অন্ধকার একটা টানেল। স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলা ধরা দেওয়াল। টানেলের ভেতরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় জল পড়ার আওয়াজ। সঙ্গে কিছু ‘অন্য’ আওয়াজও কানে আসে। না, এটা কোনও ভৌতিক সিনেমার প্লট নয়। খোদ ভারতের বুকেই রয়েছে এমন একটি ‘ভূতুড়ে’ টানেল। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি। আর স্থানীয় লোকবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন একজন ‘ব্যর্থ’ ইঞ্জিনিয়ার। যাকে নাকি আজও ‘ঘুরে বেড়াতে’ দেখা যায় এই সুড়ঙ্গ চত্বরে।
ভারতের মধ্যে যে কয়েকটি জায়গা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, সেগুলির মধ্যে পাহাড়ি শহর সিমলা অন্যতম। স্বভাবতই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই এই জায়গাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সিমলায় ঘুরে দেখার মতো একাধিক জায়গা রয়েছে। তবে এর অন্যতম আকর্ষণ ট্রয় ট্রেনে করে সিমলা পৌঁছনো। যাত্রীদের নিয়ে এই পাহাড়ি শহরে পৌঁছনোর সময় ট্রেনগুলিকে বেশ কয়েকটি সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে ছুটে যেতে হয়। সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে দীর্ঘতম সুড়ঙ্গটি রয়েছে সিমলা-কালকা রুটে। এই সুড়ঙ্গ পেরতে দু’মিনিটেরও বেশি সময় লাগে। এই সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে ট্রেনে চেপে যাওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা হলেও এক বিশেষ কারণে এই সুড়ঙ্গের ‘বদনাম’ও রয়েছে। অনেকের দাবি, এটি নাকি ভূতুড়ে সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গে নাকি তেনারা বসবাস করেন। সিমলা-কালকা রুটে থাকা এই সুড়ঙ্গের পোশাকি নাম— ‘টানেল-৩৩’ বা ‘বারোগ টানেল’।
ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকার অন্তর্গত এই রেলওয়ে জুড়ে রয়েছে ১০২টি টানেল। আগে অবশ্য এর সংখ্যা ছিল ১০৭। প্রকৃতির কোনও ক্ষতি না করে, তার সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখেই যে উন্নয়ন সম্ভব, প্রায় ১০০ বছর আগে সেটাই দেখিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা। চারদিকে পাহাড়ের গায়ে ঝলমল করছে পাহাড়ি ফুল, সবুজ গাছ। তার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রয় ট্রেন। দেখলে মনে হবে পোস্টকার্ডের দৃশ্য! এই হেরিটেজ রেলওয়েরই একটি অংশ বারোগ টানেল। কালকা-সিমলা রুটের সবচেয়ে লম্বা এই টানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.১৪ কিমি। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সবথেকে স্ট্রেট টানেলও এটিই। এখানকার সব টানেলই ১৯০০ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে তৈরি হয়। নানা ইতিহাস, নানা ঘটনার সাক্ষী থেকেছে এই বারোগ স্টেশন। সাক্ষী থেকেছে এই টানেলও।
আগে এই টানেলগুলোকে এক একটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। সেই হিসেবে বারোগ টানেলের ক্রমাঙ্ক ৩৩। এই সুড়ঙ্গের নামকরণ কর্নেল বারোগের নামানুসারে হয়েছে। ১৮৯৮ সালে বারোগকে এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বারোগ রেলের একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁকে পুরো সুড়ঙ্গটি তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সুড়ঙ্গ তৈরি নিয়ে বেশ কিছু হিসাব-নিকাশ করে বারোগ সুড়ঙ্গ তৈরির কাজে থাকা সমস্ত শ্রমিককে পাহাড়ের উভয় প্রান্ত থেকে গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন, এভাবে তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করা সম্ভব হবে। তবে পরে তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর করা হিসাবে কোনও কাজ দেয়নি। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়নি। এ ছাড়াও দু’পাশ থেকে খুঁড়তে শুরু করা শ্রমিকেরাও এক জায়গায় এসে কাজ
শেষ করেননি।
আসলে হিসেবে সামান্য ভুল হয়েছিল। ফলস্বরূপ, রাস্তা এক জায়গায় এসে মিলল না। কর্মীরা তো বুঝতে পারলই, বারোগও বুঝতে পারলেন খুব বড় একটা ভুল হয়েছে। পুরো কাজটা ব্যর্থ হল। যথারীতি খবর পৌঁছল ব্রিটিশ সরকারের কাছে। রেল ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল বারোগকে ১ টাকা জরিমানা করা হল। এদিকে তাঁর কর্মীরাও বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। সাহেবের ভুলের জন্য এতদিনের পরিশ্রম বিফলে গেল। অবসাদে চলে গেলেন বারোগ। সমস্ত ব্যর্থতার দায় যে তাঁরই! যাবতীয় সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে
পড়লেন তিনি।
শোনা যায় যে, এই ঘটনার কিছু দিন পরে এক রাতে তাঁর পোষা কুকুরের সঙ্গে বেড়াতে বেরন বারোগ। সঙ্গে ছিল তাঁর পিস্তলও। ওই সুড়ঙ্গের কাছাকাছি এক জায়গাতেই নিজেকে গুলি করে আত্মঘাতী হন তিনি। মালিককে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চিৎকার শুরু করে বারোগের পোষ্যটি। কিন্তু যখন মানুষ বারোগকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন, ততক্ষণে তিনি মারা গিয়েছেন। বারোগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁকে ওই অসম্পূর্ণ সুড়ঙ্গের বাইরেই সমাধিস্থ করা হয়। তবে স্থানীয়দের বিশ্বাস যে, তিনি কখনও ওই সুড়ঙ্গের মায়া এবং অপমানের কথা ভুলতে পারেননি। ওই সুড়ঙ্গেই ঘুরতে থাকে বারোগের অতৃপ্ত আত্মা।
তারপর ১৯০৩ সালে টানেল নম্বর ৩৩-এর কাজ শেষ করেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার এইচ এস হ্যারিংটন। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন এক ভারতীয় সাধু, বাবা ভালকু। তারপর, ইতিহাস এগিয়েছে নিজের মতো। কত লোক এসেছেন, গিয়েছেন। কিন্তু লোকের বিশ্বাস, একজন এখনও এই টানেলের চারপাশে রয়েছেন। তিনি, প্রয়াত বারোগ!
সিমলার স্থানীয়দের বিশ্বাস, বারোগের প্রেতাত্মা এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বারোগ বেশ কিছু মানুষকে দেখা দিয়েছেন বলেও স্থানীয়দের দাবি। ট্রেনযাত্রীদেরও অনেকেই জানিয়েছেন যে, সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরাও কিছু ‘ব্যাখ্যাতীত’ ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। এই টানেলের ভেতর ঘণ্টায় ২৫ কিমি স্পিডে চলে ট্রয় ট্রেন। পেরতে সময় লাগে আড়াই মিনিট মতো। এই সময়ের মধ্যে অনেকেই নাকি ‘কিছু’ দেখেছেন। টানেলের ভেতর ঢুকলে, নিস্তব্ধতা ভেদ করে আসে ফিসফিস আওয়াজ। পাশাপাশি হার্লিংটনের নেতৃত্বে কাজ করা শ্রমিকরাও নাকি একাধিক বার বারোগের ‘ভূত’-এর পাল্লায় পড়েছিলেন বলে সেই সময় শোনা গিয়েছিল। তা নিয়ে নানান গল্পও ফাঁদা হয়েছিল।
‘ভূত’ সত্যিই আছে কি না, সেটা তো তর্কের বিষয়। কিন্তু টানেলের ইতিহাস, তার চেহারা দেখলে একটা গা ছমছমে ব্যাপার আসে তা তো বলাই বাহুল্য।