সোপান সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, ‘তাহলে কী ঠিক করলি?’
পরমের হাতে সিগারেটটা অসহায়ভাবে পুড়ছিল। ওরা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টেশনে ঢোকার মুখে বাঁ-পাশে একটা স্মোকিং জোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কয়েকজন জার্মান যুবতী দ্রুত সিগারেট নিঃশেষ করে ভিতরে ঢুকে গেল।
একজন কোট প্যান্ট পরা ভবঘুরে জুলুজুলু দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাল। ডানদিকের ভ্যাট থেকে কুড়ানো বিয়ারের ক্যান আর জলের বোতলগুলো একত্র করছে।
লোকটার দিকে তাকিয়ে পরম বলল, ‘আজকের রাতটা তো হোটেলে থাকছি তারপরে ভাবব।’
সোপান শর্ট রুটের ট্রেন ধরতে বেরিয়ে গেল।
ফ্রাঙ্কফুর্ট মেইন স্টেশন থেকে বেরিয়ে পরমব্রত ট্রাম লাইনের সামনে এসে দাঁড়াল।
নীল রঙের ট্রামটা ‘ইউরো পার্কে’র দিকে টার্ন নিল। পরমের তেমন কোথাও যাওয়ার কথা ছিল না। গত সপ্তাহে অফিসের কাজে হামবুর্গ এসেছিল। আজ ফ্রাঙ্কফুর্টের অফিসে বাকি কাজ সেরে ফেলল। আগামী কাল ফিরে যাবে। তাই শহরটা একটু ঘুরে দেখবে। তারপরে ফিরে যাবে কোলনে। সেখান থেকে ডাসেলডর্ফ। দু’বছর হতে চলল পরম ডাসেলডর্ফে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে পরম দেখল ফুরফুরে আকাশটা হঠাৎ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেল। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ও দৌড়ে ট্রাম ডিপোর শেডের নীচে দাঁড়াল। একঝাঁক বাঙালি ইউরো শপে ঢুকল মাথা বাঁচাতে।
সেই ভবঘুরে ডাস্টবিন ঘেঁটে দুটো জলের বোতল আর বিয়ারের কন্টেনার পিঠের ব্যাগে চালান করে দিল। বোতলগুলো গ্রোসারি শপে দিলে পঁচিশ সেন্ট করে পাওয়া যায়। এখানে পিপাসায় বুক ফেটে গেলেও কোথাও বিনা পয়সায় জল পাওয়া যায় না। এমনকী রেস্টুরেন্ট কিংবা স্টেশনেও নয়। ঘর থেকে বের হওয়া মানে সব কিছু কিনে খেতে হবে। এখানে জল মহার্ঘ। কিছুক্ষণ আগেই তো পরম সাড়ে তিন ইউরো দিয়ে হাফ লিটার জল কিনল। হাফ লিটার জল আর এক ক্যান বিয়ার একই দাম।
একঝাঁক জার্মান যুবতী মনের সুখে সিগারেট টানছে। পরম গোটা ইউরোপ ঘুরে দেখেছে মেয়েদের ভিতরে নিকোটিনের প্রতি তীব্র আসক্তি। তুলনায় পুরুষেরা সংখ্যায় বেশ কম।
আবার ঝকঝকে রোদ্দুর উঠল।
পরম পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেন্টার পয়েন্টের দিকে।
‘স্ট্যাচু অব জাস্টিসে’র সামনে সেই বহুরূপী স্ট্যান্ডের উপরে দাঁড়িয়ে ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ফোটো তুলছে। বিনিময়ে দু’-এক ইউরো করে পাচ্ছে। একজন বেহালাবাদক ছড় টানছে। হুবহু পাঁচ বছর আগের চিত্র। একই ফ্রেম, একই রং-তুলির শহর। প্রিয়া ছবি তুলেছিল এখানে দাঁড়িয়ে। ওর ঘরের বেড সাইড টেবিলে রাখা আছে ছবিটা। সুন্দর ফ্রেমে ওর মা বাঁধিয়ে রেখেছে আরও কিছু ছবির কোলাজ।
রাস্তার দু’ধারে ক্যাফেটেরিয়া আর রেস্টুরেন্টের সামনে অজস্র চেয়ার টেবিল পাতা আছে। স্যুভেনির শপগুলোতে ভিড় পর্যটকের।
ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে। চার্চের ঘণ্টাটা বেশ
জোরালো শোনাল।
পরম হাতঘড়ি দেখল। এখানে দীর্ঘ বেলা। সাড়ে আটটাতে সূর্যাস্ত হলেও আকাশে ন’টার পরেও আলো থাকে।
‘কী দাম গো! দশ ইউরোতে তেমন ভালো কিছু পাওয়া যায় না। কুড়ি-পঁচিশ খসালে তবেই না—’
গলা শুনে পরম ঘাড় ঘোরায়।
কয়েকজন বাঙালি ওর দিকে তাকাল। তারপরই মুখ ফিরিয়ে নিল।
পরম লক্ষ করল ওর সাদা টি শার্টে চে গেভারার ছবি।
তাই কি?
কী বুঝল কে জানে।
পিঠের ব্যাগটা বেশ ভারী। ল্যাপটপ, আইপ্যাড, সঙ্গে ছাতা, জলের বোতল। ভেবেছিল ব্যাগটা হোটেলে রেখে আসবে। এলেই ভালো হতো। হাফ-বান-হপ স্টেশন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ওর হোটেল।
সোপান খুব মজা করেছিল ওদের বিয়েতে। টানা পনেরো দিন ছিল কলকাতায়। বিয়ে বউভাত সেরে একসঙ্গেই ফিরেছিল। পরম আর প্রিয়া ঠিক করেছিল ওরা সুইজারল্যান্ডে হনিমুন সারবে।
দুই রাত লুসার্নে কাটাল, ক্রুজে ঘুরল। তারপরে জুরিখ হয়ে ফিরল।
পরম গির্জার রাস্তা ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল। পথের দুই ধারে অট্টালিকার সারি। গির্জার চুড়ো দেখা যাচ্ছে। বাকিটা গাছেদের আড়ালে চলে গিয়েছে।
আরও কিছুটা এগতেই ‘আম-মাইন’ নদী। শহরের লাইফ লাইন।
প্রিয়াকে বিয়ের পরে নিয়ে এসেছিল। তখন ওর নতুন চাকরি। ফ্রাঙ্কফুর্টে ছিল মাস ছয়েক। বাকি দিনগুলো জার্মানির বিভিন্ন শহরে। তারপরে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিল। ওর বাবা-মায়ের চাইতে প্রিয়ার বাবা-মায়ের জন্যই ফিরে যেতে হল। স্যালারি এক ধাপে অনেকটাই কমে গেল।
প্রিয়া ছয় মাসেই হাঁফিয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে যাদবপুর থেকে ই-মেল পেতেই ও আরও মরিয়া হল। বলল, ‘ফিরে চল পরম।’
নতুন বউয়ের আবদার, বাধ্য হয়েই পরমকে ফিরতে হল।
উত্তর আর দক্ষিণ দুই প্রান্তে দুই পরিবারের বাস। পরমের অফিস রাজারহাটে। প্রিয়ার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রিয়া একদিন রাতে বিছানায় পরমকে জড়িয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু এবার থেকে মা-বাবার সঙ্গে থাকব।’
‘আর আমি? বউ ছাড়া একলা, কেটেছে একেলা বিরহের বেলা...গাইব?’
‘কেন? তুমিও থাকবে আমার সঙ্গে।’
পরম প্রিয়ার হাতটা সরিয়ে বলল, ‘মানে? বিয়ের পরে তুমি বাপের বাড়িতে কাটাবে?’
‘কেন? কী হয়েছে? তুমিও তো থাকবে আমার সঙ্গে।’
‘আমি নিজের বাড়ি, আমার বাবা-মাকে ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকব?’
প্রিয়া অভিমানী গলায় বলল, ‘এই সব মিডল ক্লাস মেন্টালিটি ছাড় তো। আমাদের দোতলা বাড়ির পুরোটাই ফাঁকা পড়ে থাকে। কত জায়গা বল তো, কী সুন্দর নিজেদের মতো থাকতে পারব। আমার পড়াশোনার সুবিধা হবে।’ পরমের বুকে অদৃশ্য কাঁটার খোঁচা লাগে। ও কি তুলনা
টানছে? পরমদের সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট ফ্ল্যাট এক চিলতে জায়গায় ও কি হাঁপিয়ে উঠেছে?
ছোট্ট একটা বেডরুমে সারাটা দিন প্রায় বন্দি হয়েই কাটাতে হয়। নিজের মতো কিছু কিনতে পারেনি আজ পর্যন্ত।
রাখবে কোথায়?
বিয়েতে পরম কিচ্ছু নেয়নি। নিজেই ঘর সাজিয়েছিল খাট, ওয়ারড্রোব, ড্রেসিং টেবিল, কম্পিউটার টেবিল, দেওয়াল জোড়া শো কেস এমনকী প্রিয়ার জন্য বেডরুম সংলগ্ন একটা ছোট ঘর বানিয়েছিল প্রোমোটারকে বলে।
এইটুকু জায়গা কিনতেই বাবার সারাজীবনের জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল।
তবু সেটাই ছিল স্বর্গ।
পরমের সে রাতটা বিস্বাদে কেটেছিল।
পরম কিছুতেই রাজি ছিল না এই প্রস্তাবে। বন্ধুরা বলেছিল প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হয়। তাই সে শক্ত হয়ে বলল, ‘বিয়ের পরে স্বামীর বাড়িটাই নিজের বাড়ি। তবে তোমার যখন ইচ্ছে বাবা মায়ের কাছে যেও তাতে আমি বাধা দিচ্ছি না। তবে পার্মানেন্ট থাকবে সেটি সম্ভব নয়।’
দু’দিন মনমরা ছিল দু’জনে।
ফোন করছে না দেখে প্রিয়াকে সেদিন ফোন করেন ওর মা।
প্রিয়ার গলা শুনেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে রে? পরমের সঙ্গে ঝগড়া? নাকি শাশুড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য?’
‘না, না শাশুড়ি মাটির মানুষ।’
‘তাহলে?’
মায়ের কাছে সত্যিটা লুকাতে পারেনি।
মা বলেন, ‘ঠিকই তো বলেছে পরম, বিয়ের পরে ওটাই তোর বাড়ি।’
‘আর এতদিন যেখানে ছিলাম?’
‘এটাও।’
‘তুমি তো শ্রোডিংগার ইক্যুয়েশনের মতো বললে জ্যান্ত বিড়াল মরা বিড়ালের গল্প। একই সঙ্গে দুই জায়গায় কীভাবে থাকা সম্ভব?’
‘একই সঙ্গে কেন! যখন মন চাইবে চলে আসবি।’
‘আমার মন চাইছে, আমি প্রতি উইকএন্ডে তোমাদের সঙ্গে কাটাব।’
‘অমন আবদার করলে চলে না মা। একটু অ্যাডজাস্টমেন্টে আসতে হবে।’
‘শুধু মেয়েরাই অ্যাডজাস্টমেন্ট করবে আর ছেলেরা?’
প্রিয়া একের পর এক যুক্তির ঘুঁটি সাজায়।
না পেরে মা বলেন, ‘তোর সঙ্গে কথায় পারা যায় না। যা পারিস কর।’
প্রিয়া একটু নরম হয়ে সেদিন পরমকে বলল, ‘তুমি আমাকে অযথা ভুল বুঝ না। আমার বাবা আর মায়ের আমি ছাড়া আর কে আছে বল? আমি যদি তাদের না দেখি কে দেখবে?’
‘তুমি যেমন তোমার পেরেন্টের কথা ভাবছ, আমাকেও তো তাদের কথা ভাবতে হয়।’
‘আমি কি তোমার বাবা-মাকে নিজের ভাবি না? তাদের কিছু হলে আমি দেখব না? আমার বাবার হাই ব্লাড প্রেশার, মাও অসুস্থ, আমার কত চিন্তা হয় জানো?’
কিছুদিন প্রিয়া বাপের বাড়িতে কাটাল। পরম একদিনের জন্যও গেল না।
পরে মায়ের চাপে পরম কিছুটা নরম হয়ে প্রিয়াকে আনতে এল।
ঠিক হল শুক্রবার ইউনিভার্সিটি থেকে প্রিয়া বাপের বাড়ি চলে যাবে পরম চুপ থাকল। ব্যালকনির রেলিংয়ে ভর দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। ভাবছে এত অল্প সময়ে সম্পর্কে ঘুণ ধরবে ভাবতে পারেনি।
কীভাবে জীবন শুরু করেছিল, ওদের নিয়ে বাবা-মায়ের কত স্বপ্ন ছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়াল যে, বাবা-মা বাধ্য হলেন বলতে, ‘যদি চাস আলাদা থাকতে পারিস। সত্যি তো নতুন সংসারে এমন পুরনো লজ্ঝরে ফ্ল্যাটে থাকতে
ভালো লাগে?’
মায়ের ঠোঁট কেঁপে উঠল, ‘তোদের সুখেই আমাদের সুখ। তুই অসুখী হলে আমরা যে মরে যাব।’
বাবা নিশ্চুপ।
পরমের চোখ সহসা আর্দ্র হয়ে পড়ে। প্রিয়ার চাপে পড়ে বুক করতে হল নতুন ফ্ল্যাট দক্ষিণ কলকাতায়। তবে শ্বশুরের টাকায় নয়, নিজের জমানো টাকা সঙ্গে লোন নিল।
...
আবার বৃষ্টি শুরু হল। পরম দৌড়ে সামনের ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকল। এক কাপ কফি অর্ডার দিয়ে কর্নারের টেবিলে বসল। ওয়েটার এক কাপ ক্যাপুচিনো কফি রেখে গেল।
নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকার পরে প্রিয়া অন্যরকম হয়ে গেল। কত হাসিখুশি। একেবারে নিজের একটা সংসার। মনের আনন্দে ঘর সাজাচ্ছে। ততদিনে ও কনসিভ করল। বলল, ‘এবারে তোমার মা-বাবাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসব।’ পরম জড়িয়ে ধরল প্রিয়াকে। এমনটাই তো চেয়েছিল। বুদ্ধি করেই শাশুড়ি পরমকে দক্ষিণে ফ্ল্যাট বুকিং করাল। এক পাড়াতে থাকলে প্রিয়ার মনে হবে না রাতটা বাবা-মায়ের কাছে কাটাই। ওরা যখন খুশি আসছেন, যা রাঁধছেন দিয়ে যাচ্ছেন। একসঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছেন। এমন সহজ সমাধান হবে বুঝতে পারেনি। মাঝে কয়েক বছর দু’জনের ভিতরে কত কিছুই না ঘটে গেল। একসময় ডিভোর্সের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। দুই পক্ষের মায়েদের মিলিত উদ্যোগে ওদের জীবনে
শান্তি এল।
বৃষ্টি ধরে এলে পরম ‘লাভ লক
ব্রিজে’ এল। এই আয়রন ফুট ব্রিজে উঠলে
ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের দুই দিকের অনেক দূর পর্যন্ত
দেখা যায়। নদীতে তখন সুর তুলে একদল যুবক দাঁড় বাইতে বাইতে এগিয়ে চলেছে। সন্ধে হয়ে আসছে। ব্রিজের আলো জ্বলে উঠেছে। লন্ডনের লাভ লক ব্রিজের মতোই প্রেমিক-প্রেমিকারা এখানে এলে তালা ঝুলিয়ে যায়। ভালোবাসার বন্ধন অক্ষয় হোক। পরম খুঁজছিল কোথায় সেবার ওরা তালা ঝুলিয়েছিল। তারপরে কত হাজার তালা ঝুলিয়েছে পৃথিবীর প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল। তবে সব প্রেম কি আর অটুট থাকে? যাকে চোখের আড়াল করতে মন চায় না দেখা যায় সেই সব থেকে দূরে চলে যায়। নইলে ওদের জীবনে এমন হবে কেন?
নিয়ম মেনে শহরের প্রখ্যাত গাইনিকোলজিস্টকে দেখাচ্ছিল। অপারেশন সাকসেসফুল, বেবি ওকে, মা বাচ্চা দু’জনেই সুস্থ দেখে এল। পরেরদিন রাত থেকে প্রিয়ার শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করল। জেনারেল বেড থেকে সিসিইউ-তে ট্রান্সফার, তারপরেই সব শেষ! বাবা চাইছিল বাচ্চাটা নিজেদের কাছে থাকুক। প্রিয়ার বাবা-মা চাইছেন ওঁদের কাছে রাখবেন। সকলে তাকিয়ে আছে পরম এর মুখের দিকে।
মা বলল, ‘পরম কী বলছে শোন।’
পরমের কিছু বলার ছিল না। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি উত্তর শোনার অপেক্ষায়। বাচ্চাটার প্রতি স্নেহ মায়া জন্মানোর আগেই তো প্রিয়া চলে গেল। ভাবছিল, প্রিয়া জোর করেই মা হতে চাইছিল। চলে যাবে বলেই কি এত তাড়া ছিল?
মা বলল, ‘আমাদের তো পরম আছে, ওঁরা তো নিঃস্ব হয়ে গেলেন। বাচ্চাটা ওঁদের কাছে থাকুক। আমাদের মন চাইলে দেখে আসব।’
পরম এই দুঃসহ জীবন কাটাতে পারছিল না। প্রিয়াহীন জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল।
মনের জোরে ফিরে এল জার্মানিতে একবুক হাহাকার নিয়ে।
একটা ঝোড়ো বাতাস বইছে। সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। পর্যটকেরা দৌড়চ্ছে মাথা বাঁচাতে।
দূরে একট সাদা রঙের ক্রুজ অপেক্ষা করছে জেটিতে। পরম কাচগুঁড়ো বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ঝাপসা হয়ে আসা ক্রুজটাকে দেখছে। হঠাৎ তীব্র শব্দে সাইরেন বেজে উঠল। জেটি ছেড়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রুজটা। ফিরে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে।
ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে জেটির গায়ে।
পরম ভাবছিল সবাইকেই ফিরতে হয়। আগে নয়তো পরে।
চিন্তার সুতোটা ছিন্ন হল শিশুর গলা শুনে।
দেখল, সামনেই ছোট্ট একটা বাচ্চা টলমল পায়ে ছুটে একবার মায়ের কাছে যাচ্ছে পরক্ষণে বাবার দিকে—
পরমের চোখে জল এল। মনে হল তালাটা ও খুঁজে পেয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা প্রিয়া একদিন পরমকে বলেছিল, এ-এখানে কান পাত, শুনতে পাবে।
পরম শুনতে পাচ্ছে শিশুর কান্না। ওদের দু’জনের ভালোবাসার বন্ধন!