নভরোজ এগিয়ে আসছে। দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস, রংমহল, খাস মহল, মোতি মহল জেগে উঠছে ক্রমেই। রং করা হচ্ছে দেওয়াল। পাঁচিল। সামনেই বয়ে যাওয়া যমুনার প্রতিটি নৌকাকেও রং করেছে তাদের মালিকরা। কারণ এই নতুন বছরের প্রথম উৎসব নভরোজ থেকে শুরু হল মুঘল বাদশাহ পরিবারের সদস্যদের কারণে অকারণে নৌকাভ্রমণ। অতএব তৈরি থাকতে হবে। লালকেল্লার প্রতিটি পাঁচিল, দেওয়াল ও বহিরঙ্গে একই রং যেন পুনরাবৃত্তি করা না হয়। অতএব প্রতি বছরই দেখা যায় রং বদলে গিয়েছে। নৌকার রংও বদলে যায়। বদলে যায় বাদশাহ শাহজাদা শাহজাদি বেগমসাহিবাদের পোশাকের রং। প্রতিটি নভরোজে এক-দু’মাস আগেই জ্যোতিষীরা বলে দেবে যে, এবারের নভরোজের কী রং। প্রতিটি বছর মানুষের জীবন তো সমান যায় না। কখনও সুখ, কখনও বেদনা, কখনও মিলন, কখনও বিচ্ছেদ, কখনও প্রাপ্তি, কখনও অপ্রাপ্তি, কখনও হাসি, কখনও কান্না। আর তাই জীবনের রঙের সঙ্গে বছরের রং বদলায়। অতএব হিন্দু ও মুসলিম উভয় জ্যোতিষীদেরই পরামর্শ নিয়েছেন শাহজাহান, দারা শিকোহ অথবা মুহম্মদ শাহ। ব্যতিক্রম ছিলেন অবশ্যই আওরঙ্গজেব। এসব অতিরিক্ত উৎসবপ্রিয়তা তাঁর ছিল না। আর তাই প্রজা থেকে পরিবার। সকলেই থেকেছে তটস্থ। তবে যেদিন থেকে এই লালকেল্লার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সবথেকে ভালো সময়টা কেটেছে প্রতিষ্ঠাতা ওই শাহজাহানের আমলেই। তারপর রীতিগুলি সবই ছিল। কিন্তু ক্রমেই যেন ফ্যাকাশে হয়েছে। মহম্মদ শাহ ও বাহাদুর শাহ জাফরের সময়কালে ছিল শেষতম উজ্জ্বলতা। অবশ্য, আর্থিক উজ্জ্বলতা কম ছিল। তবে ছিল আন্তরিক মিলনোৎসব হয়ে ওঠার এক চিত্র। লালকেল্লার কাহিনি তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু একটি লালকেল্লার মধ্যেও যে একঝাঁক মনোমুগ্ধকর এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ খণ্ডকাহিনি রয়েছে সেটাও সমান প্রণিধানযোগ্য। যেমন দেওয়ান-ই-খাস। দেওয়ান-ই-খাসের পাথর, তার কুশল শিল্পকার্য, দেওয়ালে খচিত চুনি, পান্না। নভরোজ এগিয়ে আসছে। তাই সাজানো হবে দেওয়ান-ই-খাস। অঙ্গুরীবাগ আর গুলাবী বাগকে যেন ঠিক নববধূর মতো দেখতে হয়। ফুল, রঙিন দোপাট্টা, চাঁদোয়া যেন ঘোমটা। যে শামিয়ানার নীচে নবাব, সামন্ত, উজির, সুবেদাররা এসে বসবেন, সেটায় যেন জ্বলজ্বল করে সোনা আর রুপো কেটে সরু সরু সুতোর মতো তৈরি নকশাদার ফিতে দেখতে পান। তাঁদের চোখে যেন এসে ঠিকরে যায় সেই সোনা-রুপোর আলোকময় দ্যুতি। যাতে সন্ধ্যা হওয়ার পর উৎসবের রাতে অন্ধকারে সকলেই মনে করে আকাশের তারকারাজি এত কাছে নেমে এসেছে কীভাবে? অর্থাৎ ওই শামিয়ানা হবে আকাশ। আর ওই সোনা রুপোর তারকাগুচ্ছ হবে আকাশের নক্ষত্র।
দরবার তৈরি। আজ নভরোজ। জাঁহাপনা হাজির হবেন এবার। রুপোর একটি পালঙ্কে চেপে। যার নাম হাওয়াদার। আর সেই পালকির মধ্যে রয়েছে সিংহাসন। সেখানেই বসে আছেন সম্রাট। সেই সিংহাসন নামিয়ে আনা হবে মাটিতে। পা রাখবেন সম্রাট সবুজ মখমল গালিচায়। দিওয়ান-ই-খাসের ঠিক মধ্যবর্তী স্থানের কৌণিক মার্বেল পাথরের মঞ্চে রাখা আছে বৃহৎ সিংহাসন। যার নাম তখত-ই-তাউস। সম্রাট বসছেন সেখানে। শুরু হবে নভরোজের আচার। শাহজাদারা এসে বসবেন ডানদিকে, বাঁদিকে। শাহজাদিরা থাকবেন চিকের আড়ালে। এরপর দিওয়ান-ই-আমের দিকে অগ্রসর হয়ে বাদশাহ অপেক্ষা করবেন জয়ধ্বনির। সেখানে হাজির সাধারণ সেনার দল। কর্মীরা। দাসদাসী। ঘোড়া ও হাতিচালক। বিরাট বড় বড় জালা নিয়ে আসা হয়েছে। কী আছে এত বড় জালায়? জল? পানীয়? লাল ও সবুজ মখমল কাপড়ে মোড়া। এবং সেই জালার পাশে সারিবদ্ধ রেকাবি হাতে কেল্লার পরিচারকবৃন্দ। জালা অথবা বৃহদাকার সেই কলসি খুলে রেকাবিতে রাখা হচ্ছে অবিশ্বাস্য বস্তু। স্বর্ণমুদ্রা। কেন? বাদশাহ এবার এই স্বর্ণমুদ্রা আকাশের দিকে ছুড়বেন। আর কুড়িয়ে নেবে তাবৎ কর্মীর দল। কোনও বিশৃঙ্খলা ছাড়াই। কীভাবে? কারও কাছেই যেন একটির বেশি দু’টি মুদ্রা পাওয়া না যায়। বেরনোর আগে তাদের পরীক্ষা করা হতে পারে। পাওয়া গেলেই মুঘল দরবারের কাজ হারাতে হবে। এভাবেই ঈদ পালিত হয়। শুধুই কি দিওয়ান-ই-খাস দেখেছে মুসলিম পরব? না। সম্রাট শাহজাহান অথবা মহম্মদ শাহ কিংবা বাহাদুর শাহের আমলে নিয়ম ছিল সব ধর্মের উৎসব পালিত হবে দিওয়ান-ই-খাস থেকেই। অতএব ন’দিন ধরে রামলীলা উৎসবের সূত্রপাত হবে দিওয়ান-ই-খাস থেকে। রামলীলার কুশীলবদের প্রথম দক্ষিণা হাতে তুলে দেবেন বাদশাহ। দশেরার দিন দিওয়ান-ই-খাসে নিয়ে আসা হবে নীলকণ্ঠ পাখি। রাখা হবে বাদশাহের সামনে। বাজখানার দারোগা অর্থাৎ যে পাখিদের দেখভাল করে, সে সতর্ক হয়ে নীলকণ্ঠকে রাখবে বাদশাহের হাতে। হিন্দু প্রজা, সেনা, কর্মীদের ধর্মীয় ধ্বনির মধ্যেই বাদশাহ উড়িয়ে দেবেন সেই নীলকণ্ঠ। তারপর হবে শাহজানাবাদ ও দিল্লি জুড়ে দশেরার উৎসবের সূচনা। সারাদিন পর আবার সেই উৎসবের সমাপ্তি হবে দিওয়ানি-ই-খাসের সামনে। সেখানে কী হবে? হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় পরস্পরকে আলিঙ্গন করবে। অনুষ্ঠানের নাম ছিল— ভারত মিলাপ! অর্থাৎ ভারত ঐক্য।
দিওয়ান-ই-খাস দেখেছে এই সম্প্রীতি। দিওয়ান-ই-খাস দেখেছে এই সম্প্রীতি বন্ধ হওয়া। দিওয়ান-ই -খাস দেখেছে লক্ষ্মীপুজার সন্ধ্যায় নিজের শরীরে ওজনের সমান স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা কোনও বাদশাহ বিলিয়ে দিয়েছেন ভিক্ষুকদের মধ্যে। বাদশাহের দরবারে প্রসাদ পাঠিয়েছে হিন্দু প্রজারা রেকাবিতে করে। আবার কোনও বাদশাহ এই রীতি বন্ধ করে দিয়ে নিষ্প্রদীপ করেছে পুজোর উজ্জ্বলতাকে। চলে গিয়েছে সময়। বয়ে গিয়েছে কাল। রয়ে গিয়েছে শুধু দিওয়ান-ই-খাস! এখন প্রতিদিন তার সামনে হাজির হয় দেশের সব প্রান্তের পর্যটক। সব ধর্মের মানুষ। আর দিওয়ান-ই-খাস নীরবে প্রত্যক্ষ করে নিত্যদিনের এই চিরন্তন ভারত মিলাপ!