বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
‘নেগেটিভ’ লেখার জন্য থিয়েটার-বাজারে আমার কুখ্যাতি আছে। ‘নেগেটিভ’ মানে নিন্দা বা হতাশামূলক আক্রমণাত্মক বা সমালোচনামূলক। যাঁরা এরকমটা মনে করেন তাঁদের বলি, আপনারা একটু ভুল করছেন—সমালোচনামূলক ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও লক্ষ করবেন সেগুলির বেশিরভাগই আত্মসমালোচনামূলক। এখানে ‘আত্ম’ মানে শুধুমাত্র ‘আমি’কেই বোঝাচ্ছে না, আত্ম মানে আমি যে সমাজের বা গোষ্ঠীর মানুষ বা যাঁদের সঙ্গে আমার বসবাস বা নিত্য ওঠাবসা বা একাত্মতা তাঁদেরই বোঝাচ্ছে। তাঁদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, কার্যকলাপ বা কথাবার্তা যা আমাকে সতত পীড়া দেয়, যন্ত্রণা দেয়, হতাশ করে, ক্রুদ্ধ করে, তাকেই নিন্দা করার ফিকির খুঁজি আমি আমার লেখা বা বলা কথার মাধ্যমে।
সামনে মাত্র কয়েকটি দিন আছে ‘বিশ্বনাট্য দিবস’ পালনের। ইউনেস্কোর বাণী-বিতরণ চলবে, আমরা তার অর্থোদ্ধার বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করব, বিশ্বনাট্যের অট্টালিকার একতলার সিঁড়ির নীচের ঘুপচি থেকে মুখ বার করে আমরা ‘বাইট’ও দেব, প্রশ্ন করব না বাণী দেবার জন্য (১৯৬২ থেকে) ডাক পড়েনি কেন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত বা বাদল সরকার মহাশয়দের, কিংবা শঙ্খ ঘোষের— বিশ্বমানের বাঙালি নাট্যস্রষ্টা ও নাট্যবিদদের, ঠিক যেমন পূর্ব-বাংলার ভাষা-শহিদদের রক্তের মূল্যে অর্জিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর কৃতিত্ব ভাগ করে নেওয়ার হুড়োহুড়িতে আমরা ভুলে যাই স্বাধীন ভারতের শিলচরে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় এগারো বাঙালির আত্মবলিদান। ভুলি আমরা অনেককেই, অনেক কিছুকেই। কংগ্রেস-সখা বা বামেদের ধর্মগুরু সোভিয়েত রাশিয়ার ‘ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউজ’ বা ‘রাদুগা পাবলিশারস’ -এর মতো সরকারি প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করে বছরে কয়েকটি বিশ্বমানের বাংলা সাহিত্যগ্রন্থের ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করতে পারতেন না বাম সরকার? তাতে করে হয়তো বা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারদাতাদের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারত কয়েকটি বাংলা গ্রন্থ। দাবিদার হতে পারতেন তিন বাঁড়ুজ্জে তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিকদের কোনও একজন, বা সতীনাথ ভাদুড়ির মতো কোনও সাহিত্যিক?
সাহিত্য সৃষ্টির জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন এমন কৃতী মানুষদের মধ্যে কারা কারা নাটক লেখায়ও হাত দিয়েছিলেন তাঁদের নাম কি আমাদের জানা আছে? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়, ‘রঙরুট’-এর লেখক বরেন বসু, ‘মহাস্থবির জাতক’-এর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী এবং পরবর্তী সময়ের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা বিমল করের নাট্যপ্রীতি ও নাটক রচনা সম্পর্কে আমরা কতটা অবহিত? সাধারণ রঙ্গমঞ্চে ‘সীতা’ দেখার পর শিশির ভাদুড়িকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানিয়ে এসেছিলেন যুবক কবি বুদ্ধদেব বসু, যিনি নিজেও পরবর্তীকালে অনেকগুলি অসাধারণ নাটক রচনা করেছেন। আবার একসময় এই মানুষটিই ক্ষয়প্রাপ্ত সাধারণ রঙ্গালয় নিয়ে হাহাকারও ব্যক্ত করেছেন। ‘সীতা’ দেখে ‘কল্লোল’-এর আর এক কবি-সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন কবিতা লিখে। এবার কবি-গল্পকার-চলচ্চিত্রকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথায় আসি। আমার যৌবনকালের সংগ্রহে দেখতে পাচ্ছি ১৯৬৩-তে প্রকাশিত বার্নার্ড ’শ-এর দু-খণ্ডের সরস ও বিরস নাটকের (‘প্লেজ প্লেজান্ট’ এবং ‘প্লেজ আনপ্লেজান্ট’) প্রথম খণ্ডের বঙ্গানুবাদটি রয়েছে। তাতে তিনটি সরস নাটক— প্রেমিক, বিপত্নীকের বাসা ও মিসেস ওয়ারেনের পেশা। গ্রন্থটির সম্পাদক এবং প্রথম দুটি নাটকের অনুবাদক প্রেমেন্দু মিত্র, তৃতীয়টি অনুবাদ করেছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। প্রকাশক সিগনেট প্রেসের কিংবদন্তি প্রকাশক দিলীপ কুমার গুপ্ত, যাঁর জন্মশতবর্ষ সদ্য শেষ হল। প্রচ্ছদ সত্যজিৎ রায়ের। গর্বে আমাদের বুক স্ফীত হয়ে ওঠার কথা— নিয়মিত থিয়েটার করিয়েদের বাইরে এঁদের মতো মানুষরাও বাংলা নাট্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন।
আর আমাদের সময়ে আমরা কী করেছি? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার চোখের সামনে এই সাধারণ রঙ্গালয়কে লুপ্ত হতে দেখেছি। প্রগতিশীল বাম আমলে। একটাই অজুহাত— ওগুলো ব্যক্তি-মালিকানার ব্যবসায়িক থিয়েটার। ওদের ক্ষয়রোগ নিরাময়ের দায়িত্ব আমাদের নয়। সামনে অনেক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত থাকতেও আধ-সেঁকা মার্কসবাদীরা সাধারণ রঙ্গালয়ের গুরুত্বই বুঝে উঠতে পারেননি। আর শিল্প-সংস্কৃতি জগতের কর্তাভজা সমর্থকরা তাঁদেরকে বোঝাবার দায়িত্বও গ্রহণ করেননি। গ্রুপ থিয়েটারের বাবুরা ভাবলেন হাতিবাগান লাটে উঠলে আখেরে তাঁদের কপাল খুলবে। সাধারণ রঙ্গালয় অস্তমিত, গণনাট্য অস্তাচলগামী, বাংলা মায়ের হাতে রইল ‘কমিটেড’ গ্রুপ থিয়েটার যাদের দায়িত্ব হবে বামফ্রন্টকে ভোটযুদ্ধে জিতিয়ে আনা! এটা একটা নীতি হল? কৌশল হল? গ্রুপ থিয়েটারকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ অর্থাৎ ‘এরা তো সঙ্গে আছেই’ ধরে নিয়ে নয়া কৌশল চালু হল— ‘সিনেমার মাথাভর্তি তেল দিও, থিয়েটারকে দিও কিঞ্চিৎ, না-করিও বঞ্চিৎ।’ আর শেষ পর্যন্ত কৌশলই যখন নীতি হয়ে গেল, তখন যা হওয়ার ছিল তা-ই হল— মজাইল কনকলঙ্কা, মজিল আপনি।
আমাদের গ্রুপ-নাট্যসঙ্গীত এখন—
আরো আরো, প্রভু, আরো, আরো,
এমনি করেই মারো, মারো।
এদিক-ওদিক মোরা পালিয়ে বেড়াই
তোমার সাথে, প্রভু, দেব না লড়াই
একা একা কিছু পাই আর না-পাই
ভাগ্য বলেই মেনে নেবই সবাই
নো লড়াই, প্রভু, নো লড়াই
অভ্যন্তরীণ ছাড়া নেই কোনও লড়াই।
হ্যাঁ, আমরা আসল শত্রুদের বা প্রতিকূল শক্তিকে চিহ্নিত করব না, জোট বাঁধব না, শত্রুকে লড়াই দেব না, একা একা গোপনে বড় হওয়ার চেষ্টা করব— এই হল আমাদের নীতির চোরাপথ। পাগলেও নিজের ভালো বোঝে, কিন্তু আমরা নিজেদের ভালো বুঝতে পারি না— শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে, থিয়েটারের স্বার্থে কোনও সংগঠন গড়তে পারলাম না। চোখের সামনে অ-ব্যাপারীরা যা-খুশি-তাই করে গেল— একটা কোনও আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ হল না, কোনও দিক দিয়ে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা তৈরি হল না, থিয়েটারের নিজেদের দাবি আদায়ের জন্যও এক সঙ্ঘে একসঙ্গে মিলিত হতে পারলাম না। শুধু খামচা-খামচি আকাচা-আকচি করেই ম’লাম।
নিজেদের ব্যর্থতা, যন্ত্রণা, রাগ, ক্ষোভ উগরে দেওয়ার, বা নিজে যা-নয় তাই প্রমাণ করার মাধ্যম হয়েছে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’, যাকে অনেকে আজকাল অ্যান্টি-সোশ্যাল মিডিয়া বলছেন, ভুক্তভোগীরা তো বটেই। চিত্র তারকা নুসরত জাহান এবং মিমি চক্রবর্তী এবারকার লোকসভা নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন— তারপর থেকে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় এই দু’জনের নাম করে অসভ্যতা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু অসভ্য অশিক্ষিত লোকজন। আর এক বিখ্যাত অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ইনস্টাগ্রামে তাঁর একটি ছবি পোস্ট করার পর তাঁকে ট্রোল করা হয়েছে বিশ্রীভাবে। তার প্রতিক্রিয়ায় স্বস্তিকা নিজে কী বলছেন শুনুন— ‘সোশ্যাল মিডিয়া হওয়ার পর সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হল সেটার জন্য একটা সরাসরি সংলাপের জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছে।... আমার এটা বহুবার মনে হয়েছে যে, এখন লোকেদের মধ্যে কোনও কারণ ছাড়াই অহেতুক এত নেগেটিভিটি আর ঘৃণা চলে এসেছে, সেটা সারা দিনরাত তারা ওগরাতে থাকে। তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে তারা অখুশি, নাকি সমাজটাই এরকম একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা বোঝা দায় হয়ে গিয়েছে। মানে আমি একজন সেলিব্রিটিকে চিনি না, কিন্তু তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফলো’ করি গালাগাল দেব বলে।’ থিয়েটারের ক্ষেত্রেও বাঙালির চরিত্রগত ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, কুচুটেপনার কোনও শেষ নেই। তাদের নিজেদের হয়তো কোনও ক্ষমতা যোগ্যতাই নেই কোনও বড় প্ল্যাটফর্মে শিল্প সম্পর্কে আলোচনা বা মতামত প্রকাশ করার, তাই ঝাঁকে ঝাঁকে সমালোচক, নাট্যবিদ সমঝদারেরা ফেসবুক-বাহিত হয়ে ধেয়ে আসছে এবং দংশন করছে একে-তাকে অপরকে বা অপছন্দের লোককে— ফ্যাতাড়ুদের ফেসবুকে অবতরণ যাকে বলা যায়। এখানে যাকে-তাকে যা-তা বলার লাইসেন্স আছে। ভালো কাজেও ফেসবুকের ভূমিকা মাঝেমধ্যে লক্ষ করা যায়, কিন্তু বেশিরভাগই নিজেকে জাহির করা এবং অপরকে আঘাত করার জন্য ব্যবহৃত। থিয়েটারে মানুষরা রিহার্সাল কতটা করে বা কামাই করে কতটা জানি না, কিন্তু ফেসবুকে তাদের উপস্থিতি ২৪×৭।
এই প্রসঙ্গে আমি বাংলাদেশের ছবিটা তুলে ধরেই ক্ষান্ত হব। গত ৫ অক্টোবর আমার ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। ওই সন্ধ্যাতেই শিল্পকলা আকাদেমিতে ‘পদ্মা-গঙ্গা সাংস্কৃতিক উৎসব’ উদ্বোধন করার জন্য। হঠাৎই জানতে পারলাম ওইদিন সকালে মহিলা সমিতির সভাঘরে বাংলাদেশের দুই কৃতী নাট্যজন আমার বন্ধু মামুনুর রশিদ এবং নাসিরুদ্দিন ইউসুফ মঞ্চে বসে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন। শ্রোতা নাট্যজনেরা। আমি ৫ তারিখ দুপুরের বদলে ৪ তারিখ সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকা চলে গেলাম ওদের কথা শুনব বলে। অনুষ্ঠানের আয়োজক বাংলাদেশের নাট্যজনদের সংস্থা ‘ডিরেক্টস ইউনিট’। দর্শনী ছিল ৫০ টাকা। ২৫০ জনের সভাগৃহটি কানায় কানায় ভর্তি হয়ে উপচে পড়েছিল সেই সকালে। কলকাতার রুদ্রপ্রসাদ এবং অরুণ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এরকম একটি অনুষ্ঠান আদৌ সম্ভব কিনা আমি নিশ্চিত বলতে পারব না। হলেও, টিকিট না থাকলেও, ৫০ জনের বেশি লোক হবে না এ বিষয়ে নিশ্চিত। তারপর আবার আয়োজক ডিরেকটরস ইউনিটি? একেবারেই অসম্ভব।
ছবি: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়