বিনতা রায়চৌধুরী: এটাই শেষ ট্রেন ছিল। স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে পথিক দেখল, চারদিকটা খুব ফাঁকা লাগছে। শীতকাল বলেই কী? নইলে এত তাড়াতাড়ি তো রাস্তাঘাট এমন শুনশান হয় না। তার পক্ষে অবশ্য এটা ভালোই। ভিড় থাকলে রিকশ পাওয়া দুষ্কর। আবার বেশি ফাঁকা হলেও রিকশওয়ালাগুলো সব পিটটান দেয়।
বাইরে এসে পথিক দেখল ফুটপাতের দোকানগুলোও খোলা নেই। শুধু একজন ফলওয়ালা ল্যাম্পপোস্টের নীচে বসে দোকান আগলাচ্ছে। পথিক ভাবল, মাসিমণির জন্য একটু ফল কিনে নেবে কি না। অবশ্য কিনেই বা কী লাভ? উল্টে মাসিমণি তাকে বকাবকিই করবে। চোখ পাকিয়ে বলবে, ‘কেন এনেছিস এসব? কার জন্য এনেছিস?’
যাক, এতদিন পর যাদের কাছে যাচ্ছে, তাদের কাছে পৌঁছতে পারলেই ভাববে ঢের হয়েছে। কিন্তু পথ চিনে যেতে পারবে না পথিক। রাত হয়েছে। দিনের আলো থাকলেও না হয় হতো। একটা রিকশ তার খুবই দরকার। মাসিমণি সবসময় বলত, রিকশওয়ালাকে ‘জনপদ নগর’ বললেই ঠিক পৌঁছে দেবে। আর পৌঁছতে পারলে বাড়িটা ও চিনে নেবে।
রাস্তার ওপর ফুটপাতে তিনটে সাইকেল রিকশ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেল পথিক। এদিকটা সাইকেল রিকশরই চল। খাল পেরলে আর টানা রিকশ চলে না। বেশ অন্ধকার অন্ধকার জায়গাটা। তাতে অবশ্য পথিকের অসুবিধে নেই। রিকশটা যেতে রাজি হলেই সে খুশি।
প্রথম রিকশটায় কেউ নেই। চালক অদৃশ্য। তার পিছনে যে রিকশটা দাঁড়িয়ে আছে তার চালক গাড়িতে বসেই চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমচ্ছে। ‘ও ভাই, ও ভাই’ করে কয়েকবার ডাকলেও সে উঠল না। নড়া-চড়াই করল না। আর একটা মাত্র রিকশ দাঁড়িয়ে আছে। একটু পেছনে। তার মধ্যেও ঘুমন্ত রিকশওয়ালা বোধহয়। কারণ, যে রয়েছে, সে কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে রিকশর পাদানিতে শুয়েই আছে। পথিক সেখানে গিয়ে মরিয়া হয়ে ডাকল, ‘ও রিকশওয়ালা, রিকশওয়ালা। সবাই ঘুমচ্ছে কেন? এমন কী রাত হয়েছে? আমাকে একটু পৌঁছে দেবে?’
কম্বলের ঢাকা সরল না। পথিক বলল, ‘না হয় একটু বেশি ভাড়াই নিও। তবু চল না বাপু।’ কয়েকবার অনুরোধ করার পরও যখন রিকশওয়ালার হুঁশ ফিরল না তখন পথিক হাল ছেড়ে দিয়ে পেছন ফিরল। নিরুপায় হয়ে সে যখন পা বাড়াচ্ছে তখন পেছন থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় সে ডাকল, ‘কোথায় যাবেন?’
‘এই যে জনপদ নগর। নিয়ে যাবে?’
‘জনপদ নগর? এই রাতে কেউ সেখানে যায় নাকি? কে আপনি?’
‘ধরে নাও আমি রাত্রির যাত্রী। আর জনপদ নগরই আমার গন্তব্যস্থল। যাবে কি?’
কম্বলটা এতই অল্প সরাল রিকশওয়ালা যে তার মুখ ভালো করে বোঝা গেল না। সে ফর্সা না কালো, রোগা না মোটা, বুড়ো না জোয়ান কিছুই বোঝা গেল না। তবে সে উঠে সাইকেলের সিটে বসল।
‘তুমি চেন তো জায়গাটা? ভাড়া কত?’
‘জগু রিকশওয়ালা চেনে না এইদিককার কোনও জায়গা নেই গো। চাইলে ভবের খালটাও পার করে দিতে পারি। জনপদ নগর তো কোন ছাড়! হে হে খ্যা খ্যা।’
‘হাসি থামাও বাবু জগু। ভাড়া কত নেবে বল।’
‘একশো টাকা দিয়ে দেবেন।’
‘একশো? মাসিমণি বলেছিল তিরিশ-চল্লিশ টাকা ভাড়া?’
‘মাসিমণি? আপনার মাসি কী জানত শুনশান রাতে রিকশ নেবেন? অমন মড়ক শেষে জনপদে যেতে হবে। তাছাড়া আজকের রাত্তিরটা মোটেই ভালো নয়।’
‘মড়ক? কীসের মড়ক জগু?’
‘বাঃবাঃ। করোনার পর জনপদ নগর তো সাফ। কোথায় যে যাচ্ছেন কে জানে?’
‘ঠিক আছে একশো-ই দেব। কিন্তু পথে...।’
‘আর পথে কিংবা বিপথে, হেঁ হেঁ হেঁ।’
‘বলছি, যাওয়ার পথে কোনও পেট্রল পাম্প পড়বে?’
‘তা পড়বে, দুধের ডিপো ছাড়ালেই একটা পেট্রল পাম্প পড়বে। এদিকে আসা-যাওয়া আছে?’
‘না, মাসিমণির নির্দেশ মতো বলছি। সেই পাম্পের পাশের গলিতে ‘খাওয়া-দাওয়া’ বলে একটা ভাতের হোটেল আছে। তুমি চেন? ওইখানে একটু থামতে হবে।’
‘ওই দেখ, ওখানে গিয়ে আবার বসে যাবেন নাকি? এই রাতে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না, বলে দিচ্ছি। আর দাঁড়ালে একশো পঁচিশ টাকা ভাড়া লাগবে।’
‘ওফ জগু, কে বলেছে আমি বসে যাব? আমি যাবই না। ‘খাওয়া-দাওয়া’র মালিক দুর্দিনে মাসিমণিকে দেখেছিল, তাই তার আদেশে সাড়ে তিনশো টাকা তাকে দিয়ে আসতে হবে। আমি বরং রিকশতেই বসে থাকব, তুমি টাকাটা দিয়ে আসবে। তুমি স্থানীয় লোক, চট করে পেয়ে যাবে। আমি তো এপাশটা চিনিই না। রিকশ ভাড়া নেওয়ার এটাও একটা কারণ আমার।’
‘আমি কি আপনার মাসিকে চিনি? তাঁর ঋণ কী করে শুধব?’
‘না-না, বলবে জনপদ নগরের লাবণ্যদেবী এই টাকাটা পাঠিয়েছেন। তাঁর নিজের আসার উপায় নেই। আমার কথা না হয় না-ই বললে।’
‘অঃ, ঠিক আছে চলুন। আগে তো দুধের ডিপো অবধি যাই।’ এই বলে প্যাডেলে চাপ দিল জগু। খানিকক্ষণ যাওযার পর বলল পথিক, ‘চারপাশের দোকান-টোকানগুলো বন্ধ? না, রাত হয়েছে তাই?’
‘দোকান? অর্ধেক দোকান তো বেবাক বন্ধ হইয়ে গেছে। লক-ডাউন সামলাতে পারে ছোট ছোট দোকান? ওরা হল দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। দোকানি হল মজুর, সাপ্লায়ার হল ঝাড়ুদার, মালিক হল সব্জিওয়ালা। একেবারে তছনছ। যা হল কাল করোনায়! সে আর কী বলব!’
পথিক আপন মনে হাসল। এই কথা তার চেয়ে বেশি আর কে জানে।
‘আচ্ছা জগু, তুমি এমন করে কম্বল মুড়ি দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছ কেন? অসুবিধে হচ্ছে না? খুব ঠান্ডা লাগছে? শীত অবশ্য পড়েই গেছে। রাতও হয়েছে।’
জগু একটু হাসল। গান গাইতে লাগল, চাপাসুরে এবং অবশ্যই বেসুরে। তারপর বলল, ‘রাতের সওয়ারি ভাই, আপনার মতো গরম জিকেট তো আর নাই যে গলা মাথা ঢেকে নেব। এই কম্বলই সম্বল। গায়ের চাদর, শোওয়ার বিছানা, চেহারা ঢাকনি, স-ব।’
পথিক ভাবল জগুর রসবোধ বেশ গনগনে। হেসে বলল, ‘আমার বাড়ি গেলে একটা জ্যাকেট তোমাকে না হয় উপহারই দিয়ে দেব।’
পেট্রল পাম্পের পাশে এসে রিকশ দাঁড়াল। জগু বলল, ‘এই গলিতে ‘খাওয়া-দাওয়া’। আপনি যাবেন নাকি, আমি যাব?’
‘তুমিই যাও। আমি বসি রিকশয়।’
‘সেই ভালো। আপনি গেলে আবার দেরি করে ফেলবেন আসতে। আমি ঝট করে দিয়ে আসি।’ পথিক সাড়ে তিনশো টাকা বার করে সাইকেলের সিটে রাখল। টাকাটা তুলেই জগু পা চালাল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘অনেকটা পথ এসে গেছি। নেমে যাবে না যেন। কোনও লাভ হবে না! জগু ছাড়া আর কেউ যাবে না জনপদ নগর।’
একটু পরেই জগু ফিরে এল। সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিয়ে বলল, ‘লোকটা টাকা পেয়ে খুশি হল আবার অবাকও হল। বলল, জনপদ নগরের লাবণ্যদেবী পাঠিয়েছেন? আশ্চর্য কথা!’ পথিক ঘাড় নাড়ল, ‘একটা কাজ করে দিলে আমার জগু। আসলে বকেয়া পাওনা আর কে যেচে পড়ে মেটায় বল? মাসিমণি নিতান্তই ভালো মানুষ। অপরের ঋণ রাখতে চায় না। চল।’ জগু জোরেই চালাচ্ছে তার সাইকেল রিকশ। একটু বেশিই জোরে। রাত হয়েছে, খুব শুনশান চারদিকে। জগুর সাইকেলের ঘণ্টি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আলোও নেই এদিকটা তেমন। পথিক হঠাৎ কান খাড়া করল। কেউ যেন কাঁদছে বিনিয়ে-বিনিয়ে। নাকি গান গাইছে কেউ নাকি সুরে? তাজ্জব তো! সে জগুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেউ কি কাঁদছে নাকি, নাকি সুরে?’ ‘ও সবে কান দেবেন না বাবু। ও হল পেত্নীর কান্না। কেউ কেউ শোনে। কেউ কেউ শুনতে পায় না। আমি যেমন শুনতে পাই না। জনপদ নগরে পরপর ঘরে করোনায় শেষ হয়ে গেছে। কাঁদবেই তো। আছে হয়তো এখনও বেঁচে এক-দু’ঘর। হয়তো আপনার মাসিমণির মতো। দেড়শো টাকা ভাড়া না পেলে আমি এদিকে আসতাম না। আজ যেন রাত্তিরটা ভালো ঠেকছে না।’
‘দেড়শোই নেবে? বড্ড বেশি নিচ্ছ জগু। যাই বল। আরও পঁচিশ বাড়াচ্ছ।’
‘ও সব কথা ছাড়েন। দেখুন কোনটা আপনার মাসির বাড়ি। আমাকে ফিরতে হবে তো।’
‘আর একটু চল, আর একটু চল। হ্যাঁ হ্যাঁ আর একটু জোরে।’
‘জোরে কী বলছেন, উড়েই যাচ্ছি তো। গাছের পাতাগুলো কেমন দুলছে, হাসছে যেন।’
‘গাছের কথা বলায় মনে পড়ে গেল। জোড়া নারকেল গাছের পাশের বাড়িটাই মাসির। চিন্তা হল মাসিকে পাব কি পাব না। আরে, আরে, ওই তো জোড়া নারকেল গাছ। আর ওই হল মাসির বাড়ি। মনে পড়ে গেছে। থাম জগু। এসে গেছি, থাম।’ জগু সাইকেল রিকশখানা থামিয়ে বলল, ‘আপনার মাসির বাড়ি তো ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখছি! ভেতরে মানুষজন আছে তো? যাক নেমে পড়ুন, আমার রিকশখানা হাল্কা হোক।’
‘মানুষজন থাকুক আর যেই থাকুক। ভেতরে তো যাই আগে।’
‘আমার ভাড়াটা দিয়ে যান। দেড়শো টাকা, এক টাকাও কম নেব না।’
‘হ্যাঁ, তুমি তো এক টাকাও কম নেবে না জানি। আমার কাছে অতটা খুচরো টাকা নেই। তুমি একটু দাঁড়াও। ভেতর থেকে এনে দিচ্ছি আমি। দরকার হলে না হয় মাসিমণির কাছ থেকে চেয়ে আনছি।’
‘ওই দেখ। বোঝো ঠ্যালা। এখন টাকা আনতে ভেতরে যাবেন, কখন ফিরবেন কে জানে? আমি সঙ্গে যাব?’
‘ভেতরে যাবে? মাথা খারাপ তোমার? ভয় নেই, দেড়শো টাকা তোমার মার যাবে না। দিচ্ছি।’
পথিক ভেতরে চলে গেল লাফিয়ে।
জগু অপেক্ষা করছে। একবার রিকশ থেকে নামছে, একবার উঠছে। বাড়িগুলো যেন আঁধারে হারিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলাতেই এদিকে খদ্দের আসে না। রাতের সওয়ারি তো দূরের কথা। কেউ ফিসফাস করে কথা বলছে নাকি? না, গাছের পাতায় হাওয়া লেগে অমন শব্দ হচ্ছে। এক মিনিটও যেন কুড়ি মিনিট মনে হচ্ছে। কেমন যেন রাতটা! অধৈর্য হয়ে জগু সাইকেলের ঘণ্টি বাজাল জোরে।
বাড়িটার দোতলার বারান্দায় এসে পথিক দাঁড়াল, ‘আরে জগু, এত রাতে কেউ অমন সাইকেলের ঘণ্টি বাজায়? এতদিন পর মাসিমণির সঙ্গে দেখা হল, কথা বলব না? এই নাও তোমার ভাড়া। দেড়শো মতোই আছে। হাতটা বাড়াও, আর নীচে নামতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আমি এখান থেকে দোতলার বারান্দায় হাত বাড়াব? নেমে এসে দাও না।!
‘তুমি না বাড়ালে আমাকেই বাড়াতে হবে হাতটা। এই নাও।’
জগু দেখল দোতলার বারান্দা থেকে পথিকের হাতটা ইয়া লম্বা হয়ে তার সামনে চলে এসেছে। হাতের তালুতে দেড়শো টাকা। জগুর চোখ কপালে। ঝাঁপিয়ে উঠল রিকশর সিটে। প্যাডেলে চাপ দিল সমস্ত শক্তি দিয়ে। রিকশ দু’বার গড়িয়েই থেমে গেল। জগু ভাবল ওই হাতটা আরও লম্বা হয়ে নিশ্চয়ই তার পেছনে আসছে। চাকাটা চেপে ধরেছে নিশ্চয়ই। তাই তো প্যাডেল করলেও চাকা নড়ছে না।
জগু চেঁচিয়ে উঠল, ‘চাই না টাকা। ক্ষমা করে দাও। ছেড়ে দাও।’
রাতের বাতাস যেন বলে উঠল, ‘তাই কী হয়? আমরা কারও ঋণ রাখি না। দেখলে না?’
জীবনপণ করে জগু তার সাইকেলের চাকায় চোখ রাখল। মরতে হলে শেষ চেষ্টা করেই মরা ভালো। দেখল কোনও হাত নেই, ওর নিজেরই কম্বলটা গা থেকে খুলে চাকার মধ্যে জড়িয়ে গেছে। এক হ্যাঁচকা টানে খুলে নিল কম্বল। তারপর সাইকেলে উঠে আপ্রাণ চাপ দিল প্যাডেলে। তরতর করে সাইকেল এগল।
জগুর মনে হল কে যেন তার পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে পাশ থেকে বলে উঠল, ‘তোমার ওই কম্বল ছিঁড়ে গিয়েছে। একদিন সময় করে এসে একটা জ্যাকেট নিয়ে যেও জগুদাদা। রাত্রিটা তেমন খারাপও নয়, কী বল? ভেবেছিলাম তুমিও আমাদেরই একজন। তাই তো হাত বাড়াতে বলেছিলাম।’