পরামর্শে বরাহনগর স্টেট আয়ুর্বেদিক ডিসপেনসারির সিনিয়র আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ সত্যস্মরণ অধিকারী
এই তো বছর চারেক আগের কথা। করোনার ঢেউ দেশে আছড়ে পড়েছে। নিত্যদিন মারণ এই ভাইরাস নিয়ে নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। সেই সময় থেকেই হঠাৎ সকলের মধ্যে ‘ইমিউনিটি বাড়ানোর ধুম’ পড়ল। তাও ঘরোয়া উপায়ে। হালকা গরম জল পান থেকে শুরু করে কাড়া বানিয়ে খাওয়া – কত কিছুই না ছিল সেসময়। করোনার প্রকোপ কমতেই আবার সেই ঘরোয়া টোটকার দিনও শেষ।
এই ঋতুপরিবর্তনের সময়ও ঘরে ঘরে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। তাই এই সময় বিশেষ করে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের হাতের কাছেই এমন কিছু জিনিস রয়েছে, যা খেলে কিন্তু আমাদের শরীর অনেকটাই রোগমুক্ত থাকতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে দেওয়া দরকার, আমাদের দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতিতে ইউমিউনিটির কনসেপ্ট ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইমিউনিটির কনসেপ্ট অনেকটাই আলাদা। ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সুষ্ঠু জীবনযাপনের সঙ্গে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। শুধুমাত্র বাহ্যিক কোনও বস্তু বা পদার্থ গ্রহণ করলেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে, এমনটা মোটেও নয়।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, আমাদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মূল ভিত্তি হল ত্রিস্তম্ভ। অর্থাৎ আহার, নিদ্রা ও ব্রহ্মচর্য (সুষ্ঠু জীবনযাপন)। যে কোনও মানুষের এই তিন স্তম্ভ যদি ঠিকঠাক পালিত হয়, তাহলে তাঁর হঠাৎ করে ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য বাইরে থেকে কোনও সাপ্লিমেন্ট দেহের মধ্যে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন নেই।
শরীরের ত্রিদোষ (বাত, পিত্ত, কফ), অগ্নি, ধাতু ও মলের (শরীরের সার্বিক বর্জ্য) যথার্থ নির্গমণ হলেই আমরা রোগমুক্ত থাকতে পারি। সমস্যা হল, আমাদের মধ্যে অধিকাংশই এই ত্রিস্তম্ভ ঠিকঠাকভাবে মেনে চলতে পারি না। এর ফলেই দেহের ভারসাম্য বিগড়ে যায়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে।
তখনই আমরা মনে করি, বাইরে থেকে কোনও ইমিউনোবুস্টিং সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে আমরা ইমিউন থাকতে পারব। কিন্তু তা ভ্রান্ত ধারণা। ত্রিস্তম্ভে ভারসাম্য না থাকলে বাইরে থেকে যাই গ্রহণ করি না কেন, তা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বাড়িয়ে দেবে, তা মোটেও নয়।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসা মতে, মানুষের সাধারণ ইমিউনিটি ঠিকঠাক বজায় রাখার জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন রসায়ন ও বাজীকরণ দ্রব্য সেবন করা জরুরি। এই ধরনের ঘরোয়া ‘টোটকা’ কিন্তু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ওই রসায়ন ও বাজীকরণ দ্রব্যই। যেমন গুলঞ্চ, নিম, যষ্ঠিমধু, পিপুল, ত্রিফলা, অশ্বগন্ধা ইত্যাদি।
কোন টোটকায় কী কী গুণ?
গুলঞ্চ: গুলঞ্চের মধ্যে সংশমন গুণ রয়েছে। আমাদের দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় ভারসাম্যের অভাব হলে, গুলঞ্চ তা স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। গুলঞ্চের কাণ্ড ও পাতা থেঁতো করে খাওয়া যেতে পারে। বা তা শুকিয়ে গুঁড়ো করেও সেবন করা যেতে পারে।
নিম: নিমের প্রায় প্রতিটি অংশেরই গুণাবলি রয়েছে। এটি ইমিউনোমডুলেটরি অর্থাত্ অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে। এছাড়া রক্ত পরিষ্কার করতে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও নিমের জুড়ি মেলা ভার।
যষ্ঠিমধু: যষ্ঠিমধু জলে ফুটিয়ে বা চিবিয়ে খাওয়া যায়। এটিও ইমিউনোমডুলেটরি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি, পিত্তের ক্ষরণও ত্বরাণ্বিত করে। সর্দি-কাশি হলেও যষ্ঠিমধু খেলে উপকার পাওয়া যায়।
অশ্বগন্ধা: মানবশরীরে সেলুলার ইমিউন সিস্টেমে কাজ করে অশ্বগন্ধা। এটা মেধ্য রসায়ন অর্থাত্ স্মৃতি ও বুদ্ধিবর্ধক। এটি বাত, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিদ্রা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। পাশাপাশি মানসিক চাপ, উত্তেজনাও কমায়।
তুলসী বীজ: তুলসী বীজের তেল মানবশরীরে অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। জল বা দুধের সঙ্গে মিশিয়ে তুলসী বীজ খাওয়া যেতে পারে।
পিপুল: পিপুল সেবনে রেসপিরেটরি ইমিউনিটি বাড়ে। ক্রনিক রাইনাইটিস, জ্বর, অরুচি প্রতিরোধ করে। এটি বল, মেধা ও অগ্নি বৃদ্ধিকারক।
হলুদ: হলুদ সেলুলার ইমিউনিটি বাড়ায়। আয়ুর্বেদে এটি কষায় রস শ্রেণিভুক্ত। তিনটি দোষের ভারসাম্য বজায় রাখে। এর মধ্যে অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি গুণ রয়েছে।
কচি সজনে ডাটা ও সজনে ফুল: সজনে ফুল ও কচি ডাটা অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে। বসন্তের শুরুতে সর্দি-কাশি, জ্বরের প্রাদুর্ভাব দূরে রাখতে সজনে ফুল খাওয়া উপকারি।
এঁচোড়: এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন সি ও ভিটামিন এ থাকার জন্য রোগ প্রতিরোধ করে। এটি হার্টের জন্যও খুব ভালো। এঁচোড় খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ব্রাহ্মীশাক: উচ্চরক্তচাপ ও মানসিক চাপ কমিয়ে হার্ট সুস্থ রাখে। এটিও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখে। যাঁরা অল্পেই কাহিল হয়ে পড়েন, তাঁরা এই শাকের জ্যুস খেতে পারেন। এটি স্মৃতিশক্তিও বাড়ায়।
আমলকী: আমলকী নিয়মিত খেলে রেসপিরেটরি ইমিউনিটি ভালো হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। এটি মেটাবলিজম বাড়ায়। বাত, কফ, পিত্ত বিনাশ করে। এইসব ছাড়াও কিছু সহজ অভ্যাসও আমাদের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্রাহ্মমুহূর্তে বিছানা ত্যাগ করা উচিত। সকালের পরিচ্ছন্ন বাতাসে আমাদের অ্যাটমোস্ফোরিক ইমিউনিটি বাড়ে। ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ে। রক্তের পিএইচ-এর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। খনিজ ও ভিটামিনের শোষণ ক্ষমতাও বাড়ে। পাশাপাশি নিয়মিত সকাল ন’টার আগে সূর্যতাপ গ্রহণে শরীরে সেলুলার ইমিউনিটি বাড়ে।
লিখেছেন সায়ন মজুমদার