গল্পের পাতা

গুপ্ত রাজধানী: লালকেল্লা
সমৃদ্ধ দত্ত

জায়গাটা অনেকটাই কম। যেভাবে সাম্রাজ্য ছড়াচ্ছে আর হিন্দুস্তানের বাইরে থেকে আরও দলে দলে সমস্ত স্তরের মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ক্রমাগত এসেই চলেছে, এরপর তো রাজধানীটাই ঩ঘিঞ্জি হয়ে যাবে। আরও বেশি খোলামেলা জায়গা দরকার। কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় রাজধানী? ভাবছিলেন সম্রাট শাহজাহান। কয়েকজন উজির বলছিলেন, লাহোর হলে কেমন হয়? শাহজাহান কয়েকজন প্রতিনিধিকে পাঠালেন লাহোর। যাচাই করে দেখে আসার জন্য যে, ঠিক তিনি যেমন চাইছেন, সেরকম একটি কেল্লা এবং তার পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকাকে কেল্লারই এক সম্প্রসারিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব কি না। বিশেষ করে সেই প্রতিনিধি দলে গেলেন উস্তাদ আহমেদ লোহরি ও উস্তাদ হামিদও। এই দু’জনের মতামত বিশেষ জরুরি। কারণ তাঁরা এই আগ্রাতেই তৈরি করছেন আর একটি বিরাট অট্টালিকাসম সমাধিস্থল। যার নাম দেওয়া হবে তাজমহল। তাঁদের  পরিচালনায় যেভাবে কাজ হচ্ছে তাজমহলের, সেটি দেখে শাহজাহান সন্তুষ্ট। অতএব পরবর্তী রাজধানীর প্রধানতম হর্ম্য যে প্রাসাদ তথা কেল্লা, সেটা এই দু’জনই করবে। কিন্তু লাহোর তো খুবই ছোট এলাকা হয়ে যাচ্ছে! বাদশাহ যেমন চাইছেন, সেটা কিন্তু ওখানে করা সম্ভব নয়। সকলেই জানালেন সেকথা। অতএব নতুন স্থান নির্বাচন করতে হবে। 
হিন্দু জ্যোতিষী ও মুসলিম হেকিমদের সঙ্গে আলোচনা করে শাহজাহান বললেন, একটা কোনও শুভ স্থান চিহ্নিত করুন। কোথায় নতুন রাজধানী করা হলে মুঘল সাম্রাজ্যের সৌভাগ্য চিরকালীন বজায় থাকবে। অনেক ভেবেচিন্তে অধিকাংশই বলল, দিল্লিই সবথেকে ভালো হবে। দিল্লি? শাহজাহানের একটু দ্বিধা রয়েছে। কারণ দিল্লি খুব একটা সুখকর নয় মুঘলদের জন্য। হুমায়ুন আগ্রা ছেড়ে দিল্লিতে এসেছিলেন। নিজের রাজধানী নির্মাণ করে দীন পনাহ নামও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিহারের শেরশাহ সুরি সেই রাজধানী দখল করলেন। 
জ্যোতিষী আর হেকিমরা তো বটেই, স্থপতিরাও ঘুরে এসে বললেন, যেখানে হুমায়ুনের দীন পনাহ তৈরি হয়েছিল, সেখানে নয়। আমরা বরং সেলিমগড় আর ফিরোজাবাদের মাঝামাঝি স্থানে নতুন কেল্লা আর নগরীর পত্তন করতে পারি। ওই জায়গাটার কাছেই যমুনা নদী। সেলিমগড় একটা দ্বীপের মতো। শেরশাহের পুত্র সেলিম শাহ এই গড় নির্মাণ করেছিলেন। 
অতএব ওই স্থানই নির্বাচন হল। ১৬২৮ সালে শাহজাহান সিংহাসনে বসেছিলেন। আর ১৬৩৯ সালে মহরমের নবম দিনে ১২ মে নতুন রাজধানীর কেল্লা নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। যমুনার অদূরেই। মাটি খুঁড়ে প্রথম প্রস্তর দু’টি রাখলেন উস্তাদ হামিদ ও উস্তাদ আহমেদ। সম্রাট নির্দেশ দিলেন, দেরি করা কিন্তু চলবে না। যত দ্রুত সম্ভব নির্মাণ করতে হবে। 
ভারী মুশকিল। উস্তাদ হামিদ, উস্তাদ আহমেদের স্বপ্নের মহল তাজমহল এখনও পুরোপুরি সমাপ্ত হয়নি। অনেক কাজ বাকি। তার মধ্যেই আবার আর একটি কেল্লা। আর শুধুই কেল্লা নয়। একেবারে রাজধানী নগরীই স্থাপন করতে হবে। তাঁদের তো আগ্রায় থাকতে হবে। তাই স্থির হল, তাঁরা দু’জন সামগ্রিকভাবে দেখভাল করবেন। কিন্তু সারাক্ষণ পরিচালনার কাজটি করবেন অন্য একজন। 
ইজ্জত খান।  
তৎকালীন এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাকা হল কর্মী শ্রমিক স্থপতিদের। মিয়ামার, সঙ্গতারাশ, মুনাবকতার, পারছিনসাজ  সকলে এসে যুক্ত হল কেল্লা নির্মাণে। এই শব্দগুলি দিয়ে কাদের সম্বোধন করা হতো? স্থপতি, ভাস্কর, হস্তশিল্পী,  কুমোর, প্রস্তরশিল্পী। হঠাৎ দিল্লির এই ফিরোজাবাদ আর সেলিমগড় অঞ্চলে একটা যেন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। এখানে সেভাবে কোনও জনবসতিই নেই। জঙ্গল এলাকা। অরণ্যে যাতায়াত করা কিংবা মাঝিমাল্লার দল খুব নগণ্য অংশে বসবাস করে। 
এই অঞ্চলটির কাছে চেনাজানা স্থান বলতে তো সেই বুলবুলিখানা। যেখানে এক পুরনো প্রায় ভুলে যাওয়া শাসকের সমাধি রয়েছে।  কে তিনি? রাজিয়া সুলতানা। আর শাহ তুর্কমানের সমাধি ও মসজিদ। তাঁরই ভক্ত ছিলেন রাজিয়া। অতএব তাঁরই ইচ্ছানুসারে হয়তো এখানে ওই অতীত বিস্মৃতপ্রায় শাসকের সমাধি। কিন্তু বাকি সর্বত্র জঙ্গলে আকীর্ণ। সেই পরিত্যক্ত অংশ ক্রমেই প্রবল এক মহাযজ্ঞে নির্মিত হতে শুরু হল, একটি নতুন নগরাঞ্চল। যে শহর বহু প্রাচীন। একসময় যার নাম ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। বহু শাসক এসেছে এই শহরে। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে নিজেদের রাজধানী নির্মাণ করেছে। ক্রমেই নগরীর দক্ষিণ অংশ থেকে এই রাজধানী সরে এসেছে অন্যদিকে। 
৯ বছর সময় লাগল। ১৬৪৮ সালে সম্রাট শাহজাহানকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি লিখে মকরামাত খান বললেন, কেল্লার কাজ প্রায় শেষ।  দৌলতখানা ই বাদশাহি (রাজপ্রাসাদ) ও  দিওয়ান ই হজরত জিল ই লাহির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। সম্রাটের পদার্পণের অপেক্ষায়। আর দিওয়ান ই আম, দিওয়ান ই খাস, হামামের কাজ সম্পূর্ণ হবে, একবার সম্রাট নিজের চোখে দর্শনের পর। কারণ যমুনা থেকে জল খালের মাধ্যমে এখানে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা সম্রাট করেছেন, সেই নহর ই বেহস্ত সম্পন্ন করার শুভকাজটি সম্রাটের হাত দিয়েই সূত্রপাত হোক। অতএব সম্রাট যদি একবার পদার্পণ করেন! ইজ্জত খান পুরো সময়টা ছিলেন না। দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর হাতে থেকে কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন, আলিবর্দি খান। যিনি চলে গিয়েছিলেন বাংলার সুবেদার হয়ে। অতঃপর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এই মকরামাত খান। 
পদার্পণ করার আবেদন আবার কী? শাহজাহান তো এই দিনের জন্য অপেক্ষা করছেন আকুল হয়ে। তিনি ছিলেন কাবুলে। দ্রুত ঘোড়া ছোটালেন। পৌঁছনোর পর দেখা গেল উৎসবের পরিবেশ। একটা সিংহাসন বহন করছে বেহারারা। সেখানে বসেছেন সম্রাট শাহজাহান। ঠিক পিছনে বড় পুত্র দারা শিকোহ। যেটা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এক এলাকা, সেই স্থান আজ ভোজবাজিতে যেন পাল্টে গিয়েছে। মনোরম গাছে পূর্ণ বাগান, নদী থেকে টেনে আনা জলাশয়, অসংখ্য ফুলের বাগিচা। দেওয়ান ই আমের ঠিক সামনেই একটি বিরাট তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে। সম্রাটের অবস্থানের জন্য। যতক্ষণ না গৃহপ্রবেশের আচার সম্পন্ন হচ্ছে, ততক্ষণ তো আর তিনি ভিতরে গিয়ে কেল্লায় গিয়ে বিশ্রাম করবেন না। তাই ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করে এই তাঁবু নির্মিত। যার বাইরেটা সোনা দিয়ে কারুকাজ করা। তাঁবুর সামনে সামিয়ানা। চারটি রৌপ্যনির্মিত স্তম্ভ দিয়ে সেটি ধরা রয়েছে। 
চারটি প্রবেশদ্বার। সম্রাট শাহজাহান প্রথম বার যে তোরণদ্বার হয়ে প্রবেশ করলেন তাঁর সাধের কেল্লায়, সেটি হল, খিড়জি দরওয়াজা। ১৮ এপ্রিল ১৬৪৮। দিল্লিতে স্থাপিত হল নতুন রাজধানী। নাম শাহজানাবাদ। কেল্লার নাম কিলা ই মুবারক। ইতিহাসের আশ্চর্য এক নিয়তি নির্ধারণ! ঠিক ওই দরজা দিয়েই ১৮৫৭ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর চিরতরে মুঘল সাম্রা঩জ্যের বিদায় ঘটেছিল। শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এই দরওয়াজা পেরিয়ে বেরিয়ে যান বার্মা মুলুকে নির্বাসনে! 
এই হল কিলা ই মুবারক। ইতিহাসের লালকেল্লা! 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মস্থলে জটিলকর্মে অনায়াস সাফল্য ও প্রশংসালাভ। আর্থিক দিকটি শুভ। ক্রীড়াস্থলে বিশেষ সাফল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১০ টাকা৮৪.৮৪ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৪ টাকা১১২.১৯ টাকা
ইউরো৯১.৫৩ টাকা৯৪.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
14th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা