প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
দেশভাগের পর বাবা ঠিক করেন এপারে চলে আসবেন। তার আগেই অবশ্য আমাকে কলকাতায় দিদির শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে এপারে চলে আসেন। এতগুলো ভাইবোন। এদিকে বাবার চাকরি নেই। ফলে আর্থিক অনটন ছিল রোজের সঙ্গী। তবে পড়াশোনায় ছেদ পড়েনি। ভর্তি হয়েছিলাম কলকাতার এক স্কুলে। সেই স্কুল থেকে ফেরার পথেই জীবনের সেই মুহূর্তটা এসেছিল...। রাসবিহারী মোড়ে একটি পানের দোকানে তখনকার ডাকসাইটে শিল্পীদের আড্ডা বসত। স্কুলে যাওয়া আসার পথে তাঁদের চাক্ষুষও করেছি বেশ কয়েকবার। মনে আছে, একদিন বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল থেকে ফিরছি। দুম করে সামনে চলে এলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কোনও ধানাইপানাই না করে সপাট প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি বাঙাল কথা বলতে জানেন?’ আমার মুখে তো ছোটবেলা থেকেই খই ফোটে, বিন্দুমাত্র ভয়ডর ছিল না। সোজা উত্তর দিলাম, ‘আমি ঢাকার মেয়ে। বাঙাল কথাই বলি’। শুনে ভানুদার প্রশ্ন, ‘অভিনয় করবেন?’ হুট করে এরকম একটা প্রস্তাব পেয়ে একটু ভড়কেই গিয়েছিলাম। দ্রুত সামলে নিয়ে জবাব দিলাম, ‘সে তো আমি বলতে পারব না, বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন’।
ভানুদা ছিলেন একরোখা, জেদি। হাল ছাড়ার পাত্র নন। পরদিন ঠিক পৌঁছে গেলেন আমাদের বাড়ি। বাবার সঙ্গে কথা বলার সময়ই বেরিয়ে এল ওঁর সঙ্গে আত্মীয়তার গুপ্তধন। মেজদি ছিলেন ভানুদার মামি। যাই হোক, বাবাকে ‘নতুন ইহুদি’ নাটকের কথা বলে রাজি করালেন। আমি তো তখন আনন্দে লাফাচ্ছি, এদিকে বড়দের তা বুঝতে দেওয়া যাবে না। তখন আমি কলকাতার পথঘাট তেমন চিনতাম না। বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ও দিয়ে যাওয়ার জন্য ভানুদাকেই অনুরোধ করেছিলেন বাবা। রাজি হয়ে যান তিনি। সেই মতো পরদিন ভানুদার সঙ্গে বেড়িয়ে পড়লাম... তখন আমার স্কুলের একটি কেডস ছাড়া কোনও জুতো ছিল না। ফলে খালি পা...। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলেন সেটা। তারপর অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, কারণ কী? আর কোনও কথা নয়। সোজা জুতোর দোকান। সেই একপাটি জুতো আমি দীর্ঘদিন যত্ন করে রেখেছিলাম। পরে তা নষ্ট হয়ে যায়।
যদিও সে যাত্রা আমার অভিনয় করা হয়নি। কারণ, নাটকের দলের সদস্যরা বয়স ও চেহারাপত্তর দেখে আমাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। এর ঠিক এক বছর পর আবার একদিন বাড়িতে উদয় হলেন ভানুদা। বাবার অনুমতি নিয়ে ফের আমাকে নিয়ে চললেন ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে অভিনয় করাবেন বলে। সুশীল মজুমদার, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়রা এবার আমাকে সুযোগ দিলেন। শুরু হল রিহার্সাল। জীবন তখন সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে...।
মনে আছে, বসুশ্রীতে তখন নাটক হতো। একদিন সেখানে স্টেজ রিহার্সাল হচ্ছে। ভানুদার সঙ্গে দেখা করতে এলেন উত্তমকুমার। আমার আত্মারাম তো তখন খাঁচা ছাড়ব ছাড়ব করছে। স্বপ্নের নায়ককে দেখার জন্য দিলাম দৌড়। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে গিয়ে পেরেকে পা কেটে সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড। দলের সদস্যরা যখন আমার শুশ্রষা করছেন, আমি তখন যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে উত্তমকুমারের দিকেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। ওই অবস্থাতেই রিহার্সাল করেছিলাম। আমার অভিনয় দেখে উত্তমবাবু তাঁর দলের একটি নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। পরে বাবার থেকে অনুমতি নিতে এসেছিলেন। ‘আজকাল’ বলে ওই নাটকে আমি পার্টও করেছিলাম।
‘নতুন ইহুদি’ যেদিন মঞ্চস্থ হয়, সেদিন একটা দারুণ ঘটনা ঘটেছিল। যদিও তা আমি নিজে শুনিনি। এমনকী ভানুদাও আমাকে বলেননি। বলেছিলেন বাবাকে। সেদিন দর্শকাসনে ছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। তখন তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। যাই হোক, নাটকের পর বেশ বুঝতে পারছি আমার অভিনয় সাড়া ফেলেছে। সকলে আমার নাম জানতে চাইছেন। সেই সময় নাকি শিশিরবাবু গ্রিনরুমে এসে ভানুদা, কানুদাদের বলেছিলেন, ‘একটা বাঙাল মেয়ে এসে তোদের সবার মুখে জুতো মেরে দিয়ে চলে গেল!’
নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার কয়েকদিন পর ভানুদা আমাকে এবার নিয়ে গেলেন ছবিতে অভিনয় করাবেন বলে। ছবির নাম ‘পাশের বাড়ি’। সেখানেও প্রথমে শুনতে হল, এই মেয়ে রোগা, বয়স কম... বাতিল হয়ে গেলাম। কিন্তু, ভানুদার জেদ। কয়েক মাস পর ফের খবর এল। আবার ভানুদার পিছু নিলাম। তখন আমাকে বলা হয়েছিল, তিনদিনের কাজ হবে। প্রথম শটটাই দারুণ হয়েছিল। সবাই এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। তখনই প্রযোজকের থেকে জানতে পারি, আমাকে পরীক্ষা করা হচ্ছিল। উতরে যাওয়ায় আমায় গোটা ছবিতেই রাখা হবে। ফলে কাজ হবে অনেকদিন ধরে। একদিকে ‘নতুন ইহুদি’-র সাফল্য, অন্যদিকে ‘পাশের বাড়ি’-র দুরন্ত কমেডি। আমাকে আর পিছু ফিরে চাইতে হয়নি...।
লেখার শুরুটা করেছিলাম জীবন বদলে দেওয়া বাঁকের কথা বলে। ভানুদা কিন্তু শুধু আমায় ওই বাঁক পর্যন্ত ছেড়ে আসেননি। অভিভাবক মতোই নিষ্ঠা ভরে আমার কেরিয়ারের সিঁড়িতে সঙ্গী হয়েছেন। তাই আমার জীবনে তাঁর অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বেঁচে থাকলে ১০০ বছর পূর্ণ করতেন। সারা পৃথিবী খুঁজলেও হয়তো তাঁর মতো সত্যিকারের শিল্পী আর দ্বিতীয়টি মিলবে না।