বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
সীতা যখন স্বামীর সঙ্গে বনবাসে যায় শাশুড়ি কৌশল্যা তাঁকে পরামর্শ দেন এই বলে— যে সব স্ত্রী স্বামীর কাছে ভালো ব্যবহার পেয়েও দুর্দশাগ্রস্ত স্বামীকে অবহেলা করে প্রাপ্য মর্যাদা দেয় না, লোকে তাকে অসতী বলে। জানকী, আমার বনবাসী ছেলে নির্ধন বা ধনী যাই হোক না কেন তুমি তাঁকে দেবতুল্য জ্ঞানে অনুসরণ করো।
গান্ধারী অন্ধ স্বামীর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনে সবসময় নিজের সুস্থ সুন্দর চোখ দুটো বেঁধে রাখতেন কাপড় দিয়ে। স্বামীর প্রতি অন্ধ সহানুভূতি ও আনুগত্যে সম্পূর্ণভাবে আত্মবিলোপ করে নিজের দৃষ্টিশক্তি স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। একশতটি সাবালক পুত্র, একটি কন্যাসন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাউকে কখনও দেখেননি তিনি। কেবল দুর্যোধনের শেষ দিনে একবার তাঁকে দেখা ছাড়া।
গালব তাঁর গুরুদক্ষিণা জোগাড় করতে হবু স্ত্রী মাধবীকে একে একে গুটিকয় রাজার কাছে বন্ধক দিয়েছিলেন, মাধবীর মতামতের অপেক্ষা না করেই। তারও আগে রাজা যযাতি নির্দ্বিধায় কন্যা মাধবীকে ঘোড়ার পরিবর্তে গালবকে দান করেছিলেন। নিজ কন্যাকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে তুলে দিতে দানবীর রাজার এতটুকু দ্বিধা বা সংশয় হয়নি। একটুকরো সম্পত্তির মতো করে মাধবীকে কেন্দ্র করে এই ঘৃণ্য লেনদেনে মাধবী নিজের অসম্মান, অপমান বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছিলেন।
নিষ্ঠুর, স্বার্থপর মনোহরণকারী পুরুষকে ভালোবেসে নারী এযাবৎকাল মেনে নিয়েছে যাবতীয় পীড়ন নিজের আত্মমর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে। নারীত্বের চরম আত্মত্যাগ ও অবমাননা পুরাণের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। যেখানে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সম্মতি-অসম্মতি বিবেচ্য ছিল না মোটেও।
সদ্য যুদ্ধে নিহত স্বামীর মরদেহ ফেলে রেখে মন্দোদরী ও তারাকে বিয়ে করতে হয়েছিল তাদের নিজ নিজ দেওরকে। রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করার পর রাম পুরস্কার হিসেবে বিভীষণের হাতে তুলে দেন রাবণের প্রধানা মহিষীকে। রাবণের বিশ্বাসঘাতক ভাই ও মন্দোদরীর ষড়যন্ত্রকারী দেওরকে ওইরকম মানসিক বিপর্যয়ের সময়ে নিরুপায় মন্দোদরীকে মেনে নিতে হয়েছিল। স্ব-ইচ্ছায়, সাদরে যে তিনি এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি এ তো সহজেই অনুমান করা যায়। কেন না মন্দোদরী যিনি যুদ্ধে রাবণের সঙ্গে অস্ত্র ধরেছিলেন রামের প্রতিপক্ষ হিসেবে। লঙ্কার নবনিযুক্ত রাজা বিভীষণের একাধিক পত্নীর সঙ্গে সে সময়ে যুক্ত হয়েছিল আরও একটি নাম মন্দোদরী। বানর রাজা বালীর স্ত্রী তারাকেও সুগ্রীবের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারা হলেন কিস্কিন্ধ্যার রানি, বানররাজ বালীর সহধর্মিণী ও সুগ্রীবের ভ্রাতৃবধূ। রামকে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য উপহার হিসেবে পূর্বপ্রতিশ্রুতি মতো বানর রাজা সুগ্রীব এই উপহার লাভ করেছিলেন।
তারার মন্দলাগা, স্বামী হারানোর শোক-দুঃখের কোনও মূল্যই ছিল না কারওর কাছে। পুত্র অঙ্গদের প্রাণাশঙ্কা আর সমাজের শাসনে তারা বাধ্য হল। তবে ভক্তি, আনুগত্যর প্রকাশে লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলার কথাও ভুললে চলবে না। বিবাহিত লক্ষ্মণ যুবতী ঊর্মিলার শত অনুরোধে তাকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসে তো যাননি। অথবা তার কাছে প্রাসাদেও থেকে যাননি। অল্পবয়সি স্ত্রীর নিরাপত্তা, আর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, শারীরিক ও মানসিক চাহিদা সব কিছুকে তুচ্ছ করে চোদ্দো বছরের জন্য দিব্য বনবাসে চলে যায় ভ্রাতৃপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে। অথচ পত্নী প্রেম সেখানে অপাংক্তেয়ই রয়ে যায়। লক্ষ্মণের অবহেলিত স্ত্রী ঊমিলা সাধ্বী স্ত্রীর উদাহরণ হিসেবে জ্বলন্ত প্রদীপে ক্রমাগত তেল ঢেলে ঢেলে তাকে প্রজ্জ্বলিত রেখে সেই প্রদীপের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পতি প্রেমের বিরহে শোকাকুলা হয়ে চোদ্দো বছর কাটিয়ে দেন।
স্বামীর প্রত্যাখ্যানকে নিশ্চুপে মেনে নিয়ে আত্মবঞ্চনা আর উপেক্ষিতার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে ঊর্মিলার নাম ইতিহাসে রয়ে গিয়েছে। তবে মেনে নিলেও গর্ভবতী সীতাকে যখন লক্ষ্মণ বনবাসে রেখে আসছিল তখন সীতার খেদোক্তি— শুধু দুঃখ ভোগ করার জন্যই এই দেহটার সৃষ্টি হয়েছিল।
নারী-পুরুষের যাপিত জীবনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় চিরদিনই ঘর আর বাইরে বিভক্ত হয়ে আছে। সব মেয়ের জন্য একটা সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল স্বামীসেবা, তাকে সঙ্গদান, তার পরিবার-পরিজনদের আনন্দ দেওয়া। মেয়েদের শিক্ষা অবশ্যই ছিল স্বামীসেবার শিক্ষা, আত্মপ্রবঞ্চনার শিক্ষা, গৃহস্থালির শিক্ষা, মেনে নেওয়ার শিক্ষা, মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা।
আচ্ছা কেমন হতো যদি সীতা কৌশল্যাকে মুখ ফুটে বলে ফেলত মনের কথাটা। অথবা দ্রৌপদী যদি পাঁচ স্বামীর মনরক্ষা না করে চলত? ঊর্মিলা যদি নিজের মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত নিত লক্ষ্মণের মতামতের তোয়াক্কা না করেই। আর গান্ধারী যদি তাঁর চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ মায়াবী প্রশান্ত চোখ দুটোকে না বেঁধে স্বপ্নিল এই পৃথিবীর রূপ-রং চুটিয়ে উপভোগ করতেন, কেমন হতো তাহলে? নাহ্, নিছক কল্পনাটুকুই সার।
সীতা, মন্দোদরী, মাধবী, দ্রৌপদী বা তারাকে তো সেই অপমান আর অধর্মকে সহ্য করে যেতেই হয়েছিল। বিজয়া রাজা বিজিত রাজার থেকে উপঢৌকন হিসেবে নারীকে লাভ করবে, নারী ইচ্ছেমতো ব্যবহৃত হবে অথবা উপেক্ষার আগুনে ঝলসে যাবে এটাই তো নীতি। এই তো ধর্ম। এটাই দস্তুর, জীবনের নানা কঠিন পরিবেশ পরিস্থিতিতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা রীতি ও সংস্কারই মেয়েদের বাধ্য করেছে অপমানের দগদগে ক্ষত নিয়ে বাঁচতে। নারীর জন্য সেখানে কোনও সমাজ নেই, পায়ের নীচে মাটি নেই। কোনও পুরুষ দয়িত, পিতা, ভ্রাতা কেউ নেই।
সুদীর্ঘ মহাভারতের চরিত্রে বৈচিত্র্যময়তার মাঝে আরেক নারী কুন্তীও কিন্তু পাণ্ডুর অপারগতা সত্ত্বেও পাণ্ডুর কথাতেই দেবসঙ্গম করেছিলেন। স্ব-ইচ্ছায় নয়। এবং অবশ্যই তা ছিল অনিচ্ছুক সহবাস। দ্রৌপদী চিরকাল অর্জুনকে ভালোবাসলেও পাঁচ স্বামীকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। দুঃখ সাগরে ডুবে থাকা তারা ও মন্দোদরীকে স্বামীর হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীকে পুরুষের দেওয়া বিধান হিসেবে জীবনে মেনে নিতে হয়েছিল। নিষ্ঠুর স্বার্থপর বহুগামী পুরুষকে দুনিয়ার সব কিছু ত্যাগ করে বেঁচে থাকার আর্তি নিয়ে বাঁচতে হয়েছিল। দুঃসহ যন্ত্রণা আর শাণিত অপমান গিলে নিতে হয়েছিল। পুরাণের কাহিনীতে আজও চাপা পড়ে আছে নারীর বেঁচে থাকার দুঃখ-ইতিহাস। একক এবং সহস্র— অশ্রু আর আগুন। যার শুরু আছে শেষ নেই।
তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক