গল্পের পাতা

আজও রহস্য: ন্যাশনাল লাইব্রেরির অশরীরী 
সমুদ্র বসু

বেলভিডিয়ার গার্ডেন হাউস, আলিপুর। এই নামে না চিনলেও ন্যাশনাল লাইব্রেরি কলকাতা বললে সহজেই চিনবেন অধিকাংশ মানুষ। এই গ্রন্থাগার ভবন ও সংলগ্ন এলাকাটির পোশাকি নাম বেলভেডিয়ার এস্টেট। বেলভিডিয়ার হল গথিক ঘরানার বিশেষ স্থাপত্য।  ইতালিয়ান ভাষায় বেলভিডিয়ার শব্দের অর্থ মনোরম দৃশ্য।
ইতিহাস ঐতিহ্যের পাশাপাশি এই ভবনের গায়ে রয়েছে অতিলৌকিক তকমাও। নিজের বাসভবন হিসেবে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বেলভিডিয়ার গার্ডেন হাউস নির্মাণ করিয়েছেলেন  প্রিন্স আজিম উস খান। প্রিন্স আজিম উস খান ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবেদার। আওরঙ্গজেবের নাতি প্রথম বাহাদুর শাহ জাফরের ছেলে প্রিন্স আজিমের বেলভিডিয়ার বাসভবন ছিল  স্থাপত্য কীর্তি এবং বিলাসব্যসনের অন্যতম নিদর্শন। নিজেদের প্রয়োজন মিটে যাওয়ায় ব্রিটিশরা তাঁদের হাতের পুতুল নবাব মীরজাফরকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে পেনশনভোগী হিসেবে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কলকাতায় বেশ কিছু প্রাসাদ ও সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন মীরজাফর। শোনা যায় নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে  ‘আলিপুর’–এর নামকরণ করেছিলেন  মীরজাফর। এই বেলভিডিয়ার এস্টেট ছিল মীরজাফরের বাসভবন। যেখানে তাঁর সঙ্গে থাকতেন পত্নী মুন্নি বেগমও।
এই প্রসঙ্গে আসে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর নাম। ব্রিটিশ শাসনের ভিত মজবুত করতে সুচতুর প্রশাসক হেস্টিংসের ভূমিকা অন্যতম। ১৭৭২-১৭৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেলও ছিলেন সময়কাল ১৭৭৩-১৭৮৫।
ওয়ারেন হেস্টিংস আর মীরজাফরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার দৌলতেই ১৭৬০ নাগাদ এই বেলভিডিয়ার এস্টেট ওয়ারেন হেস্টিংসকে উপহার স্বরূপ দেন মীরজাফর। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়ের পরে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। পুনরায় তিনি ভারতে ফেরেন ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে। সঙ্গে তাঁর সুন্দরী জার্মান ব্যারনেস মারিয়ান ইনহফ। সাধের বেলভিডিয়ার হয়ে উঠল তাঁদের বাসভবন। পরবর্তীতে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলভিডিয়ার হাউসকে মেজর টলির কাছে বিক্রি করে দেন হেস্টিংস। পরবর্তীকালে ১৮০২ সালে মেজর টলির পরিবার এই সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়। 
এরপর নানা হাত ঘুরে অবশেষে লর্ড ডালহৌসির আমলে বেলভিডিয়ার হয়ে ওঠে ভারতের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবন। ১৮৫৪ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত এই বেলভিডিয়ার হাউস ছিল বহু ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবন। তারপর ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। এই ঐতিহাসিক ভবনের আজকের পরিচয় জাতীয় গ্রন্থাগার। ১৯৫৩ সালে যা উদ্বোধন করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।
১৮৩৬ সালের ২১ মার্চ হেয়ার স্ট্রিট আর স্ট্র্যান্ড রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত মেটক্যাফে হলে স্থাপিত হয় কলকাতার প্রথম লাইব্রেরি— ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’। ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি’। এই দুই পাঠাগার  ছিল  শুধুমাত্র  উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী এবং অভিজাত শ্রেণির মানুষদের জন্য। কিন্তু তৎকালীন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন দু’টি গ্রন্থাগারকে মিলিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি’। যার প্রথম ঠিকানা ছিল মেটক্যাফ হল। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে গ্রন্থাগারটি স্থানান্তরিত হয় ৬ নম্বর এসপ্ল্যানেড ইস্ট ঠিকানায়।
সারা পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহের পাশাপাশি এই জাতীয় গ্রন্থাগারের সঙ্গে জড়িয়ে রহস্যময় কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনাও! এর আনাচে-কানাচে আজও ভেসে বেড়ায় নানা কাহিনি। আজকের যে স্থানে গ্রন্থাগার, সেই স্থানের ইতিহাস রোমাঞ্চকর রক্তাক্তও বটে। যেখানে আজ নীরবতা বিরাজ করে সেখানে একসময় দ্বৈরথে বিদীর্ণ হয়েছিল অখণ্ড নীরবতা। এই বেলভিডিয়ার ভবন সাক্ষী এক ঐতিহাসিক ডুয়েলের। যখন ১৭৭৩ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হন, তখন তিনি মেরিয়ান ইমহফের সঙ্গে সম্পর্কে। কিন্তু অন্যদিকে আবার মারিয়ানের পাণিপ্রার্থী ছিলেন হেস্টিংসের আইনি কর্মকর্তা ফিলিপ ফ্রান্সিস। কয়েক বছর পর ব্যারনেস মারিয়ানকে কেন্দ্র করেই হেস্টিংস ও ফ্রান্সিসের মধ্যে সেই ঐতিহাসিক ডুয়েল হয়। এক শীতের রাতে বেলভিডিয়ার এস্টেটের মাঠে একটি গাছের নীচে হওয়া সেই ডুয়েলে হেস্টিংসের গুলিতে আহত হন ফিলিপ ফ্রান্সিস। তাঁর ঘাড়ে গুলি লাগে। এরপরের ঘটনা পরিষ্কার নয়। কেউ বলেন বেলভিডিয়ার হাউসেই নাকি ফ্রান্সিসের শুশ্রূষা হয়েছিল। আবার শোনা যায়, আহত ফ্রান্সিসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস একটি পালকির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেই পূর্ণিমার রাতে আদিগঙ্গার তীরে পৌঁছে পালকিবাহকরা দেখেন জোয়ার এতটাই বেশি যে পারাপার হওয়া সম্ভব না। তবে কি আহত ফ্রান্সিস বিনা চিকিৎসায় মারা যান? উত্তর স্পষ্ট নয়।  তবে এটা স্পষ্ট ব্রিটিশ আর নবাবরা আজ না থেকেও রয়ে গেছেন ইতিহাসে। যে ইতিহাস কিংবদন্তির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে। 
তাই আজ দুই শতাব্দীর পরও পূর্ণিমার রাতে জনৈক প্রহরীর চোখে দৃশ্যমান হয় একটি পালকি মাঠ অতিক্রম করছে, যার মধ্যে রয়েছে রক্তাক্ত দীর্ঘদেহী এক যুবক। সেই জ্যোৎস্নার মধ্যেই যা আবার মিলিয়ে যায়। রক্তের দাগ মুছে গিয়েছে কবেই কিন্তু ইতিহাস রয়ে গিয়েছে। বেলভিডিয়ার হাউস এমনই সব ইতিহাস ও কিংবদন্তির সাক্ষী, যেখানে এলে মনে হয় সময় পিছিয়ে গিয়েছে কয়েকশো বছর।
ইতিহাস আর কিংবদন্তিতে ভারী এখানকার হাওয়া। অনেক পড়ুয়াদের দাবি তাঁরা অনেক সময় শুনেছেন চলাফেরার চাপা শব্দ, কখনও বা হালকা গুঞ্জন কিন্তু তাঁদের চোখে পড়েনি কিছুই। কেউ কেউ বলেছেন, পড়ার সময় ঘাড়ে অদৃশ্য কারওর নিঃশ্বাস অনুভব করেছেন। অনেকের দাবি, লর্ড মেটক্যাফের স্ত্রীর আত্মা নাকি এখনও যাতায়াত  করে এই লাইব্রেরিতে। লর্ড মেটক্যাফের স্ত্রী ছিলেন পরিচ্ছন্নতার  ব্যাপারে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। তাই লাইব্রেরিতে কোনও বই নিয়ে সেটা আবার ঠিক না রাখলে আপনি ঘাড়ের কাছে কারও ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনলেও শুনতে পারেন! 
অনেকে আবার শুনেছেন লাইব্রেরির নির্দিষ্ট হল থেকে ভেসে আসা কনসার্টের সুর। যেখানে হেস্টিংস দম্পতি বলডান্স করতেন এস্টেটের হলরুমে। সঙ্গে ব্রিটিশ সমাজের অন্যান্য অভিজাতরা। সেই হলঘরই দীর্ঘ দিন ছিল জাতীয় গ্রন্থাগারের রিডিং রুম। পরে তা ভাষা ভবনে স্থানান্তরিত হয়। হেস্টিংস সাহেব নাকি আজও এই বেলভিডিয়ার এস্টেটের টানে বারেবারে এখানে ফিরে আসেন প্রায়ই। আজও নাকি ইংরেজি বর্ষবরণের গভীর রাতে নির্জন এস্টেটের পার্টিতে বলডান্সে অংশ নিতে আসেন গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস! অনেকেই নাকি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ভবনের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন। কেউ কেউ দাবি করেন হেস্টিংস সাহেব আজও নাকি নিজের হারিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কালোবাক্সের খোঁজে কখনও আসেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে, কখনও বা হেস্টিংস হাউসে। 
এমনই সব জনশ্রুতিতে ভরপুর জাতীয় গ্রন্থাগার। তাই নাকি ন্যাশনাল লাইব্রেরির কিছু কর্মী নিজেদের সঙ্গে রাখেন হনুমান চালিশা। আবার ২০১০ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কাজ চলার সময় আবিষ্কার হয় ২৫০ বছরের পুরনো একটি চেম্বারের। যেই রহস্যময় কক্ষের বিষয়ে আগে কেউই জানত না। যেই কক্ষের নেই কোনও প্রবেশদ্বার বা জানলা। এমনকী কোনও গোপন ট্র্যাপডোরও নেই। এই কক্ষটি কোনও হতভাগ্যের টর্চার 
চেম্বার নাকি এখানে রয়েছে গুপ্তধন— সেই নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা। তাই চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে আসতেই পারেন কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে। 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মস্থলে জটিলকর্মে অনায়াস সাফল্য ও প্রশংসালাভ। আর্থিক দিকটি শুভ। ক্রীড়াস্থলে বিশেষ সাফল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১০ টাকা৮৪.৮৪ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৪ টাকা১১২.১৯ টাকা
ইউরো৯১.৫৩ টাকা৯৪.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
14th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা