প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
‘ইয়ে মহলোঁ, ইয়ে তখতো, ইয়ে তাজো কি দুনিয়া...’ যে গান, যেমন গানই হোক... প্রতিটা শব্দে অসম্ভব মনঃসংযোগ। সাধনা। ও পি নাইয়ার, মদন মোহন, শঙ্কর-জয়কিষণ, লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল, শচীনদা, রাহুল... যাঁর সঙ্গেই কাজ করেছেন, কোথাও এতটুকু উঁচ-নীচ নেই। কেউ কখনও বলেননি যে, রফিজি আমার জন্য আর একটু ভালো গাইতে পারতেন! গীতিকারও তখন পেয়েছিলাম আমরা... প্রত্যেকটা গানে, প্রত্যেকটা শব্দে যেন জাদু ছিল। কিন্তু প্রযুক্তি? পাঁচের দশকের কথাই ধরুন না... কিছুই কিন্তু ছিল না। আজকের মতো একশোটা ট্র্যাক, মিক্সিংয়ের সুবিধা... কোনওটাই না। আজ রেকর্ডিংয়ে গাওয়ার সময় বোঝাই যায় না, এই গানটা কীভাবে রিলিজ হবে! অথচ, তখন থাকত বলতে একটা মাত্র মাইক্রোফোন। একটাই টেক। এতটুকু ভুল করলেই সব বাতিল। নতুন করে আবার প্রথম থেকে গাইতে হবে। তাও কত নিখুঁত, কত সুন্দর ছিল সেই রেকর্ডিং, গান গাওয়া। আর রফি সাব... গান ছাড়া সত্যিই কিচ্ছু বুঝতেন না। কোনও মজা নয়, গল্প নয়... শুধু গান। কিশোরদার সঙ্গে কাজ করা মানেই যেমন ছিল একটা অন্য ব্যাপার, সবসময় রসিকতা, হুল্লোড়, তটস্থ থাকা... না জানি কী করে ফেলেন। কিন্তু রফি সাব? সম্পূর্ণ উল্টো মেরুর মানুষ। রেকর্ডিং মানে যেন অফিসে আসছেন। না থাকলেও কোনও বদল নেই। হয়তো কোনও ফাংশান বা অনুষ্ঠানে গিয়েছেন, সেখানেও সব সময় ফিট। বুশ শার্ট, প্যান্ট, জুতো। সেই জামার রং কিন্তু কখনও ডিপ কালারের হতো না! সাদা, ক্রিম কালার বা তেমনই হাল্কা কোনও রং। মেরেকেটে তিন-চারটে কালার। এর বাইরে কিছুতেই যেতেন না। আর ছিল জুতোর শখ... পেশোয়ার থেকে বানিয়ে আনা হতো অর্ডার দিয়ে। সেই জরির জুতো ছাড়া আর কিছু পরতে দেখিনি রফি সাবকে। কিন্তু ভিতরে একদম ছেলেমানুষ একটা মন লুকিয়ে ছিল তাঁর। একটা ঘটনা মনে পড়ছে...। পাঁচের দশকেই বোধ হয়... রোলেক্স ঘড়ি কিনেছেন রফি সাব। প্রথম রোলেক্স। আর কিনেই দেখাতে এলেন আমাকে। মুখে-চোখে খুশি ঝরে পড়ছে...। বললেন, ‘আশাজি, আমি রোলেক্স নিয়েছি, দেখুন দেখুন... কেমন হয়েছে!’ এই মুহূর্তগুলোয় অন্তরের ছেলেমানুষটা বেরিয়ে আসত। দুঃখ তো সবাই ভাগ করতে পারে। ভাগ করতে চায়। কিন্তু আনন্দটা? কী সুন্দর শেয়ার করেছিলেন আমার সঙ্গে! অত বড় মাপের মানুষ যখন এত ছোট ছোট খুশির মুহূর্তও ভাগাভাগি করে নেন, তার থেকে বড় প্রাপ্তি, আন্তরিকতা আর কিছু হতে পারে না। আজও ঘটনাটা মনে পড়লে সেই আনন্দ অনুভব করি। মনটা হাল্কা হয়ে যায়। কিন্তু কাজে ঢুকে গেলে? অসম্ভব পরিশ্রমী, আর মাটির মানুষ...। তবে পুরোটাই গানে, স্টুডিওর আঙিনায়...। ভাবতাম, বাড়িতে তো কখনও নিমন্ত্রণ করেন না! সে জগৎটা ছিল তাঁর একেবারে আলাদা। তিনি ও তাঁর পরিবার। পর্দানশীন স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ জমানোর সৌভাগ্যও হতো না। কিন্তু তা বলে ভুলে যেতেন না আমাদের। কখনও না...। ঈদ হোক বা অন্য কোনও পরব। ঠিক জানতাম রফিজির বাড়ি থেকে সেমাই আসবে। কোনও হাঁকডাক থাকবে না, কিন্তু নিঃশব্দে পৌঁছে যাবেন সম্পর্কের গভীরে।
সেই গভীরতাই দেখতাম তাঁর গানে। প্রত্যেকটা নোটে যেন প্রাণ ঢেলে দিতেন। মনে পড়ছে সিআইডির সেই গানটা... ‘লেকে পহেলা পহেলা প্যায়ার...’ সালটা বোধহয় ১৯৫৬। রফি সাব, শামসাদ বেগম আর আমি। ও পি নাইয়ারজির সুর ছিল। একটাই মাইক্রোফোনে গেয়েছিলাম আমরা তিনজন। বেশ কঠিন ছিল কাজটা। একটা কী দু’টো ট্র্যাক থাকত। শুধু গায়ক-গায়িকা নয়, মিউজিশিয়ান, কোরাসকেও সেই ট্র্যাকে নিতে হতো। রফি সাব আর শামসাদ বেগম গাইছেন। আমি একটু সরে দাঁড়িয়ে। যখনই আমার টার্ন এসেছে, এগিয়ে মাইক্রোফোনের কাছে এসে অন্তরাটা গেয়ে দিয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা যে এত কঠিন, তা রফি সাবকে দেখে মনেই হতো না। শুধু সিআইডির গান নয়... যত গান সেই সময় আমি তাঁর সঙ্গে গেয়েছি, অবাক লেগেছে... মনোনিবেশ দেখে। তা সে ‘দিওয়ানা হুয়া বাদল’-এর মতো ভীষণ সফট রোম্যান্টিক গান হোক, কিংবা ও ‘হাসিনা জুলফো ওয়ালি’র মতো ফাস্ট... অবলীলায় এক থেকে অন্যটিতে। আজ এত প্রযুক্তি এসেছে, কতভাবে গান রেকর্ডিং করে একটার সঙ্গে অন্যটা জুড়ে দেওয়া যায়... তাও কোথায় যেন একটা ফাঁক থাকে। তখনকার মতো মিষ্টি ব্যাপারটা আর পাই না।
পাই না রফি সাবকেও...। যদি বলা হয় রফি সাবের কোন গানটা সবচেয়ে ভালো... বলতে পারব না। মনে হয় ওঁর সব গানই দারুণ, একদম তাঁর নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ডের। কোনওটা এতটুকু কম নয়। তাও এখনও ‘সুহানি রাত ঢল চুকি, না জানে তুম কব আওগে’ শুনলে মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। প্রত্যেকটা শব্দ, সুরে এক অদ্ভুত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি... আমার মতে রফি সাবের সেরার মধ্যে সেরার কাজ হয়তো এটাই। একটু হলেও অন্য সব গানের থেকে এগিয়ে।
ঈশ্বরের খুব কাছের একজন মানুষ। আদর্শবাদী, সত্যিকারের গায়ক। ৪০ বছর হয়ে গেল... রফি সাব চলে গিয়েছেন। তাও থেকে গিয়েছেন তিনি... থাকবেন চিরকাল... তাঁর গানে।