বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
কিন্তু, ছেলে কী চায়! তার স্বপ্ন কী? চতুর্দিকে যখন ভদ্রস্থ একটা চাকরি, নিদেনপক্ষে সভ্যসমাজে করেকম্মে খাওয়ার একটা সংস্থানের দরজা কেন, মাথা গলানোর মতো একটা ফুটোও নেই। তখন স্বপ্নের সেই লৌহ বাসরঘরের ভিতরে বসে মাথা কুটে নিজেকে রক্তাক্ত করা ছাড়া করার আর কী থাকতে পারে! আর তখনই বুকের মধ্যে বাসা বাঁধে এক প্রবল প্রতিহিংসা। আক্রোশ। প্রতিশোধের আগুন। ভিড়ের থেকে বাইরে বেরিয়ে এমন একটা কিছু করার তাড়না, যা সকলকে চমকে দেবে। সকলকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে। আত্মকেন্দ্রিকতার পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো নয়, সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নবভূমিষ্ঠ শিশুর মতো প্রবল চিৎকারে সমাজকে জানান দেবে— আমি এসে গেছি। বুকের মধ্যে প্রতিশোধের বয়লারে ফুটতে থাকা হিংসার সেই আগুন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়ার নাটকের নামই রিভেঞ্জ ফ্যাক্টরি।
নাটকটির সময়কাল আটের দশকের একেবারে শেষ থেকে শুরু সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত। মহানগরীর উপকণ্ঠে একটি এক্সপ্রেসওয়ের ধারে একটি বাতিস্তম্ভের আলোকবৃত্তে নাটকের অধিকাংশ দৃশ্যপট রচনা হয়েছে। শুরুতেই দেখা যাবে এই কাহিনীর মূল চরিত্র বুলান (পার্থ সিনহা) সাইকেল করে এসে কারও জন্য অপেক্ষা করছে। সে ঝুমা (রায়তী ভট্টাচার্য)। বুলান আসলে ঝুমার প্রেমে পড়েছে। বুলানের এক বন্ধু জিম্বোর (সুমিত) মারফত একটি প্রেমপত্র পাঠিয়ে এই হাইওয়ের ধারে বিজয়া দশমীর দিন সন্ধ্যার মুখে দেখা করতে বলেছে। বুলান একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে। বাবার চাকরি নেই। সে নিজে লেখাপড়া শিখলেও বেকার। ঝুমারা নিম্নবিত্তই বলা যায়। তার মা আত্মহত্যা করেছেন। বাবা সেরিব্রালে আক্রান্ত হয়ে দু’টি অঙ্গ বিকলাঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এখন ঝুমার লেখাপড়া, এমনকী সাংসারিক কিছু খরচাদিও চালান তার কলেজের অধ্যাপক দিবাকর। এই পর্বে পারস্পরিক পরিচয়পর্ব আদান প্রদানের পরও ঝুমা ও বুলানের প্রেম সম্পূর্ণ হয়।
এইভাবে কয়েক বছর চলার পর হঠাৎই একদিন জানা যায় ঝুমা তার সেই অধ্যাপক দিবাকর, যিনি কি না তন্ত্রমন্ত্র করেন, তাঁর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে। দিবাকরের বাবা নকশাল আমলে পুলিসের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন, যার নাম স্বপন পাল। তাই দিবাকর প্ল্যানচেটের মাধ্যমে সেই স্বপন পালকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন এই ধরাধামে। কিন্তু, প্রতিবারই ভুল হওয়ায় গোটা পনেরো বিভিন্ন পদে থাকা স্বপন পাল নামের পুলিস কর্মীকে দিবাকর নরক থেকে ফের মানুষের পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছেন। একবার নেশার ঘোরে নামটি স্ত্রীলিঙ্গ হওয়ায় এক স্বপ্না পালকেও নরক থেকে এনেছেন দিবাকর। এরা প্রত্যেকে রাত হলেই এই হাইওয়ের ধারে ১৩ নম্বর ল্যাম্পপোস্টের তলায় বৈঠক করে। এদের সঙ্গেও বুলান ও জিম্বোর পরিচয় ঘটে এখানেই। জিম্বো এলাকার এক ব্যবসায়ীর ছেলে। ঝুমার কাছে প্রতারিত হয়ে বুলান যখন জীবনের খেই হারিয়ে ফেলছিল, তখন জিম্বোই তাকে এবং তাদের দু’জনের জন্যই এক নতুন ব্যবসার প্রস্তাব দেয়। এই ব্যবসার পরিকল্পনাটাই এই গল্পের মূলধন, তাই সেটা সম্পর্কে কিছু লিখলে নাটক দেখার মজাটাই চলে যাবে।
এই নাটকে গ্রিক ট্যাজেডির অনেকগুলি উপাদান থাকলেও (যেমন, নিয়তি নির্দিষ্ট পরিণতি, নরকের দৃশ্য না থাকলেও প্রেতাত্মার উপস্থিতি, কোরাস, নায়কের মধ্যে সদগুণের আধার) সেগুলিকে এক পাত্রে ঢেলে মাখানোর কাজটি তেমন সুদৃঢ় হয়ে ওঠেনি। আলোর ব্যবহার অত্যন্ত সংযত। মঞ্চ নির্মাণেও খুব একটা বাহুল্য নেই, যদিও নাটকের উপাদানের সঙ্গে মঞ্চের তেমন কোনও জাঁকেরও প্রয়োজন ছিল না। তাই ছিমছাম ঘরানার মঞ্চ মন্দ লাগবে না। নাটক, মঞ্চ, আলোক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা এই চারটি বিভাগেরই দায়িত্ব সামলেছেন দেবাশিস। সঙ্গীত সংযোজনার ক্ষেত্রে কিশোরকুমারের একটি পুরনো বাংলা আধুনিক গান ও দু’একটি হিন্দি ফিল্মের গানকে নেপথ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। সঙ্গীত দিশারী চক্রবর্তী ও চিরঞ্জীব নাথের। সাজসজ্জাও চরিত্র অনুযায়ী যথাযথ, দায়িত্বে রমেন চক্রবর্তী। শুধু একটি কথা না বললেই নয় যে, গোটা কাহিনীটি যে সময়ের ব্যবধানে ধরা হয়েছে, সেই হিসেবে সকলের মেকআপ সমান আকর্ষণীয় মনে হয়নি। যেমন— ঝুমা দীর্ঘকাল পর দেশে ফিরলেও এবং কলকাতার বুকে বেশ কয়েক বছর সেলসে কাজ করার পরও তার তারুণ্যের কোনও ক্লিষ্ট ছায়া লক্ষ্য করা যায়নি। অসাধারণ অভিনয় লেগেছে বুলানের মায়ের চরিত্রে মীনাক্ষী প্রামাণিকের, হাবিলদার স্বপনের চরিত্রে সুরজিৎ ঘোষকে। সবশেষে একটা কথা— বাংলা নাটকের নামকরণটি বাংলায় করলেই ভালো হতো। হয়তো এতে চমক থাকতে পারে, কিন্তু পরিণতির সঙ্গে খাপ খায় কি না তা সমঝদাররাই বলতে পারবেন।
নাটক: ঋভেঞ্জ ফ্যাক্টরি
প্রযোজনা: অন্য থিয়েটার
পরিচালনা: দেবাশিস