গল্পের পাতা

আমির খসরু ও বসন্ত উৎসব
সমৃদ্ধ দত্ত

সুফি সাধক হজরত নিজামউদ্দিনের কাছে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে শান্তির খোঁজে। স্বস্তির সন্ধানে। নিবেদিত প্রাণ নিয়ে তাঁরা সকল দুঃখ-দুর্দশা, ক্ষোভ ক্রোধের আহুতি দিতে চায় এখানে। এই নিজামউদ্দিনের কাছে। তিনি তো সাধারণ সাধক নন। আজমির দরগার খাজা মইনউদ্দিন চিস্তি। তারপর  খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি। যাঁর পরিচয় কুতব সাহিব। দিল্লির মেহরৌলিতে তাঁর পবিত্র দরগা। তারপর বাবা ফরিদ। পাকিস্তানের পাকপিত্তানে তাঁর দরগা। আর সেই পথ ধরেই এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া। যাঁর দরগা দিল্লির কেন্দ্রস্থলে। অতএব এটাই স্বাভাবিক যে, ইচ্ছাপূরণ অথবা হৃদয়কে শান্ত করার স্পর্শ পাওয়া যাবে তাঁর কাছেই। 
অথচ এহেন খাজা নিজামউদ্দিন সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গিয়েছেন কেন? আজকাল তিনি কোনও কথা বলেন না। বললেও খুব কম। দশবার ডাকলে একবার সাড়া দেন। তাঁর দোয়া পেতে দরবারে আসছে রোজই কয়েকশো মানুষ। সুলতানের বার্তাবাহক এসে এসে ফিরে যাচ্ছে। কেন? কারণ মহাসাধক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার প্রাণের থেকে প্রিয় ভাগ্নের মৃত্যু হয়েছে সদ্য। ওরকম এক তাজা ভালো মনের বালকের মৃত্যু যেন নিজামউদ্দিন আউলিয়ার বেঁচে থাকার ইচ্ছাই কেড়ে নিয়েছে। তিনি জানেন এবং বলেনও সকলকে যে, এই দুনিয়া কয়েকদিনের সরাইখানা। এখানে এসে তাই এমন কাজ করে যেতে হয়, এমন এক নিজের ভাবমূর্তি রেখে যেতে হয়, যাতে মৃত্যুর পর সকলেই এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে। সক঩লেই তোমাকে মনে করে উচ্চারণ করে যে, হ্যাঁ, মানুষটা ভালো ছিল। ছিল সুভদ্র। তাই আজ যাকে অপমান করছ,  মনে রেখ কাল যখন তুমি থাকবে না, সে তোমাকে একজন অপমানকারী, উদ্ধত মানুষ হিসেবেই জানবে। ঈশ্বরে সমর্পিত কর সব দুঃখ। সব আনন্দ। তোমার হৃদয় যেন কোনও বিষাদ অনুভূতিকে ধারণ করে না রাখে।
এহেন সাধক নিজামউদ্দিনকে এরকম মনমরা দেখে তাঁর ভক্ত ও শিষ্যরা সকলেই প্রচণ্ড কষ্টে আছে। ১২৩৮ থেকে ১৩২৫ সাল পর্যন্ত জীবনকাল ছিল হজরত নিজামউদ্দিনের। তাঁর জীবনাবসানের পর সেই স্থানের নাম আজকের নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগা। তিনি সকলের বেদনা দূর করেন কোমল কণ্ঠের বাণী শুনিয়ে। আর হজরত নিজামউদ্দিনের নিজের বেদনা বোধ কিংবা মন খারাপের সময়টায় কাকে দরকার হয় তাঁর। প্রিয়তম শিষ্য আমির খসরুর। এরকম গায়ক, এরকম কবি, এরকম ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা আর এই অনুভূতি এই দুনিয়ায় কার কার আছে? 
সুলতানের দরবারে একবার করে রোজ যেতেই হয়। খিলজিদের সভাসদ তিনি। কিন্তু বাকি সময়টায় আমির খসরুর গানের চর্চা, লেখালেখি আর  ঈশ্বরভজনা চলে গুরুর দরবারেই। অর্থাৎ খাজা নিজামউদ্দিনের কাছে। সেই আমির খসরু চেষ্টা করছেন কয়েকদিন ধরে। তাও পারছেন না। তাকিউদ্দিন নুহ ছিল তাঁর বোনের সন্তান। সর্বদাই খাজাজির সঙ্গে সঙ্গেই থাকত। কয়েকদিনের অসুস্থতায় তাঁর মৃত্যু হল। আর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার জীবনের সব রং যেন কেড়ে নিয়ে গেল সেই মৃত্যুদূত। 
আমির খসরুর আর মন নেই গানবাজনায়। তিনি তিনতারা বাদ্যযন্ত্রকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখছেন। ভাবছেন এটাকে কীভাবে আরও তার যুক্ত করা সম্ভব। সব মিলিয়ে নানাবিধ সুর পাওয়া যাবে সেই নতুন যন্ত্র থেকে। সেটাই মাথার মধ্যে ঘুরছে তাঁর। কিন্তু স্বয়ং খাজাজি এরকম নিরাশার অন্ধকারে ডুবে গেলে তিনি কীভাবে জীবনে সুরের সন্ধানে ব্রতী হবেন? তাই আমির খসরু পথে পথে ঘুরছেন। ভাবছেন। কী করা যায়?
হঠাৎ দেখতে পেলেন একদল মেয়ে চলেছে। তাদের রঙিন পোশাক। আর প্রত্যেকের হাতে একটি করে ডালা। সরু সরু বেত দিয়ে তৈরি ঝুড়ি। সেই ঝুড়িতে সর্ষের ফুল। সঙ্গে গাঁদা। সেও হলুদ। এটা কীকরম হল? সকলের পরনে হলুদ রঙের পোশাক। আবার ফুলও সব হলুদ। এরা যে হিন্দু ঘরের নারী সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। আবার গুনগুন করে সকলে কিছু একটা গানও গাইছে। কানহা...মোহন... এসব শব্দ ভেসে আসছে। তার মানে কৃষ্ণের আরাধনা? 
জায়গাটা কোথায়? খাজা চিল্লা খানখার পাশের রাস্তায়। গুরুদ্বার দমদমা সাহিবের কাছে। যা হুমায়ুন টম্বের পিছনে। কিন্তু সেসব তো আর তখন ছিল না। গুরুদ্বার দমদমা সাহিব অথবা হুমায়ুন টম্ব  দিল্লিতে আসবে অনেক পরে। কিন্তু আমির খসরু যেখানে বসে এই মেয়েদের দেখলেন, সেই স্থান এই চত্বরেই ছিল বলে তিনি নিজেই লিখেছিলেন। 
আমির খসুরু তাদের কাছে দ্রুত গিয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছ এভাবে? এর আগেও দেখেছি? 
মেয়েরা উত্তর দিল, মন্দিরে যাই আমরা। পুজো করতে। 
খসরু বলেন, আর এই ফুল?
তারা বলে, এই ফুল ছড়াই আমাদের দেবতার চরণে। তাঁর শরীরকে স্নান করানো হয় ফুলের স্পর্শে। 
খসরুর কাছে হজরত নিজামউদ্দিন একপ্রকার ঈশ্বরই। অতএব তিনি এক মুহূর্ত মেয়েদের কথা শুনে জানতে চাইলেন, এই যে তোমরা ফুল ছড়াও, এতে তোমাদের দেবতা খুশি হন?
মেয়েরা অবাক হয়ে বলে, নিশ্চয়ই। আমাদের ফুল ছড়ানোর ইচ্ছা তাহলে জাগ্রত হয় কেন? তিনিই নিশ্চয়ই আমাদের মনের মধ্যে এই ইচ্ছাটা প্রবেশ করিয়েছেন?
এই সাধারণ মেয়েদের মুখে এরকম গভীর জীবনদর্শনের কথা শুনে মোহিত হলেন আমির খসরু। তিনি দ্রুত ফিরলেন নিজের ঘরে। লিখলেন বসন্তকালের আগমনের বার্তাবাহী গান আর গীতিস্তবক। আর চলে গেলেন হজরতের দরগায়। তার আগে শিষ্যরা সকলে মিলে ঠিক করা হল, বসন্ত পঞ্চমীর দিন হবে এক অনুষ্ঠান। আনা হবে হলুদ ফুলের সম্ভার। সকলেই পরবে হলুদ রঙের পোশাক। আর হজরত নিজামউদ্দিনকে হলুদ ফুলের আসরে বরণ করে নিয়ে আমির খসরু শোনালেন, 
‘সকল বন ফুল রাহি সরসো
উমভা ফুটে তেসু ফুলে
কোয়েল বোলে দোয়ার দোয়ার
অর গোরি করত শৃঙ্গার...’
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মন থেকে এই রঙের উৎসব দেখে একটা পাথর নেমে গেল। তিনি উপলব্ধি করলেন প্রকৃতির এই আশ্চর্য রূপ রস গন্ধ আর রংকে। প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে নিজেকে মানুষকে আনন্দ দেবে বলে। আমরা মানুষ ক্ষুদ্র স্বার্থে সেদিকে তাকিয়ে দেখছি না। 
সেই শুরু। সাড়ে সাতশো বছরের বেশি সময় ধরে দিল্লির বিখ্যাত নিজামউদ্দিন আউলিয়া দরগায় চলছে বসন্ত পঞ্চমীর এই উৎসব। যে উৎসবে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই সমানভাবে অংশ নেয়। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে কাওয়ালি ও হিন্দবা সঙ্গীত। হিন্দবা সঙ্গীত আবার কী? 
কাওয়ালির আবিষ্কর্তা আমির খসরু ফারসি, উর্দুর পাশাপাশি বিশুদ্ধ হিন্দুস্তানি ভাষায় গীত রচনা করতেন। সেই গানকে তিনি আখ্যা দিতেন হিন্দবা। অর্থাৎ হিন্দুস্তানের নিজস্ব সঙ্গীত। 
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মনে জমে ওঠা হতাশার অন্ধকারকে দূর করেছিলেন আমির খসরু। অতএব তাঁর মনোবাসনা ছিল, আমার কবরের পাশেই যেন থাকে খসরুর খবর। আমরা পাশাপাশি 
থাকতে চাই। 
তাই হয়েছে। নিজামউদ্দিন দরগায় আমির খসরু শায়িত আছেন। আর প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানোর পর দরগায় শুরু হয় বিখ্যাত কাওয়ালি অনুষ্ঠান। ঠিক খসরুর 
সমাধির কাছেই! 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মস্থলে জটিলকর্মে অনায়াস সাফল্য ও প্রশংসালাভ। আর্থিক দিকটি শুভ। ক্রীড়াস্থলে বিশেষ সাফল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১০ টাকা৮৪.৮৪ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৪ টাকা১১২.১৯ টাকা
ইউরো৯১.৫৩ টাকা৯৪.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
14th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা