নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: কথায় বলে, গল্পের গোরু গাছে ওঠে! আর জি করে সম্ভবনাময় তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ঘিরে এমন অনেক আজগুবি রটনাই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। এইসব ভিত্তিহীন খবরের জেরে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। লালবাজারের হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দাদের নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
অধ্যাপক, চিকিৎসক থেকে পাড়ার চায়ের দোকানের পাতি ন্যাপলা—সবাই এখন স্বতঃপ্রণোদিত গোয়েন্দা সেজে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলছেন। বহুক্ষেত্রেই ভুয়ো তথ্য দিয়ে বাজার গরম করার চেষ্টা চলছে। এতে রাজ্য সরকারের পাশাপাশি পুলিসের বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট একদল ইউটিউবার আবার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না দেখেই ভুল খবর প্রচার করছেন। সেটা লালবাজারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
কলকাতা পুলিসের এক সূত্র জানাচ্ছে, আজগুবি তথ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, তরুণীর দেহে নাকি তিনজন ব্যক্তির সিমেন মিলেছে। প্রকৃত তথ্য হল, ময়নাতদন্তে কোনওভাবেই খালি চোখে তিনজনের সিমেনের পার্থক্য করা যায় না। এরজন্য ডিএনএ টেস্ট করতে হয়। লালবাজার তাই ডিএনএ টেস্ট করাচ্ছে। দ্বিতীয় আজগুবি তথ্য হল, তরুণীর দেহে নাকি ১৫০ গ্রাম সিমেন মিলেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, একজন অ্যাডাল্ট ব্যক্তির দেহ থেকে একবারে ১.৫ এমএল সিমেন নির্গত হতে পারে। সেই হিসেবে ১৫০ গ্রাম সিমেন পেতে হলে ধর্ষকের সংখ্যা অন্তত ১০০ জন হতে হবে।
তৃতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়েছে তরুণীর দেহের কলার বোন, পেলভিক গার্ডের মতো হাড় ভাঙা ছিল। ময়নাতদন্ত রিপোর্টকে ভিত্তি করে লালবাজারের দাবি, নির্যাতিতা চিকিৎসকের দেহে কোনও হাড় ভাঙা ছিল না। চতুর্থত, খুন হওয়া চিকিৎসকের বাবার মুখ বন্ধ করতে নাকি মোটা টাকা অফার করেছিলেন এক পুলিস অফিসার। আসল তথ্য হল, নির্ভয়া কাণ্ডের পর গোটা দেশের মতো এরাজ্যেও খুন, অ্যাসিড হামলা, ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য রাজ্য। এনিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। তার ভিত্তিতেই এই টাকা প্রাপ্য পরিবারটির। এক্ষেত্রে কোনও ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়নি।
পঞ্চমত, মানবাধিকার কর্মীদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, সেমিনার রুমে চিকিৎসকের মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে দেহে আঘাতের কথা চেপে গিয়েছে পুলিস। এমনকী ময়নাতদন্তের রিপোর্টও পুলিস নাকি প্রকাশ্যে আনছে না। বাস্তব তথ্য হল, নির্ভয়া কাণ্ডের পর ধর্ষিতার দেহে আঘাতের চিহ্ন সংবাদমাধ্যমকে জানানো আইনবিরুদ্ধ। ধর্ষণ, খুনের মতো স্পর্শকাতর অপরাধে ময়নাতদন্তের মতো মেডিকো লিগ্যাল প্রমাণ প্রকাশ্যে আনা যায় না। ষষ্ঠ অভিযোগ, ওই চিকিৎসকের বাড়িতে ফোন করে পুলিস নাকি আত্মহত্যার কথা জানিয়েছিল। প্রকৃত তথ্য হল, মোট দু’বার ফোন করা হয়েছিল। ফোন দু’টি করেছিলেন আর জি করের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার, যার কল রেকর্ডিং সংগ্রহ করেছে পুলিস। এমনকী মঙ্গলবার অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারকে লালবাজার জিজ্ঞাসাবাদ করে।
লালবাজার জানাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগে, বিভিন্ন পেশার ৩৭ জনকে মঙ্গলবার লালবাজারে তলব করা হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্ট এই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতেই জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব বন্ধ করা দেয় লালবাজার।
রোগী ভোগান্তির প্রতিবাদে আর জি কর হাসপাতালের বাইরে পোস্টার। - নিজস্ব চিত্র