বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
গয়নাটি ছোট হলেও সাজ সম্পূর্ণ হয় না আংটি ছাড়া। আর এই ছোট্ট গয়নাটির সঙ্গে এত রহস্য, রোমান্স, রোমাঞ্চ জড়িয়ে আছে, অন্য গয়নার সঙ্গে তেমন নেই! বিভিন্ন সময়ে, নানা উপলক্ষে উপহার হিসাবেও আংটির তুলনা মেলা ভার! মেয়ের বিয়ের গয়নার তালিকায়, বরাভরণের আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে, আংটি ছাড়া জীবন অচল। এছাড়া, বিয়ে, বউভাত, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, পরীক্ষার সাফল্যে আংটি বেশ প্রত্যাশিত উপহার। এছাড়া প্রণয়ীযুগল বা দম্পতির প্রণয় উপহার হিসাবেও আংটির কদর বড় কম নয়। আংটি হয় তামা, রুপো, কিন্তু প্রধানত সোনার। মিনে করা, নকশা করা, ছিলা কাটা কি পাথর বসানো। কখনও বা সোনার ওপর মিনাকারি করে ধারকের নাম বা নামের আদ্যক্ষর লেখা থাকে। হীরে, মুক্তো, পান্না, চুনি, পোখরাজ বসানো সোনার আংটির কদর ও দাম দুইই বেশি। এসব হল জড়োয়া আংটি। সোনা ছাড়া সঙ্গতি থাকলে হীরে বসানো হয় প্ল্যাটিনামের আংটিতে। আর গ্রহশান্তির জন্য জ্যোতিষীদের পরামর্শে আঙুলে ধারণ করা হয়। পলা, নীলা, ক্যাটসআই বা বৈদুর্যমণি ইত্যাদির গ্রহরত্নের আংটি।
বিয়ের সাজে মেয়েদের আঙুলে থাকে আংটি, বরাভরণে বরকেও যৌতুক দেওয়া হয় আংটি, কিন্তু বরসাজেরও একটা অঙ্গ সোনা বা জড়োয়া আংটি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজ ছেলে হেমেন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন নিজের বিবাহ প্রসঙ্গে বর সাজের কথা। বেনারসি জোড়, হীরের কণ্ঠা, মুক্তোমালা, জড়োয়া আংটি, হীরের বালার সাজে সুপুরুষ হেমেন্দ্রনাথকে দেখে বালিকা, শ্যালিকা প্রফুল্লময়ীর মনে হয়েছিল— ‘স্বয়ং মহাদেব যেন ধরাতলে অবতীর্ণ’ হয়েছেন।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে পূর্ণিমা লিখেছেন, দাদা গেহেন্দ্রের বিয়ের সাজ ছিল ‘বেনারসি জোড় পাঞ্জাবি... হীরের কণ্ঠা, হাতে (আঙুলে) হীরের আংটি’ ইত্যাদি।
উনিশ শতকের শেষের দিকে ইঙ্গবঙ্গ সমাজে বিলিতি অনুকরণ ও অনুসরণে বিয়ের আগে, ভাবী বর-ভাবী বধূকে আংটি পরিয়ে দিত ‘এনগেজমেন্টের’ চিহ্ন হিসাবে। এমনই এক বিলেত ফেরত ভূতাত্ত্বিক পাত্র প্রমথনাথ বসু ভাবী স্ত্রী, রমেশচন্দ্র দত্তের বড় মেয়ে কমলার আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিলেন হীরের আংটি। প্রবাস থেকে তিনি কমলাকে লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাকে যে আংটি দিয়াছিলাম, তার অন্য মানে আছে। তোমার আত্মীয় ও বন্ধু বান্ধবদের কাছে আংটি এনগেজমেন্টের চিহ্ন, কারণ লজ্জায় তুমি বলিতে পারিবে না।’ প্রথম যুগের ব্রাহ্ম বিয়ের রীতিতে কিছুটা খ্রিস্টান প্রথার অনুকরণ ছিল। তারই অনুসরণে কনের আঙুলে পরিয়ে দেওয়া হতো বিয়ের আংটি বা ‘ওয়েডিং রিং’। লীলা মজুমদার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, বিয়ের পর তাঁর মায়ের আঙুলে থাকত ‘প্লেন সোনার বিয়ের আংটি’। নিজের বিয়ের প্রসঙ্গে লীলা লিখেছেন ‘আমার আঙুলে প্লেন সোনার একটা তিন সাইজ বড় আংটি পরানো হল।’
বিশ শতকের তিরিশের দশকে শিল্পী মুকুল দে বলেছেন, ভাবী স্ত্রী বীণাকে দেখে তাঁর ‘যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ তাই হয়েছিল। বিয়ে করতে দেরি করেননি মুকুল। মণিকারের দোকানে বীণাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পছন্দ করা আংটি পরিয়ে দেবেন বলে। বীণা লিখেছেন বীণার পছন্দ মতো ‘হীরে, মুক্তো বা কোনও পাথর বসানো নয়, কোনও কারুকাজ করা ডিজাইনও নয়, সম্পূর্ণ প্লেন একটি (সোনার) আংটি আমার আঙুলের মাপে কিনে পরিয়ে দিয়েছিলেন।’
বিজয়া রায় স্মৃতিচারণে লিখেছেন, বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের আগে বোম্বাই-এ তাঁকে নিয়ে সত্যজিৎ গিয়েছিলেন ‘এনগেজমেন্ট রিং’ কিনতে। ‘শেষকালে ফিরোজ শাহ মেহেতা রোডে একটা দোকানে ‘রুপোর উপর সোনার জল করা কৃষ্ণের মূর্তি, মুখে বাঁশি আর পিছনে একটা গোরু গা ঘেঁষে রয়েছে দেখে আমার ভারী পছন্দ হল। উনি (সত্যজিৎ) অবাক হয়ে বললেন ‘সেকি, হীরে, রুবি সব ছেড়ে শেষকালে সোনার জল করা একটা রুপোর আংটি?’
অবশ্য পরে পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে বিজয়াকে হীরের কানফুল ও হীরের আংটি উপহার দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। হীরের আংটি পছন্দ করতেন বলে বিজয়া স্বোপার্জিত অর্থে আরও একটি হীরের আংটি কিনেছিলেন। তবে দাদাশ্বশুর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির হীরে বসানো সোনার আংটিটি হারিয়ে ফেলে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন বাবা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গে। গুণেন্দ্রনাথ শৌখিন পুরুষ ছিলেন। হাতে কাট গ্লাসের আতরের শিশি বসানো ছড়ি, আঙুলে ‘বনস্পতি’ হীরের আংটি পরে যেতেন বেড়াতে। একবার হীরেটি আংটি থেকে খুলে পড়ে যায়। তাঁর বুদ্ধু বেহারা একটা সাধারণ পাথর ভেবেই সেটি আলমারিতে তুলে রেখেছিল!
অবনীন্দ্রনাথ একবার একটি আশ্চর্য সুন্দর ছোট্ট পাথর খুঁজে পান। দৌহিত্র মোহনলাল লিখেছেন, ‘এতটুকু তেঁতুল বীচির মতো অদ্ভুত একটি পাথর। বাদামি তার রং। আলোর দিকে ধরলে স্বচ্ছ দেখায়। আর অবাক কাণ্ড! তার ঠিক মাঝখানে একটি মৌমাছি জমে পাথর হয়ে রয়েছে। দাদামশায় সেই অপূর্ব পাথরটি বাঁধিয়ে আংটি করিয়েছিলেন। প্রায়ই পরতেন।’
মুকুল দে’কে এক জ্যোতিষী বলেছিলেন, সোনা বাঁধানো ক্যাটস ‘আই’ বা বৈদুর্যমণি ধারণ করতে। একবার সপরিবারে সিংহলে গিয়েছিলেন। সেখানে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন বৈদুর্যমণি বা ‘ক্যাটস আই’ খচিত সোনার আংটি। আংটি পরে মুকুলের ছবি প্রদর্শনী হলে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। খুবই সম্মান পেয়েছিলেন সেখানে। প্রচুর ছবি বিক্রি হয়। অনেক পোর্ট্রেট করেন, ছবি আঁকেন। বহু অর্থ উপার্জন করেন, খরচও করেন দু’হাতে। ফেরার পথে ট্রেনে আংটি থেকে পাথরটি কোথায় যেন পড়ে যায়। তারপর থেকেই মুকুল আবার নিঃস্ব। বীণা তাঁর ঝুলি ঝেড়ে কুলি বিদায় করেন। মুকুল নিজেই বলেছেন ‘পুনর্মূষিক হওয়া গেল!’
সেকালের অভিজাত পরিবারের মেয়ে-বউদের অলঙ্কার প্রাচুর্য যে পরিবারের অর্থকৌলীন্য আর বনেদিয়ানা— দুইই বোঝাত। দামি বা বিরল গয়নাপত্র কি দুষ্প্রাপ্য রত্ন নিয়ে বনেদি পরিবারের মধ্যে অলিখিত রেষারেষিও চলত সেকালে। এমন এক অতি ধনী প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবারে নিমন্ত্রণ রাখতে এসেছিলেন। আরেক ধনী বনেদি পরিবারের চূড়ামণি দত্তর মেয়ে। মেয়ে এসে নিমন্ত্রণ বাড়িতে দাঁড়ালে, দেখা গেল, গোটা শামিয়ানার রং পাল্টে ময়ূরকণ্ঠি আভা লেগেছে! এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেল ওই মেয়ের আঙুলের আংটির পাথর থেকেই এমন আভা দেখাচ্ছে। গল্পের আর শেষ নেই আংটি নিয়ে।
তেমনই শেষ নেই বাঙালির সাহিত্যে আংটি প্রসঙ্গের। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী, দেবী চৌধুরানী, যুগলাঙ্গুরীয় উপন্যাসে পাঠক তার পরিচয় পেয়েছেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন— অঙ্গুরীয় বিনিময়। রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পে আংটি প্রসঙ্গ পাঠকের মন ভিজিয়ে দেয়। আর রহস্য গল্পে হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, সত্যজিৎ রায় বারবার এনেছেন আংটির কথা। সহৃদয় পাঠকের তা অজানা নেই!