লিখেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুর্বেদ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসা-বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডাঃ সুবলকুমার মাইতি
যজুর্বেদের সময় থেকে অদ্যাবধি আমলকীকে নিয়ে কত রকমের চর্চা ও গবেষণা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। শুধুমাত্র আয়ুর্বেদ চিকিৎসার নিরিখে শত শত তত্ত্ব ও তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। প্রাচীন ও বর্তমানকালের গবেষণাকে সামনে রেখে কাঁচা আমলকী ও শুকনো আমলকীকে খাদ্য ও ভেষজ হিসেবে কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে— আজকের আলোচনার নৈবেদ্য সেভাবেই সাজানো হল।
কীভাবে খাবেন?
এই মুহূর্তে অর্থাৎ শীতের মরশুমে কাঁচা আমলকী প্রচুর পরিমাণে বাজারে পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ কমবেশি কাঁচা আমলকী খেয়ে থাকেন। টিফিনের পর বা দুপুরের ভাতের পর রোদ পোহানোর আমেজে নুন-লঙ্কা দিয়ে কাঁচা আমলকী ছেঁচা রোদে দিয়ে খাওয়ার একটা চল হয়েছে ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
কাঁচা আমলকীর রস, কাঁচা আমলকী সিদ্ধ করা জল এবং আমলকী— সবভাবেই খাওয়া যেতে পারে। ১টা কাঁচা আমলকী ফালা ফালা করে কেটে এক কাপ জলে রাতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে খালিপেটে জলটি খেয়ে আমলকীর টুকরোগুলো ভাত খাওয়ার পর খেতে পারেন।
সারা বছর কাঁচা আমলকী সকলের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। তখন শুকনো আমলকী ভিজিয়ে জল খেতে পারেন।
আমলকীর সঙ্গে নুন মাখিয়ে শুকিয়ে রেখে মুখশুদ্ধি হিসেবে ব্যবহার করতে পারলে খুবই ভালো। তাছাড়া শুধু আমলকী দিয়ে নানা রকমের খাদ্য ও ওষুধ তৈরি হয় এবং সেগুলি আমরা কমবেশি খেয়ে থাকি।
তবে কোনও কিছু অতিরিক্ত খাবেন না। যে কোনও ভালো দ্রব্যেরও কমবেশি ক্ষতিকর প্রভাব থাকবেই। কাঁচা বা শুকনো আমলকী মাত্রাতিরিক্ত খেতে নেই। মাঝে মাঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাবেন।
ব্যবহার
আমলকীর মোরব্বা, নোনা আমলকী, আমলকীর রসের সিরাপ, কাঁচা বা শুকনো আমলকীতে নুন মাখিয়ে মুখশুদ্ধি করে নানাভাবে আমরা খেয়ে থাকি।
১. এই ফলটি অত্যধিক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। কাঁচা আমলকীতে প্রচুর ভিটামিন-সি থাকে। সরাসরি খেলে শরীরে ভিটামিন-সি পুরোটাই যেতে পারে। কাঁচা ও শুকনো আমলকী মাত্রা মতো খেতে পারলে বিভিন্ন রোগের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবেন।
২. রোজ খাদ্য থেকে যে পরিমাণ টক্সিন শরীরে জমা হতে থাকে, তার অনেকটাই আমলকী বের করে দিতে পারে।
৩. কোলেস্টেরলের মাত্রায় কমায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম থাকায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে।
৪. ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ কমাতে পারে আমলকীর চূর্ণ অথবা রস। এলডিএলের মাত্রা কমিয়ে এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়।
৫. হজমক্ষমতা বাড়ায়। আমলকীর রস দিয়ে তৈরি আমলকী রসায়ন দু’বেলা ভাত খাওয়ার পর ৩-৪ চা চামচ মাত্রায় আধকাপ জলে মিশিয়ে খাওয়া যায়। কাঁচা আমলকী দুপুরে ভাত খাওয়ার পর মাঝারি ধরনের একটি নিয়ে রোজ চিবিয়ে খেতে পারলে অম্ল, অজীর্ণ, অরুচি, হিক্কা, দাহ, বমি প্রভৃতি কমাতে পারে।
৬. অপুষ্টি ও রক্তহীনতায় মাঝারি আকারের কাঁচা আমলকী ১টা (১০-১৫ গ্রাম ওজনের) করে প্রত্যহ খেলে ভালো থাকবেন।
৭. শিরা-ধমনীতে জমে যাওয়া চর্বির আস্তরণ কমিয়ে দিতে পারে আমলকী।
৮. নিয়মিত ব্যবহার কোলাইটিস ও হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৯. কোষ্ঠ সাফ করে। পেট ভালো রাখতে আমলকীর জুড়ি মেলা ভার।
১০. যেভাবেই খান না কেন, প্রতিনিয়ত না হোক, সপ্তাহে ২-৩ দিন কাঁচা আমলকী রস বা শুকনো আমলকী ভেজানো জল বা শুকনো আমলকী চূর্ণ মাত্রামতো খেতে পারলে হঠাৎ বুড়িয়ে যাওয়ার সমস্যা আসবে না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।
১১. মস্তিষ্ককে সুস্থ রেখে বুদ্ধি স্মৃতি মেধায় সমতা আনতে পারে।
১২. লাইফস্টাইল ডিজিজগুলোর বেশিরভাগই আসে নিয়ম মেনে আহার- বিহার না করলে। নিয়ম মেনে সময়মতো খাওয়াদাওয়া-পরিশ্রম-বিশ্রাম করতে পারলে হঠাৎ করে এসব ঝামেলায় পড়তে হবে না। ধূমপান এবং নানাবিধ মাদক ও মদ্যপান জনিত সমস্যায় এবং জাঙ্ক ফুড, কোল্ড ড্রিংকস প্রভৃতি অত্যধিক খাওয়ার ফলে লাইফ স্টাইল রোগগুলির জন্ম হয়। যার ফলে অ্যাথেরোস্ক্লোরোসিসের সৃষ্টি হয়। ধমনীর ভেতরে কোলেস্টেরলের আস্তরণ পড়ে যায়। সৃষ্টি হতে থাকে নানা প্রকারের হার্টের রোগ, স্ট্রোক, প্যারালিসিস, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, ক্লোরেস্টেরলের বৃদ্ধি ও হ্রাস জনিত সমস্যা প্রভৃতি। নিয়মিত আমলকীর ব্যবহারে এই রোগগুলি হঠাৎ করে আসতে পারে না।
১৩. হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস সুস্থ রাখতে অর্থাৎ হার্টের গতি ও রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে হলে যে কোনওভাবে আমলকী খাওয়ার চেষ্টা করুন।
১৪. ডায়াবিটিসের নানা সমস্যায় আমলকীর ব্যবহার বিশ্বব্যাপী। এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নিয়ন্ত্রণ করে। চোখের দৃষ্টি ভালো রাখতে সাহায্য করে। ইনসুলিনের উৎপাদন বাড়ায়।
১৫. মূত্রবহ স্রোতকে স্বাভাবিক রাখে।
১৬. ত্বক ও চুলের পরিচর্যায় আমলকী অত্যন্ত উপকারী।
১৭. কফ কাশি হাঁপানি এবং কফজ রোগসমূহকে প্রশমিত করে।
১৮. রক্তের ফ্রি- নষ্ট করে নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে শরীরকে সুস্থ রাখতে আমলকীর ভূমিকা আশ্চর্যজনক।
১৯. অ্যালার্জি ও আর্টিকেরিয়া (শীতপিত্ত) কমায়।
২০. অনিয়মিত মেনস্ট্রুয়েশনকে নিয়মিত করাতে পারে আমলকী। শ্বেতপ্রদরকেও নষ্ট করতে পারে। অপুষ্টি ও রক্তহীনতাকে দমন করে অনিয়মিত মেনস্ট্রুয়েশন ও শ্বেতপ্রদরকে সারিয়ে তোলে।
২১. রক্তের নানারকমের দোষকে বিশুদ্ধ করে শরীরকে সুস্থ করতে পারে।
২২. যে কোনও রোগান্তিক ও প্রসবান্তিক দুর্বলতায়, শুক্রাল্পতায় আমলকীর রস অথবা আমলকী দিয়ে তৈরি মোদক বা রসায়ন দ্রব্য খুব দ্রুত কাজ করে।
২৩. আমলকীর মধ্যে থাকা ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরের সমস্ত কলকব্জা ও যন্ত্রপাতির মধ্যে সমতা রক্ষা করে। শরীরকে সুস্থ ও সবল করে তোলে।
২৪. বায়ুজনিত কারণে পায়খানা ও প্রস্রাব আটকে পেট ফুলে গেলে শুকনো আমলকী বেটে নাভির চারদিকে পুরু করে প্রলেপ দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে পায়খানা প্রস্রাব বাতকর্ম হয়ে শরীরের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
২৫. গ্যাস্ট্রাইটিস ও গ্যাস্ট্রিক আলসারে আমলকী দিয়ে বিশেষভাবে ওষুধ তৈরি করে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে খালিপেটে আমলকীর রস খেলে অম্বলের পরিমাণটা বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শুকনো আমলকীর ৩-৪টি টুকরো, শুকনো ধনে ১ চা চামচ ও কাঁচা বা শুকনো পটলপাতা ২-৩টি রাতে গ্লাসখানিক গরম জলে ভিজিয়ে রেখে পর দিন সকালে ছেঁকে জলটি সকালে খালিপেটে অর্ধেকটা ও টিফিনের পর অর্ধেকটা খেতে হবে।
২৬. আমলকীতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। ফলে যাঁদের রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, তাঁরা এটি খাবেন না, অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করবেন। এতে সামান্য ইউরিক অ্যাসিড থাকায় অধিক পরিমাণে খেতে নেই। কিডনির ক্ষেত্রে পটাশিয়ামের ও ইউরিক অ্যাসিডের আধিক্য যাতে সমস্যার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
২৭. বাচ্চাদের নানা সমস্যায় আমলকীর ভূমিকা বিশাল। ওদের অরুচি, বদহজম, পেটফাঁপা, বমি বমি ভাব, অ্যালার্জি, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আমলকীর ভূমিকা বিশাল। তবে ব্যবহার করুন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে। কাঁচা আমলকীর রস সামান্য সামান্য করে খেতে দিতে পারেন ৩-৪ ফোঁটা থেকে ৮-১০ ফোঁটা।
২৮. ক্যান্সার প্রতিরোধে আমলকীর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে। এর ভিটামিন সি এইক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
২৯. আমলকীতে অক্সালেট অনেকটা বেশি থাকায় কিডনিতে পাথর জমলে সতর্ক থাকতে হবে। তবে যেহেতু প্রস্রাবের অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষা করতে পারে আমলকী, সেহেতু শরীরস্থ সর্বপ্রকার ক্ষতিকারক পদার্থকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দিতে পারে। তবে ডায়ালিসিস চলাকালীন আমলকী না খাওয়াই ভালো।
৩০. কাঁচা ফলে ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেলে দাঁত ও মাড়ি সুস্থ থাকে।
৩১. আমলকীতে সবচেয়ে শক্তিশালী পদার্থ ‘সায়াভানাপ্রা’ থাকায় এটি নারী-পুরুষ উভয়ের প্রজননতন্ত্রকে শক্তিশালী এবং কর্মক্ষম করে তোলে।
৩২. আমলকী সিদ্ধ জল দিয়ে নারকেল তেল বা তিল তেল পাক করে লাগালে চুল ভালো থাকে। মাথা ঠান্ডা থাকে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শমতো তৈরি করাতে হবে।
৩৩. পেটের গোলমাল থাকায় যাঁরা মাঝে মধ্যে ডায়ারিয়ায় ভোগেন, তাঁরা রোজ ১টি করে কাঁচা আমলকী ভাতে সেদ্ধ করে ভালোভাবে সামান্য নুন দিয়ে মেখে ভাতের সঙ্গে চাটনির মতো খাবেন। কাঁচা না পেলে ২-৩ গ্রাম আমলকী চূর্ণ দুপুরে ভাত খাওয়ার পর জল দিয়ে খেতে পারেন।
মনে রাখবেন
একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন— শরীর ও মনকে সার্বিক ভাবে ভালো রাখতে আমলকী এককভাবে ব্যবহার করতে চাইলে বা পারলে একাই ফল, আহার, ওষুধ হিসেবে সকলের সেরা হয়েই ধরা দেবে। শীতের আগে পিছে মাসচারেক কাঁচা আমলকী বাজারে পাওয়া যায় এবং কমবেশি অনেকেই তা নানাভাবে খেয়ে থাকেন। আমলকী কেটে কেটে তাতে নুন মিশিয়ে রোদে রেখে রেখে প্রত্যহ কিছুটা করে খাওয়ার অভ্যাসটাই বেশি দেখা যায়। তবে দুপুরে ভাত খাওয়ার পর মাঝারি ধরনের একটা কাঁচা আমলকী চিবিয়ে খাওয়া সবচেয়ে ভালো। কেবল এই একটা ফলকে নিয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে শরীর সুস্থ রাখা যেমন সহজ, তেমনি অনেক রোগ আসতে পারবে না। সাধারণ রোগগুলিকে ঘরোয়া চিকিৎসাতেই জব্দ করতে পারবেন। গ্রামের মানুষজন প্রায় বাড়িতেই একটা করে আমলকী গাছ লাগিয়ে রাখতে পারেন। শরীরকে সারা বছরের জন্য সতেজ চাই যতদিন কাঁচা আমলকী পাওয়া যাবে, ততদিন প্রত্যহ একটি করে ছোট বা মাঝারি আকারের আমলকী চিবিয়ে খান। বহু দ্রব্য আছে, যেগুলি আমলকীর সঙ্গে খেতে পারেন। যেমন হরীতকী ও বহেড়া। একত্রে ত্রিফলা। ত্রিফলার ব্যবহার সারা বছরই করা যায়। আমাদের অর্থাৎ মনুষ্যজাতির জন্য খাদ্যবিচার করলে নিরামিষ আহারের পরিমাণটা বেশি অথবা সম্পূর্ণভাবে হওয়া উচিত। নানা মুনির নানা মত অনুসারে সঠিক খাদ্য নির্বাচন আমরা সবসময় করে উঠতে পারি না। তা সত্ত্বেও আমিষ ও নিরামিষ— এই দু’ধরনের খাদ্য বাঙালিরা একসঙ্গে খেতে অভ্যস্ত। সেভাবেই বলা যেতে পারে— নিরামিষের সঙ্গে দিনের বেলায় মাছ বা মাংস বা ডিম যে কোনও একটি খেতে পারেন। রাতের বেলায় কেবল নিরামিষ খাবার খাবেন। তেল সামান্য পরিমাণে খাবেন। পোড়া তেল রান্নায় ব্যবহার করবেন না। সাধারণ মানুষের জানার অধিকার আছে বইকি ভোজ্য তেল হিসেবে যে ১০-১৫টি বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলি সত্যিকারে কীভাবে তৈরি হয়, কীভাবে বাজারে আসে ও বিক্রি হয়। চর্বি জাতীয় দ্রব্যগুলির মধ্যে কোন চর্বি কোন দ্রব্যে বা খাদ্যে মেশানো হয়, তাও সর্বসাধারণের জানা দরকার।
আমলকী ছাড়াও কয়েকটি শাকসব্জিও শরীরকে সারা বছরের জন্য সুস্থ রাখতে পারে। যেমন বেতো শাক, গীষ্মে শাক, মেথি শাক প্রভৃতি। বেতো শাক মাত্র ২-৩ মাস, গিমে শাক ৫-৬ মাস, মেথি শাক ২-৩ মাস কাঁচায় পাওয়া গেলেও সারা বছর শুকনো পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ মানুষই খান না। কিন্তু প্রকৃতি ঋতু অনুযায়ী সব সাজিয়ে রাখতে কোনও কিছুরই কার্পণ্য করে না।