হরিদ্বার ভ্রমণ? তাহলে দিল্লি হয়ে যাওয়াই ভালো। সরাসরি তো যাওয়াই যায়। কিন্তু দিল্লি হয়ে গেলে একটা দিন দিল্লিও দেখা হয়ে যাবে আর তারপর ভোরের শতাব্দী অথবা বাস কিংবা গাড়িতে হরিদ্বার-হৃষীকেশ গেলেই হল! আগ্রা, বৃন্দাবন, মথুরা, ভরতপুর যাব ভাবছি। দিল্লি হয়েই তো যেতে হবে। আবার সিমলা কিংবা রাজস্থান? সেক্ষেত্রেও ওই দিল্লি ছুঁয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ থাকে। অর্থাৎ উত্তর ভারত ভ্রমণে দিল্লিকে স্পর্শ করে যাওয়া কিংবা আসা-যাওয়ার পথে এক-দু’দিন দিল্লিতে থেকে গিয়ে ‘লোকাল ট্যুরে’র প্ল্যান অতি পরিচিত।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বাগ্রে কী মনে আসে? থাকব কোথায়? আবহমান সময় ধরেই বাঙালি পর্যটকের কাছে দিল্লিতে থাকার জায়গা দু’টিই। দিল্লি কালীবাড়ি কিংবা পাহাড়গঞ্জ। ক্রমেই এসেছে আরও নানাবিধ বিকল্প। একাধিক বাঙালি সংস্থা পরিচালিত কালীবাড়ি। দক্ষিণ দিল্লি, চিত্তরঞ্জন পার্ক, গ্রেটার কৈলাসের দুর্গাবাড়ি, ময়ূর বিহার, মাতৃমন্দির ইত্যাদি। বাঙালি খাওয়া, বাঙালি থাকা ও মন্দির।
দিল্লি ভ্রমণের খুঁটিনাটি বলার জন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণা নাকি? একেবারেই নয়। একটিমাত্র স্থানের মাহাত্ম্য বর্ণনা উদ্দেশ্য। পাহাড়গঞ্জ। শুধু বাঙালি নয়। ভারত হোক অথবা নেদারল্যান্ড। বিশ্বের যেকোনও প্রান্ত থেকে আসা পর্যটক, পরীক্ষার্থী, ইন্টারভিউ দিতে আসা কর্মপ্রার্থী কিংবা ছোটবড় ব্যবসায়ী। সকলের কাছে সবথেকে সুবিধাজনক থাকার স্থান হিসেবে জনপ্রিয়তায় এক নম্বর পাহাড়গঞ্জ। আজও সমান জনপ্রিয়। কেন? কারণ দিল্লি স্টেশনের লাগোয়া। অসংখ্য হোটেল। অসংখ্য খাবার দোকান। এবং বাস, ট্রেন, মেট্রো, অটো, ই-রিকশ। সবই একই একটিই স্থানে।
নয়াদিল্লি স্টেশনের দু’টি প্রবেশ এবং প্রস্থান দিক। একটি ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। আজমীরি গেট প্রস্থানদ্বার। আর অন্যটি ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিক থেকে প্রবেশ ও প্রস্থান দ্বার। এই ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে দিল্লি শহরে পা রাখলেই ঠিক উল্টোদিকের যে জনপদ তাকেই বলা হয় পাহাড়গঞ্জ। যা হোটেলের স্বর্গরাজ্য। খাদ্যের সুরম্যক্ষেত্র। ট্রেন থেকে নেমেই হোটেল চাই? পাহাড়গঞ্জ। খুব ভোরে ট্রেন ধরতে হবে? পাহাড়গঞ্জ হোটেলই ভরসা। অতএব হোটেল এবং খাদ্যভাণ্ডারের জন্য তো বটেই, একটি যাতায়াতের পথে অস্থায়ী আস্তানার জন্য পাহাড়গঞ্জ আদর্শ।
সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করেছিলেন শাহজাহানাবাদ। অর্থাৎ আজকের পুরনো দিল্লি যেখানে। বাজার, তবায়েফ খানা, মীনাবাজার, সরাইখানা, ব্যবসায়ীদের আগমন, ভাগ্য ফেরানো, সঙ্গীত-সাহিত্য চর্চা, লালকেল্লা, যমুনা, বাদশাহদের মেজাজ মর্জি, চক্রান্ত, সংঘর্ষ, গুপ্তহত্যা, উত্থান-পতন— এই তাবৎ ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে ওই চাঁদনি চক, লালকেল্লাকে কেন্দ্র করেই। শাহজাহান থেকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।
কিন্তু ওই আলোকোজ্জ্বল ইতিহাস বই থেকে কিছুটা দূরেই নিজের একক অস্তিত্ব বজায় রেখে যেন প্রতিটি ঘটনাকে নীরবে পর্যবেক্ষণ করে গিয়েছে একটি বাজার। একটি জনপদ। তার নাম পাহাড়গঞ্জ। যে নিজেও অসংখ্য ঘটনার পটভূমি। অথচ জনমনে সেগুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা কম।
দিল্লিতে নাদির শাহ ১৭৩৯ সালের ওই গণহত্যা ঘটালেন কেন? কেনই বা দিল্লির মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ শিখাও প্রদীপে পরিণত হয়েছিল? তার কারণও এই পাহাড়গঞ্জ। নাদির শাহের সেনাবাহিনী এই পাহাড়গঞ্জ বাজারে এসেছিল কেনাকাটা করতে। তাদের পণ্য বিক্রি করতে রাজি হয়নি দিল্লিবাসী কিছু ব্যবসায়ী। সেই নিয়ে তর্কবিতর্ক। দিল্লিবাসী কম যায় না। দুর্ধর্ষ নাদির শাহ সেনাবাহিনীর কিছু সেনাকে সংঘর্ষে খতম করে দেওয়া হল। আর সেই রাগেই নাদির শাহের হরিয়ানার কার্নাল থেকে দিল্লি অভিযান। এমনকী সেই অভিযানের সময় হঠাৎ তার উপর ইট পাথর ছোঁড়া হয়েছিল। ব্যস! হুকুম দিলেন কতল এ আম। রক্তে ভেসে গেল দিল্লি।
সিপাহি বিদ্রোহ চলছে। সিপাহিদের দ্রোহে কাঁপছে দিল্লির ব্রিটিশ বাহিনী। ১৮৫৭ সাল। মিরাটে যার সূত্রপাত। মিরাটের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ফতেপুরের ডেপুটি কালেক্টর থিও মেটকাফ সিপাহিদের বিদ্রোহের সংবাদ পেয়েই ভাবলেন দিল্লিতে আগে কোম্পানিকে খবর দিতে হবে। নিজেই রওনা হলেন ১১ মে। এসে পৌঁছলেন। বললেন ব্রিটিশ রেসিডেন্টকে যেকোনও মুহূর্তেই আসতে চলেছে সিপাহিরা। সাবধান।
তাঁকে ফিরতে দেওয়া হল না। বলা হল নজফগড়ের যুদ্ধে যেন তিনি বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু কোনও যুদ্ধেই কিছু লাভ হল না। সিপাহিদের কাছে সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। দিল্লি দখল করল সিপাহিরা। আর শুরু হল ব্রিটিশ হত্যা ও বিতাড়ন। আতঙ্কিত ইউরোপিয়ানরা পাগলের মতো দিল্লি থেকে পালাচ্ছে। খোদ মেটকাফের বাড়িও রেহাই পায়নি। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হল।
প্রাণ বাঁচাতে হবে মেটকাফকে। কোথায় যাবেন? লালকেল্লা, চাঁদনী চক, শাহজানাবাদের ধারেকাছে তাঁকে দেখা গেলে আর রক্ষা নেই। আলো আঁধারি দিল্লির রাস্তায় ঘোড়ায় চেপে জঙ্গলের ভিতর থেকে যমুনার তীর ঘেঁষে প্রাণভয়ে ১৮৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পালাচ্ছেন এক ব্রিটিশ ডেপুটি কালেক্টর! সিপাহিদের ভয়ে।
অবশেষে দেখা যাচ্ছে আলো। দূর থেকে। একটি জনপদ। এসে দেখলেন এটাই পাহাড়গঞ্জ। বাজার আছে। বসতি আছে। তবে শাহজানাবাদের মতো উজ্জ্বল নয়। একটু যেন ম্লান। মুঘল আমলের কোতোয়ালিতে গেলে কি রক্ষা পাওয়া যাবে? পথেঘাটে ঘোরার থেকে সেটাই ভালো। অতএব সোজা কোতোয়ালিতে গেলেন।
পাহাড়গঞ্জ কোতোয়ালির কোতোয়াল সাহেব কে এখন? মুইন উদ দিন হুসেন খান। একজন ডেপুটি কালেক্টর পদের ব্রিটিশ প্রায় হাতে পায়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চাইলেন। মুইন উদ দিন হুসেন খান দেখলেন, একজন মানুষ প্রাণের ভিক্ষা চাইছে। তাকে কি সিপাহিদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত? আবার এই ব্রিটিশরাই আজ নয় কাল আবার তাঁদের উপর, তাঁদের বাদশাহের উপর দাদাগিরি করবেন হয়তো। তবু প্রাণ রক্ষার্থে এসেছেন যিনি, তাঁকে রক্ষা করাই তো ধর্ম। অতএব মুইন উদ দিন হুদেন খান থিও মেটকাফকে নিরাপদে দিল্লির বাইরে চলে যেতে সহায়তা করলেন। মেটকাফ চলে গেলেন রাজপুতানায়। কে ছিলেন এই মুইন উদ দিন হুসেন খানের সম্পর্কিত দাদা? মির্জা গালিব!
দিল্লি রাজধানী হয়ে আসার পর নতুন দিল্লি নামক নয়া শহর গড়ে তোলা হবে। ১৯২০ সালে নজর দেওয়া হল পাহাড়গঞ্জে। স্যার এডুইন লুটিয়েন্স সাজাচ্ছেন দিল্লিকে। পাহাড়গঞ্জ হয়ে উঠল বাণিজ্যিক কেন্দ্র। যার কেন্দ্রস্থলে ইম্পিরিয়াল সিনেমা। ১৯৩০ সাল। আশ্চর্য স্থাপত্য। এখানে ঢুকলে
দেখা যায় মানুষ নড়ছে চড়ছে। অথচ পর্দায়। এর নাম বায়োস্কোপ। তবে কথা বলে
না কেউ।
পাহাড়গঞ্জে সাইলেন্ট সিনেমার যাত্রা শুরু হল ইম্পিরিয়াল সিনেমা হলের হাত ধরে। তবে নিয়ম ছিল যতক্ষণ না দর্শকে পূর্ণ হয়ে যাবে সিনেমা হল, ততক্ষণ সিনেমা শুরু হবে না। তাই বলে কি অতক্ষণ ধরে বসে থাকবে দর্শক? তা কেন? যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হচ্ছে, ততক্ষণ হবে বাইজিদের নৃত্য! অর্থাৎ সিনেমার টিকিটে বাইজিনৃত্য ফ্রি! পাহাড়গঞ্জে ১৯৪৭ সালের পর থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু এসে দোকান চালু করল। কোনওমতে সংসার চালানোর কিছু ব্যবস্থা করতে হবে তো! অতএব মুঘল আমল থেকে উদ্বাস্তু। পাহাড়গঞ্জ এক চিরন্তন আশ্রয়খানা। দিল্লির একমাত্র স্থান যা জেগে থাকে ২৪ ঘণ্টা।
মুঘল এল। ব্রিটিশ এল। স্বাধীনতা এল। পাহাড়গঞ্জ চলমান ইতিহাস হয়ে আজও জেগে রয়েছে!