প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
আবীর চট্টোপাধ্যায়: সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা। এই দু’টোর কম্বিনেশনের নাম সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী। এমন কোনও মানুষ সামনে থাকলে ভালো লাগে। নাই বা হলেন তিনি রক্তমাংসের কেউ। তাঁকে দেখে, তাঁকে ‘পড়ে’ মনে হয়, যদি এমনটা হতে পারতাম... যদি এভাবে কেউ গাইড করত! এই আশ্রয়টাই হয়ে উঠেছে ব্যোমকেশ। আদিম রিপু-তে তখনকার দিনে ২ লাখ টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছে মানুষটা। কতটা মানসিক জোর থাকলে, কতটা নির্লোভ হলে কেউ সেটা করতে পারে! সাধারণ জীবনযাপন, অথচ চিন্তাভাবনা বিশ্বমানের। আজকাল সবাই তো এটাই মিস করে। সেই হিরোকে... যে এখন আর আমাদের সমাজে নেই। তাই আমরা ফিরে দেখি। বারবার। তাই তো আজও এতটা জনপ্রিয় সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ এবং তাঁর স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
এরপরও শুরুতেই একটা কথা না বলে পারছি না... ব্যোমকেশের জন্য শরদিন্দুর অন্য সব অসামান্য সৃষ্টি কিন্তু কিছুটা হলেও অবহেলিত। এটা আমার একটু খারাপই লাগে। যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে, তারা হয়তো জানে। বাকিরা জানে না। যাই হোক, ব্যোমকেশের কথায় ফিরে আসি। চরিত্রটা এত জনপ্রিয় কেন জানেন? সেই সময়ের দলিল হয়েও এই সৃষ্টি কালের সীমা ছাপিয়ে গিয়েছে। ব্যোমকেশ শুধু গোয়েন্দা গল্প নয়। তিনি নিজেকে সত্যান্বেষী বলতেন। গল্পগুলো ১৯৩০-৪০ সাল নাগাদ শুরু। তারপর মাঝে অনেকদিন লেখেননি শরদিন্দুবাবু। যখনই লিখেছেন, ফুটে উঠেছে সেই সময়কার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এবং তার সঙ্গে বদলে যাওয়া মানুষের জীবনধারা, ভাবনাচিন্তা। তাই এটা শুধু ‘হু ডান ইট বা হাউ ডান ইট’ নয়।
পড়তে গিয়ে আমার নিজেরও মনে হয়েছে, ওখানে আন্ডারলাইনড অনেক বিষয় রয়েছে। যত পড়বেন, তত বুঝতে পারবেন। একটা সময়কে তুলে ধরলেই লেখা বা সিনেমা কালজয়ী হয় না। ঠিক ঠিক সময়টা প্রতিফলিত হলেই উত্তীর্ণ হয় সেই মাপকাঠি। ২০২০-তে বসে ১৯৩০কে যখন ফিরে দেখি, তখন ভাবি... সেই সময়টা কী ছিল, আর এখন কী হয়েছে। কিছু জিনিস ইটারনাল, বদলায়নি। বেশিটাই পাল্টে গিয়েছে। বাঙালি চিরকালই বুদ্ধিমত্তাকে প্রাধান্য দিয়েছে। এর সঙ্গে সততা এবং সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা—এই চরিত্র বাঙালিকে খুবই টানে। তাই আজও একইভাবে অন্তরে থেকে গিয়েছেন ব্যোমকেশ। অসম্ভব ক্ষুরধার বুদ্ধির স্মার্ট বাঙালি, গ্লোবাল চিন্তাভাবনা... তিনি সাহিত্য পড়েন, ক্রাইম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, আবার বাড়িতে বউ নিয়ে সংসারও পাতেন। সঙ্গে রয়েছে বন্ধু অজিতের সঙ্গে হৃদ্যতা—সব মিলিয়ে একটা ইউনিক চরিত্র, বাঙালি যাকে আইডিওলাইজ করতে পেরেছে।
এই জন্যেই সত্যান্বেষী ভদ্রলোকটি ভীষণ স্পেশাল। মানুষের কাছে, আমার কাছেও। আমার জন্য যদিও একটা আলাদা সমীকরণ রয়েছে... আমার নিজের জনপ্রিয়তার শুরুও যে এখান থেকেই। নিজেকে ব্যোমকেশ হিসেবে অবশ্য ভিজুয়ালাইজ কোনওদিন করিনি। সেভেন-এইটে প্রথম ব্যোমকেশ পড়া। বাবা গিফট করেছিলেন। কলেজে আবার পড়েছি। অন্যরকম লেগেছে। মজা করে বললে ব্যোমকেশের সঙ্গে আমার লিভ ইন রিলেশন! আমি যখন প্রথম চরিত্রটা করতে এলাম, তখন কিন্তু বহুদিন ব্যোমকেশ হয়নি। মানে এখনকার মতো মুহূর্মুহূ ব্যোমকেশ হচ্ছিল না। তাই সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দর্শক আমাকে ব্যোমকেশ হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করেছিল। সেটাই প্রাপ্তি। সেটাই স্পেশাল। চরিত্রটা করতে গিয়ে আবার গল্পগুলো পড়া, নতুন ভাবে ভাবা, এসব করতে করতে আমিও যেন ব্যোমকেশের সঙ্গে ইভলভড হয়েছি। কারণ, প্রথম ছবির (ক্রস কানেকশন) শ্যুটিং যখন চলছে, তখন আমি চাকরি করি। টেলিভিশনের কাজও চলছে। ক্রস কানেকশন-এর জন্য অঞ্জনদা (দত্ত) দু’টো গান গেয়েছিলেন। সেই ছবির ডাবিংয়ের কাজ চলাকালীনই হঠাৎ ফোন এল অঞ্জনদার। তার আগে থেকেই উনি আমার হিরো। ফোনে স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বললেন, একটা ছবির কথা ভাবছি। দেখা করতে পারবে? সল্টলেকে ছিল আমার অফিস। সেখান থেকে গেলাম দেখা করতে। অর্ঘ্যদার (অর্ঘ্যকমল মিত্র) বাড়িতে কথাবার্তা হল। অঞ্জনদা বলছেন, ‘তোমার ক’টা ছবি তুলব। কাউকে বলা যাবে না। সুপার সিক্রেট’, ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটা চশমা পরানো হচ্ছে। এইসব করতে করতে হঠাৎ মনে হল, কিছুদিন আগেই না কাগজে পড়েছি অঞ্জনদা ব্যোমকেশ করবেন! তখনই কীরকম সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। অর্ঘ্যদা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে ছবি তুললেন। অঞ্জনদা তারপর আচমকা বললেন, ‘আমি ব্যোমকেশ করব। তোমার আপত্তি নেই তো?’ আমি তো তখন কিছু বলার অবস্থায় নেই। হ্যাঁ বলে কোনওমতে ওখান থেকে বেরিয়ে ১৫ মিনিট হেঁটে অফিস ফিরলাম। পুরো সময়টা মাথা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছিলাম। ব্যোমকেশ নিয়ে শেষ ছবি বলতে ‘চিড়িয়াখানা’... সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার...। তারপর আবার হবে! এইসব চিন্তায় একদম ঘেঁটে গিয়েছিলাম। তারপর সবই হল... একে একে। বাস্তবে।
প্রথমে তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এত বড় একটা ব্যাপার ঘটছে, মানিয়ে নিতে বেশ সময় লেগেছিল। তখনও আমার প্রথম ছবিটা রিলিজ হয়নি। আবার তখন ব্যোমকেশ পড়া শুরু করেছি। অঞ্জনদার বাড়ি যাচ্ছি। আড্ডার পরিবেশ। মোটেই বাঁধাধরা ওয়ার্কশপ নয়। কখনও স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা... আ ড্ডার মধ্যেই। পুরনো ছবি দেখা। ‘চিড়িয়াখানা’ দু’বার দেখতে বলেছিল। ‘ছবি হিসেবে নয়, উত্তমবাবুকে দেখ, কীভাবে ম্যানারিজম থেকে বেরিয়ে এসে দাদাগিরিটা করেছেন।’ এসব বললেও একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল... অঞ্জনদা বলেছিল, ‘ফ্রেশ একটা কিছু করতে চাই। কোনও প্রভাব চাই না।’
অন্য একটা রেফারেন্স অবশ্যই ছিল—বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ। যা এই চরিত্রকে সর্বভারতীয় স্তরে জনপ্রিয় করেছে। চিড়িয়াখানা নিয়ে যেমন অনেকের অনেক মত আছে। সত্যজিৎ রায়ের নিজেরই মনে হয়েছিল, ওটা অন্যভাবে করা যেত। কিন্তু ব্যোমকেশ হিসেবে রজিত কাপুরের যে সমাদর, সেটা আগে হয়নি। রজিত কাপুরের অভিনয় অবশ্যই দেখা ছিল, কিন্তু খুব স্পষ্ট মনে ছিল না। তবে নিজের দিক থেকে বলতে পারি, ‘আদিম রিপু’ (২০১০-এর ১৩ অগস্ট, ঘটনাচক্রে এই বছরেই ১০-এ পা) সাংঘাতিক বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। প্রচুর লোকের সমালোচনাও অবশ্য শুনেছি। তবে ব্যোমকেশের যাত্রাটা সেই শুরু হয়ে যায়। সবাই তারপর ব্যোমকেশ করতে আরম্ভ করল। আমার জার্নির মধ্যেই একটা স্পেশাল শোয়ে রজিত কাপুরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমার পাশে বসেই দেখেছিলেন। ছবি শেষ হলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার কী কী শেখার আছে বলে আপনার মনে হল? উনি বলেছিলেন, ‘আমি কখনওই তোমায় গাইড করব না, পরামর্শও দেব না। তুমি তোমার মতো করে ব্যোমকেশকে ইন্টারপ্রিট করবে।’ পরে মজা করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘স্ক্রিনে তুমি বড্ড বেশি স্মোক করেছ বলে মনে হচ্ছে না তোমার? তবে ছবিটা আমার ভালো লেগেছে। অল দ্য বেস্ট।’ আরও একটা মজার কথা জানিয়েছিলেন রজিতজি। যখন বাসু চট্টোপাধ্যায়ের কাছে উনি প্রথম যান, তখন সেখানে কে কে রায়না বসেছিলেন। তিনি তখন বেশ পরিচিত। রজিত কাপুরের ধারণা হয়েছিল, কে কে-ই ব্যোমকেশ, উনি অজিতের রোলে!
আমার আর একটা অভিজ্ঞতা হল, দুই পরিচালকের (অঞ্জন দত্ত ও অরিন্দম শীল) সঙ্গে ব্যোমকেশ করা। দু’জনের ইন্টারপ্রিটেশন সম্পূর্ণ আলাদা। আমার মনে হয়, অঞ্জনদার ক্ষেত্রে ব্যোমকেশ কথাবহুল, ইন্ডোরটা বেশি প্রেফার করেন উনি। লিবার্টি নিয়ে ছবির সময়টাকে পাল্টে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ১৯৬০-৬৫-৭০-এর সময়টা ওঁর প্রিয়। অরিন্দমদা মোর সিনেম্যাটিক, লার্জার দ্যান লাইফ। বিটুইন দ্য লাইনস খেলতে অরিন্দমদা খুব পছন্দ করেন। অরিন্দমদার পাশাপাশি স্ক্রিপ্ট রাইটার পদ্মনাভ দাশগুপ্তর সঙ্গে আলোচনা হতো। যে কোনও একটা গল্পে অন্যান্য অনেক গল্পের ঘটনা, রেফারেন্স, কথোপকথন মিশিয়ে দেওয়া হতো। ১৯৪৬ সালের সময় ধরে ‘বহ্নিপতঙ্গ’। ১৯৪৮-এর আবহে ব্যোমকেশ পর্ব। ১৯৫০-৫১ ধরে ব্যোমকেশ গোত্র (রক্তের দাগ)। আমার সবচেয়ে পছন্দের ‘হর হর ব্যোমকেশ’। ওই কালার প্যালেটটা খুব ভালো লাগে। বেনারসে শ্যুট। বেনারস মানেই আবার ‘জয় বাবা ফেলুনাথ।’ ছবির শেষেও দেখা যাবে, ভজন গাইছে... মগনলালের ছোঁয়া। এটা কেউ কেউ ভাবলেন টোকা। আরে ট্রিবিউট বলেও কিছু তো হয়।
হর হর ব্যোমকেশে গল্পটা শুধু কেন খুন হল, সেটা নিয়ে নয়। গল্পের মধ্যে রাজনীতিটাও গুরুত্বপূর্ণ। রাজা কুমারী মেয়েকে বিয়ে করেছে, কারণ তার সন্তান চাই। মেয়েটিকে তুলে এনেছে গ্রাম থেকে। এখানে এসে সে সকলের সঙ্গে গল্প করছে, ঘোড়ায় চড়ছে, খুব আধুনিক। কিন্তু আদতে ভেতরে খুব ফিউডাল। পাশাপাশি ব্যোমকেশ-সত্যবতী আছে, সবে বিয়ে হয়েছে। দু’জন দুজনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে, স্বামী-স্ত্রীর থেকেও প্রেমিকা-প্রেমিকার মতো। সব জায়গায় একসঙ্গে যাচ্ছে। ব্যোমকেশ বলছে, আমার সহধর্মিনী। বাংলায় সে সময় মহিলারা অনেক এগিয়ে ছিলেন। শিক্ষাদীক্ষায় বা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের পুরোভাগে দেখা যেত। সেটাকে তুলে আনার চেষ্টা। ব্যোমকেশ গোত্রেও খুব সরাসরি নয়, অথচ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে কথা রয়েছে। ২০২০-তে এসেও যা প্রাসঙ্গিক। সঙ্গে আছে উদ্বাস্তু সমস্যা। এগুলো এক্সপ্লোর করতে অরিন্দমদা ভালোবাসে।
শরদিন্দুবাবুর ব্যোমকেশে প্রত্যেকটা ক্যারেক্টারই কিন্তু বেশ স্ট্রং। তা সে সত্যবতী হোক, বা অজিত। আমার প্রথম ব্যোমকেশের সময় অপুদা (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) ছিলেন অজিতের রোলে। অনেক বড় অভিনেতা। কিন্তু একেবারেই সেটা আমাকে বুঝতে দেননি। বরং অনেক সাহায্য করেছেন... গার্ড করে, গাইড করে। অনেকে প্রথমে বলেছিলেন, অজিত তো স্মার্টার দ্যান ব্যোমকেশ। আসলে ও-ই ব্যোমকেশটা করতে পারত। এসব বলে নতুন ছেলেদের দমিয়ে দেওয়া হয়... এগুলো পুরনো স্ট্র্যাটেজি। তখন অত বুঝিনি। সেটে ওই ভাইবস ছিল না কখনও। পরে ভেবেছি, যদি তাই হতো, তাহলে এই ব্যোমকেশ এত পপুলার হতো কি? অপুদার সঙ্গে কাজ খুব ভালো লেগেছে। পরে অরিন্দমদার নির্দেশনায় ঋত্বিক (চক্রবর্তী) অজিত, আর সোহিনী (সরকার) সত্যবতী। ঋত্বিক আমার চেয়ে একটু বড়। কিন্তু বড় হয়ে ওঠা অনেকটা একরকম। আমরা ভালো বন্ধু। সেই ইকুয়েশনটাই তুলে আনার চেষ্টা করেছি স্ক্রিনে। আমাদের বলা হতো ছুপা রুস্তম। এত বদমায়েশি করতাম সেটে। হাড়ে হাড়ে টের পেত অরিন্দমদা। সোহিনী সিরিয়াস কাজ করে। প্রথমদিকে খুব কনভিন্সড ছিল না। পরে ঠিক ধরে নিয়েছে।
আমার বড় প্রাপ্তি কোথায় জানেন, ভক্তরা অনেকেই আমাকে সত্যান্বেষী বা ব্যোমকেশ বলে ডাকেন। ১১ বছরের কেরিয়ারে ছ’টা ব্যোমকেশ। নট এ ম্যাটার অব জোক। গত চার-পাঁচ বছরে আরও বুঝেছি। কলকাতার বাইরে বা ভারতের বাইরে গিয়েও দেখেছি ব্যোমকেশের আলাদা মাহাত্ম্য। অনেক অবাঙালি দর্শকই আমায় চেনেন ব্যোমকেশ হিসেবে। তাই বুঝেছি, আমার দায়িত্ব কতটা বেড়ে গিয়েছে। ব্যোমকেশের প্রতি। শরদিন্দুবাবুর প্রতি। তাই সেই ভাবনা মাথায় রেখেই এগতে চাই। সব সময়।