বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
সুফিয়ার মাত্র সাত মাস বয়সেই পিতা সৈয়দ আব্দুল বারি আধ্যাত্মিক সাধনার উদ্দেশে গৃহত্যাগ করেন। ফলে মা সৈয়দা সাহেরার কাছেই বড় হন সুফিয়া। তিনিই সুফিয়ার মধ্যে বিদ্রোহী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।
১৯১১ সালের ২০ জুন বাংলাদেশের বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহর করেন সুফিয়া। বেগম রোকেয়ার উৎসাহে পড়াশোনা চালিয়ে যান। মাত্র বারো বছর বয়সে ১৯২৩ সালে বিয়ে করেন সৈয়দ নেহাল হোসেনকে। আইন পড়ার সুবাদে স্বামীর সঙ্গে সুফিয়া বসবাস করতেন কলকাতায়। সেখানে শিক্ষালাভের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।
১৯২৫ সালে ‘তরুণ’ পত্রিকায় প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশিত হয়। এরপর বরিশালে সাবিত্রী দত্তের মাতৃমঙ্গল শিশু সদন সমিতিতে যুক্ত হয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনিই ছিলেন সেই সমিতির প্রথম মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়ে। পরে তিনি রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আজ্ঞাসান-ই-খাওয়াতিনে-ইসলাম নামে মহিলা সংগঠনেও যুক্ত হন।
১৯২৭ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ফলে সাহিত্য জগতে সুফিয়া পরিচিতি লাভ করেন। সমাজে মেয়েদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি একটি পত্রিকায় লিখেছিলেন— ‘যুগ যুগ ধরে নারীরা যে অত্যাচার, অবহেলা সয়ে এসেছে খেলার পুতুল হয়ে, তাকে দূর করতে কেবল দু’পৃষ্ঠা কাগজে লিখলেই হবে না। এর প্রতিকার হবে বিদ্রোহে’। সুফিয়া গান্ধীজির আদর্শ মেনে চলতেন। চরকায় সুতো কেটে সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
১৯৩২ সালে সুফিয়ার স্বামী নেহাল হোসেন হঠাৎ মারা যান। সুফিয়া ছোট মেয়ে আমেনাকে নিয়ে লেখার মধ্যেই ডুবে থাকেন। ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঝের মায়া’ প্রকাশ হয়। সেই গ্রন্থে কবি নজরুল লিখেছিলেন— ‘কবি সুফিয়া এন হোসেন বাংলার কাব্যগগনে উদয়তারা’।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— ‘তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে।’
দারিদ্রের কারণে সুফিয়া কলকাতা কর্পোরেশনের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। এর মধ্যে ১৯৩৯ সালে সাহিত্য প্রেমী কামালউদ্দিন আহমেদ খানকে বিয়ে করেন সুফিয়া। স্বামীর সহযোগিতায় ও উদ্যমে সুফিয়া কামাল নামে লিখতে শুরু করেন। ১৯৪১ সালে স্বামীর চাকরি সূত্রে বর্ধমানে চলে যান সুফিয়া। ১৯৪৭ সালে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ সচিত্র পত্রিকা প্রকাশ হয়। সেই পত্রিকার সম্পাদক হন সুফিয়া কামাল।
দেশভাগের পর ঢাকায় চলে যান সুফিয়া। সেখানে প্রবল ধর্মান্ধতার রাজত্ব শুরু হলে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধকারী শান্তি কমিটির সভাপতি হন সুফিয়া।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ সুফিয়া কামালকে নারী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর লেখা ‘শহিদ স্মৃতি’ কবিতা বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে তিনি মুখর ছিলেন।
সুফিয়া বলেছেন— ‘আমি ঘর ভাঙার নারীবাদে বিশ্বাস করি না। এখনকার মেয়েদের আরও সাহসী হতে হবে, আরও সংগ্রামী হতে হবে।’ এর আগে ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের সামরিক শাসনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ করেন সুফিয়া। তিনি তাঁর কবিতায় রাজনীতিকে স্থান দিতেন।
তিনি বলতেন, রাজনীতি বলতে মানবতাবোধের পুনরাধিষ্ঠান, সমতা অধিকার, মানুষের ভালোথাকা এবং ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের উপর তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বোঝায়, আমার কবিতা আর রাজনীতি একই সূত্রে গাঁথা।’
১৯৮৯ সালে ‘নব জাতকের প্রতি’ কবিতা সাহিত্যে আলোড়ন তুলেছিল। ১৯৬২ সালে বাংলা আকাদেমি, ১৯৭৬ সালে একুশে পদক, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর জীবনাবসান ঘটে সুফিয়া কামালের।
অরূপকুমার ভৌমিক