বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা

অতীতের আয়না: নতুন পোশাক ও জাদুকর কারিগর
অমিতাভ পুরকায়স্থ 

ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। নতুন জামাকাপড় কেনাও হয়ে গিয়েছে সকলের। কলকাতা গড়ে ওঠার দিনগুলিতে সুতানুটির তালুকদারি পেয়ে মহারাজ নবকৃষ্ণ নানা পেশার মানুষ এনে সেখানে বসালেন। কুমোরদের থাকার এবং কাজ করার আলাদা জায়গা হল। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই শান্তিপুর থেকে দর্জিদের এনে বসালেন আলাদা পাড়ায়। এই দর্জিরা দেব পরিবারের সদস্যদের পোশাক তৈরি করতেন। এভাবেই উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়া অঞ্চলের পত্তন হল।   
এই দর্জিদের মধ্যে মস্ত ওস্তাদদের দক্ষতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তার হদিশ পাওয়া যায় বিখ্যাত শিল্পী পরিতোষ সেনের স্মৃতিকথায়। ছোটবেলায় তাঁরা থাকতেন ঢাকার জিন্দাবার লেন নামের গলিতে। প্রতিবেশীদের মধ্যে ছিলেন খিটেখিটে মেজাজের দর্জি হাফিজ মিয়াঁ। পরিতোষ লিখেছেন যে,  দীর্ঘকাল ভুগে হাফিজ দর্জির অস্থিচর্মসার দেহটি দেখে মনে হতো অবিকল যেন অনশনরত গান্ধার শৈলীর বুদ্ধমূর্তি। একদিন ঢাকার নবাব বাড়ির কোনও সদস্য গাড়িতে করে দোকানে হাজির। পশমী কাপড় দিয়ে গৌরকান্তি যুবকটি দর্জিকে তাঁর মাপের কোট বানিয়ে দিতে বললেন। উত্তরে মিয়াঁ অনুরোধ করলেন কাপড় রেখে যেতে আর তিনদিন বাদে ট্রায়ালের জন্য আসতে। কথা শুনে নবাবজাদা সেখানেই পড়ে যান আর কী! লোকটা মাপ নিল না, কিছু লিখল না, ট্রায়াল হবে কী রে! সেকথা দর্জিকে বলতেই প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে আগের কথাই আরও একবার শুনিয়ে দিলেন হাফিজ। প্রবল সংশয় নিয়ে ঠিক তিনদিন পর আবার হাজির নবাবজাদা। এর মধ্যে হাফিজ কাপড় কেটে মোটামুটি তৈরি করে রেখেছেন কোট। নবাবজাদা আসতেই তাঁকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আলতো করে পরিয়ে দিলেন সেই কোট। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রায় নিখুঁত কাটিং আর ফিটিং! কাঁবের পুট, আস্তিন, বগল সব ঠিক। শুধু পিঠে একটু ভাঁজ পড়েছে। সেখানে ক’টা আলপিন গেঁথে কোট খুলে নিল হাফিজ। নবাবজাদার চোখ ছানাবড়া। বেরনোর সময় তার মুখে একটাই কথা – কামাল কামাল! গজব গজব! দু’ঘণ্টার মধ্যে বাকি কাজ শেষ করে সুন্দর ভাঁজে ইস্ত্রি করা কোট পৌঁছে গেল নবাব বাড়ি। 
এদেশীয় ধনী শ্রেণির মতো ব্রিটিশ সাহেবরাও বাড়ির আর পাঁচজন গৃহসহায়কের মতো অষ্টাদশ শতক থেকেই মাস মাইনে দিয়ে দর্জি রাখতেন। ১৭৫৯ সালে তাদের মাইনে ছিল মাসে তিন টাকা। আঠেরো শতকের পর্যটক ফ্যানি পার্কস কলকাতায় তাঁর হয়ে কাজ করা দর্জিদের সম্পর্কে অনেক মজার খবর দিয়েছেন। তাঁর একদল গৃহসহায়কের মধ্যে একমাত্র দর্জি ছাড়া কেউই একবর্ণ ইংরেজি বলতে পারত না। দর্জির কাজের মান প্রায় ফরাসি কারিগরদের স্তরে মনে করেছিলেন মেমসাহেব। তবে একই সঙ্গে তার ছুরি কাঁচি থেকে টুকিটাকি জিনিসপত্রের হাত টানের  প্রসঙ্গও উল্লেখ করতে ভোলেননি মিসেস পার্কস। 
কোম্পানির আমল শেষে মহারানির রাজত্ব শুরু হওয়ার পর মেমসাহেবরা আরও বেশি করে ভারতে আসতে শুরু করলেন। ভারতীয় গৃহসহায়কদের নরমে-গরমে ‘মানুষ’ করার নিদান ঘোষিত হতে থাকল সেকালের সহায়ক গাইড বইগুলিতে। স্টিল ও গার্ডেনারের বইতে পরিষ্কার লেখা হল যে, ভারতীয় গৃহসহায়করা শিশুর মতো। তাদের মধ্যে কোনও কর্তব্য বোধ থাকে না। তাই তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাড়ির কাজের যোগ্য করে তুলতে হয়। এই বইটিতে বাড়ির দর্জির কাজের পরিধি পরিষ্কার করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, দর্জিদের নিজের মতো কাপড় কাটতে দেওয়া উচিত নয়। হয় গৃহকর্ত্রী নিজে কেটে দেবেন বা কাটার সময় দাঁড়িয়ে থেকে নির্দেশ দেবেন। কলকাতায় মাস মাইনে দিয়ে দর্জি রাখার প্রয়োজন নেই। তবে রাখতে হলে তার মাইনে হবে পনেরো টাকা। তার পরিবর্তে পুরো আট ঘণ্টার কাজ যেন গৃহকর্ত্রী বুঝে নেন। মালকিন যদি নিজের কোনও পুরনো পোশাকের মাপ থেকে নতুন পোশাক বানানোর কথা ভাবেন, তাহলে কোনও সাহেব ড্রেসমেকারের পরিবর্তে দেশি দর্জিকে সেই কাজ করতে দিলে কোনও অংশে কাজ খারাপ হবে না। বরং অনেকটা সাশ্রয় হবে।  
জামাকাপড় সেলাই ছাড়াও এই দর্জিরা সাহেবদের শিকার অভিযানের সঙ্গীও হতেন শল্যচিকিৎসক হিসেবে। এই পেশায় ওস্তাগর, মানে মুসলমান কারিগরদের সম্মানে একসময় কলকাতায় বেশ কয়েকটি রাস্তার নাম রাখা হয়েছিল। তার মধ্যে গুলু ওস্তাগর, মিয়াজান ওস্তাগর, বুধু ওস্তাগর, 
রহিম ওস্তাগরের নামের কয়েকটি রাস্তা আজও 
টিকে আছে।   
এদেশীয় দর্জিদের পাশাপাশি, কলকাতার শৈশবে  বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় পোশাক নির্মাতাও এই পেশায় পশার জমিয়েছিলেন। ১৭৯৩ সালের কলকাতার বৃত্তিজীবী পেশাদারদের তালিকায় পাওয়া যায় বারোজন ইউরোপীয় দর্জির নাম। কলকাতার মেয়র্স কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট অব বেঙ্গলের বিভিন্ন  সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলার নথি এবং সেই সময়ের বিজ্ঞাপনে চোখ বোলালে বোঝা যায় যে, সাহেবরা নিজেদের নবাবি জীবনশৈলীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে  জামাকাপড়ের পেছনে হাত খুলে খরচ করতেন। পুরো সেট পোশাকের জন্য পাঁচশো গিনি পর্যন্ত খরচ করতেন। সেই জন্যই হয়তো মার্টিন নামে জনৈক পোশাক প্রস্তুতকারক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ভালো চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বছর দশেক দর্জির কাজ করে গিয়েছেন এ শহরে। আর ১৭৭৩ সালে দেশে ফেরার সময় দু’লক্ষ টাকার মতো সঞ্চয় করে ফেলার মধ্যে দিয়ে মার্টিন প্রমাণও করেছিলেন নিজের দূরদর্শিতা।
সাহেব টেলাররা কেমন পোশাক তৈরি করতেন, তার আন্দাজ পাওয়া যায় অ্যাটর্নি উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথায়। উকিল সাহেব লিখেছেন যে, এক বিশেষ উৎসবে পরার জন্য তিনি চুমকি বসানো সাদা সিল্কের লাইনিং দেওয়া সবুজ কোট বানিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল সাদা সিল্কের মানানসই নকশাদার ওয়েস্টকোট ও ব্রিচেস। এমন শৌখিন পোশাক ছাড়াও এখনকার গরমের জন্য দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার পোশাক পরিবর্তন করতে হতো সাহেবদের। সুতির কাপড় ছাড়াও বড়লোকেরা আইরিশ লিনেন ব্যবহার করতেন। এছাড়াও লন্ডনের সর্বশেষ ফ্যাশনের খবর রাখতেন কলকাতার অভিজাতরা। বিশেষ করে মহিলারা। ১৭৮৩ সালে গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের স্ত্রী সেই মরশুমের লন্ডনের টাটকা ফ্যাশনে সেজে কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ায় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছিল ‘Chemise á la Reine’ নামের পোশাকটি।  সাহেব দর্জিদের এই রমরমা কলকাতার পাশ্চাত্য ঘেঁষা বাবুদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে বাঙালি পরিবারগুলিতে যখন বিলেত যাওয়া শুরু হল। সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিলেত যাওয়ার কথা উঠলে সাহেব দর্জির থেকে পোশাক বানানোর কথা জানা যায় অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায়।
তবে শহরের সব দর্জিই ধনীবাড়ির পোশাক তৈরির বরাত পেত না। তারা রং ও রিপুর কাজ করত। গত শতকের প্রথম দিকেও কলকাতায় গৃহস্থ পাড়াগুলিতে অতি পরিচিত ডাক ছিল— ‘রিপুকর্ম করাবে গো’।
মেয়েরা রেডিমেড পোশাক কিনলেও কয়েক দশক আগেও ছেলেদের পছন্দ ছিল দর্জির কাছে মাপ দিয়ে জামা-প্যান্ট তৈরি। তাই পুজোর আগে থেকেই পাড়ার দর্জির দোকানে ‘অর্ডার ক্লোজড’ বোর্ড ঝুলত। এখন সময় বদলেছে। তৈরি পোশাকের দিকেই ঝোঁক সবার। কলকাতার পোশাক তৈরির কেন্দ্র মেটিয়াবুরুজের দর্জিরাও মূলত রপ্তানি ও তৈরি পোশাকের কাজেই ব্যস্ত। পাড়ার দর্জিদের সেই রমরমাও আজ স্মৃতি। 
4Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পেশাদারি উচ্চশিক্ষায় দ্রুত অগ্রগতি ও সেই সূত্রে কর্মপ্রাপ্তির  সুবর্ণ সুযোগ আসতে পারে। মিত্রবেশী শত্রু দ্বারা...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৬.৬৮ টাকা৮৮.৪২ টাকা
পাউন্ড১০৭.৫০ টাকা১১১.২৬ টাকা
ইউরো৮৯.৩০ টাকা৯২.৬৯ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা