ক্যারিশমাকে। তিনি একদিকে ছিলেন তুখোড় স্ট্র্যাটেজিস্ট। আবার অন্যদিকে, সকলের থেকে ভালো চিনতেন ভারতকে। তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধী একজন আধুনিক মনের এবং নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখানোর ক্ষেত্রে সেরা প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। এমনকী কেউ তাঁর প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে চাইছে, এটা আঁচ করে তিনি ভয় পেতেন।
সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীদের প্রধান সমস্যা হল, তাঁরা নিজেরা ভারত নামক দেশটিকে খুব ভালো করে চিনে ওঠেননি। আবার ধীরে ধীরে বিগত ২০ বছরে কংগ্রেসের আঞ্চলিক শক্তিশালী নেতাদের হয় দুর্বল করে দিয়েছেন, অথবা দল থেকে হারিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে জগন্মোহন রেড্ডি। শারদ পাওয়া থেকে হিমন্ত বিশ্বশর্মা। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া থেকে শচীন পাইলট। রাহুল গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী দলের অভ্যন্তরে এমন পরিবেশই রাখেননি যে, দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধ সমালোচনা করেও দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণই থেকে যাবেন। অথচ কংগ্রেসে এই অভ্যন্তরীণ মতান্তর, প্রকাশ্যে দলের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তপ্রণেতাদের বিরুদ্ধাচারণের ইতিহাস তো রয়েইছে। সেটাই কংগ্রেসের শক্তি ছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, ইন্দিরা গান্ধীর সময় তো ছিল না। দলীয় গণতন্ত্র অবশ্যই তখন ছিল না। কিন্তু সেই ঝুঁকি ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল। কারণ তিনি ছিলেন এককভাবে গোটা দেশে প্রবল জনপ্রিয় এক মুখ। তাঁর নামেই ভোট হতো। এখন যা নরেন্দ্র মোদির বিজেপির চরিত্র। কংগ্রেসের অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বিজেপি প্রশ্ন তোলে। কিন্তু বিজেপির অন্দরে কারও সাহস হবে, এখন সরকার বা দলের একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরুদ্ধাচারণ করতে? কেন হবে না? কারণ দলে মোদির উচ্চতা ও জনপ্রিয়তার ধারেকাছে নেই কেউ। ঠিক উল্টোদিকে রাহুল গান্ধী যখন দেখছেন যে, তাঁর মধ্যে সেই জননায়ক হয়ে ওঠার স্পার্ক নেই, তাহলে একবার অন্তত দলের গণতন্ত্রের দরজা অনেকটাই খুলে দেওয়া উচিত। সভাপতি করা হোক গান্ধী পরিবারের বাইরে কাউকে।
রাহুল গান্ধীর ফিরে আসার লড়াইটা জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীদের থেকে অনেক কঠিন। কারণ, প্রথম তিনজনের একক ক্যারিশমা আর দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁদের সামনে তাঁদের সমকক্ষ গ্ল্যামারাস কোনও জনপ্রিয় নেতা ছিল না। শুধুই জোট ছিল বিভিন্ন দলের। কিন্তু ভারত মনেপ্রাণে একজন নায়ক চায় নেতা হিসেবে। সেই কারণে, ১০ বছরে অনেকগুলি সফল এবং কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অথচ ‘দুর্বল’, ‘মৌন’, ‘সোনিয়ার পুতুল’ ইত্যাদি বিস্ময়কর সব অভীধায় ডঃ মনমোহন সিংকে অগ্রাহ্য করে দিল এই নায়কপ্রিয় ভারত। একই সঙ্গে ধীরে ধীরে কংগ্রেস হারাল বিগত ৩০ বছরে নিজের একান্ত অনুগত ভোটব্যাঙ্ক। প্রথমে মধ্যবিত্ত এবং ধনী কৃষক। নয়ের দশকে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়। তাই ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের পশ্চিমবঙ্গ, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের বিহার, লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উত্তরপ্রদেশ, বংশীলালের হরিয়ানা, বল্লভভাই প্যাটেলের গুজরাত, কামরাজের তামিলনাড়ু, নবকৃষ্ণ চৌধুরীর ওড়িশা, অর্জুন সিংয়ের মধ্যপ্রদেশ... সর্বত্র কংগ্রেস মাটি হারিয়েছে। দিল্লি থেকে হাওড়া ট্রেনে করে এলে কংগ্রেস শাসিত একটিও রাজ্য ক্রস করতে হয় না। আর এসবের থেকে সবথেকে বড় সঙ্কট, নরেন্দ্র মোদির মতো এক জনপ্রিয়তম বাগ্মী প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের বিপুল সাংগঠনিক শক্তি ও আর্থিক ব্যাকআপ। রাহুল গান্ধী অবশ্যই একটি প্রোটেকটেড লাইফ কাটিয়েছেন। অল্প বয়সে ঠাকুমা আর বাবার হত্যাকাণ্ড এই ভাইবোনকে মানসিকভাবেও অনেকটাই ডিফেন্সিফ ও নড়বড়ে করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে রাহুল গান্ধীর মধ্যে লিডারশিপ কোয়ালিটি এখনও মানুষের কাছে দৃশ্যমান নয়। তিনি কী পরিশ্রম করেন না? করেন। কিন্তু মোদিকে সরাতে হলে এই পরিশ্রম যথেষ্ট নয়। সবথেকে বড় সঙ্কট, তিনি অন্য শক্তিশালী দলগুলির কাছে তাঁদের নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য নন। সুতরাং মহাজোট হলেও তিনি মোদির প্রতিপক্ষ মুখ হবেন না। খুব স্বাভাবিক। কংগ্রেসের মতো একটি দল ছেড়ে নিজের নতুন দল গড়ে মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে সিপিএমের মতো একটি মহীরুহের পতন ঘটানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন রাহুল গান্ধীকে মেনে নেবেন তাঁর নেতা হিসেবে? ঠিক এখান থেকে প্ল্যান বি খুঁজতে হবে কংগ্রেসকে। এসব তো রাহুলের বিরুদ্ধে থাকা যুক্তিগুলি। তাঁর সপক্ষে কিছুই নেই? অবশ্যই আছে। কংগ্রেসকে যতটা ধ্বংস হয়ে যাওয়া পার্টি বলে মনে করা হচ্ছে, সেটা পুরোপুরি মোটেই ঠিক নয়। ২০১৮ সালের পর থেকে কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস অনেক ভালো ফল করেছে। বরং বিজেপি এককভাবে আর জিততে পারছে না। বিজেপি মুখে স্বীকার না করলেও এটা যথেষ্ট উদ্বেগের বার্তা। কিন্তু এগুলো রাজনৈতিক তত্ত্ব। প্রধান প্রশ্ন, কংগ্রেসে এখন সর্বজনমান্য দেশনেতা নেই। সেই না থাকাটা প্রধান পার্থক্য মোদির সঙ্গে লড়াইয়ে। এটা স্বীকার করে দ্বিতীয় বিকল্প কী হতে পারে, সেই পথটির উদ্ভাবনই আসল পরীক্ষা!
কেমন হবেন একজন নেতা? ভারত কেমন চায়? যিনি এককভাবে ভালোমন্দের দায়িত্ব নেবেন, ঝুঁকি নেবেন, প্রবল পরিশ্রম করবেন, দলের উপর যাঁর সম্পূর্ণ অথরিটি থাকবে এবং মানুষকে নতুন স্বপ্নের দিশা দেখিয়ে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারবেন। এই ম্যাজিকগুলি থাকলেই হল। তাঁর পারিবারিক পেডিগ্রি অথবা পদবী কী, ২০২০ সালের ভারতে ওসব ম্যাটারই করে না!